আইসিইউ ও কেবিন সাপোর্ট দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো

দেশে হঠাৎ করেই মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিদিনই এ সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ইতোমধ্যে শনাক্তের হার ১৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। রাজধানীর অধিকাংশ হাসপাতাল ঘুরে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সিট। একটা নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) পেতে সাধারণ রোগীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সংক্রমণের হার এভাবে বাড়তে থাকলে দ্রুত করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের (২৩ মার্চ) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন তিন হাজার ৫৫৪ জন। ফলে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৭৭ হাজার ২৪১ জনে। গত বছরের ২ জুলাইয়ের পর এটিই দেশে একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত। সেদিন আক্রান্ত হিসেবে দেশে শনাক্ত হয়েছিলেন চার হাজার ১৯ জন। এ সময় আক্রান্ত আরও ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৭৩৮ জনে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোগী শনাক্তের হার বেড়ে যাওয়ায় করোনা ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতালগুলোর সাধারণ শয্যা থেকে শুরু করে কেবিন ও আইসিইউতে রোগীর চাপ বাড়ছে। অনেক জটিল রোগীকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইসিইউ ও কেবিন সাপোর্ট দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, রাজধানীতে কোভিড ডেডিকেটেড ১০ সরকারি হাসপাতালের মধ্যে ছয়টিতে আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) শয্যা ফাঁকা নেই। দুটিতে মাত্র পাঁচটি খালি থাকলেও বাকি দুটিতে আইসিইউ শয্যাই নেই।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে বর্তমানে ৫৭৭ কোভিড রোগী ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে হচ্ছে ২৮৫ জনকে। বর্তমানে ১০টি আইসিইউ শয্যাই রোগীতে পূর্ণ। এর মধ্যে ভেন্টিলেশনে একজন। এছাড়া কেবিনে রয়েছেন ২৪ রোগী। শিশু রোগী রয়েছে পাঁচজন। সন্দেহজনক ছয় কোভিড রোগীর মৃত্যু হয়েছে

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে বর্তমানে ৫৭৭ কোভিড রোগী ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে হচ্ছে ২৮৫ জনকে। বর্তমানে ১০টি আইসিইউ শয্যাই রোগীতে পূর্ণ। এর মধ্যে ভেন্টিলেশনে একজন। এছাড়া কেবিনে রয়েছেন ২৪ রোগী। শিশু রোগী রয়েছে পাঁচজন। সন্দেহজনক ছয় কোভিড রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ঢামেক হাসপাতালের গত ২৪ ঘণ্টার এ চিত্রই বলে দেয় দেশের কোভিভ পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, দুই সপ্তাহ আগেও করোনা রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড এ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৯৮ জন। কিন্তু গতকাল (সোমবার) পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৩৯৬ জন।

গত বছরের ২ জুলাইয়ের পর মঙ্গলবার সর্বোচ্চ করোনারোগী শনাক্ত

বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘দেশে করোনার সংক্রমণের হার বাড়ছে। হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রয়েছে। তবে মানুষ যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানে, হাসপাতালের শয্যা সংখ্যার চেয়ে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বাড়লে চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হবে।’

১০টি সরকারি হাসপাতালে দুই হাজার ৩৪৯টি সাধারণ শয্যার মধ্যে এক হাজার ৭১০টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। ফাঁকা আছে ৬৩৯টি শয্যা। মোট ৯৫টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ৯০টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। মাত্র পাঁচটি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা আছে

গত ১ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত দেশে করোনা সংক্রমণের তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২ মার্চ শনাক্ত রোগী ছিল ৫১৫ জন। ওইদিন মৃত্যু হয়েছে সাতজনের। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১০ মার্চ শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০১৮ জনে, অর্থাৎ দ্বিগুণ। একইভাবে পরবর্তী এক সপ্তাহে সংক্রমণের হার আরও বেড়ে ১৮৬৫ জনে উন্নীত হয়। এরপর মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় সোমবার (২১ মার্চ) নতুন করে ২৮০৯ জন শনাক্ত হন। 

সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি ও আইসিইউ শয্যার সর্বশেষ পরিসংখ্যান

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ১৬৯ সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ৭৫টিতে, ফাঁকা ৯৪টি। ১৬টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে সবকটিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২৭৫টি সাধারণ শয্যা থাকলেও অতিরিক্ত রোগীসহ মোট ভর্তি ৩৯৩ জন। করোনায় আক্রান্ত ১১৮ রোগীর জন্য আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। ১০টি আইসিইউ শয্যার কোনোটিই ফাঁকা নেই।

সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৯০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ৪৯টিতে, ফাঁকা আছে ৪১টি শয্যা। ছয়টি আইসিইউ শয্যার সবকটিতে রোগী ভর্তি রয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৮৮৩টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ৫৭৭টিতে, ফাঁকা ৩০৬টি শয্যা। ১০টি আইসিইউ শয্যার কোনোটি ফাঁকা নেই।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩১০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ২৩০টিতে, ফাঁকা ৮০টি। ১৪টি আইসিইউ শয্যার কোনোটি ফাঁকা নেই।

বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ১০ হাজার ৪৫০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে মোট রোগী ভর্তি দুই হাজার ৮৪৫ জন। খালি আছে সাত হাজার ৬০৫টি সাধারণ শয্যা। মোট ৫৪০টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ২৯৮টিতেই রোগী ভর্তি। ফাঁকা রয়েছে ২৪২টি শয্যা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের ২৩৪টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ১৪৩টিতে, ফাঁকা ৯১টি। ১৬টি আইসিইউ শয্যার সবকটিতে রোগী ভর্তি রয়েছে।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালের ২৫০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ১৫৭টিতে, ফাঁকা ৯৩টি। ১৫টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১২টিতে রোগী ভর্তি আছে। ফাঁকা তিনটি আইসিইউ।

রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড ১০ সরকারি হাসপাতালের ছয়টিতে আইসিইউ ফাঁকা নেই

শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ২৮টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ১৮টিতে, ফাঁকা ১০টি। আটটি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ছয়টিতেই রোগী ভর্তি। ফাঁকা দুটি আইসিইউ শয্যা।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড ইউনিটে ১০০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ৬৮টিতে, ফাঁকা ৩২টি শয্যা। হাসপাতালটিতে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই।

মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের ১০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে কোনো রোগী ভর্তি নেই। ফলে ১০টি শয্যাই ফাঁকা। এখানে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই।

সবমিলিয়ে ১০টি সরকারি হাসপাতালে দুই হাজার ৩৪৯টি সাধারণ শয্যার মধ্যে এক হাজার ৭১০টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। ফাঁকা আছে ৬৩৯টি শয্যা। মোট ৯৫টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ৯০টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। মাত্র পাঁচটি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা আছে।

বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি ও আইসিইউ শয্যার সর্বশেষ পরিসংখ্যান

আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৭০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ৫৩টিতে, ১১৭টি শয্যা ফাঁকা। এছাড়া ৩০টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ২২টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। ফাঁকা আছে আটটি আইসিইউ শয্যা।

আজগর আলী হাসপাতালের ১৬৮টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ৩৯টিতে। ফাঁকা ১২৯টি শয্যা। এছাড়া ৩২টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ২১টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে, ফাঁকা ১১টি শয্যা।

স্কয়ার হাসপাতালের ৬৫টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ৫৪টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে, মাত্র ১১টি শয্যা ফাঁকা। এ হাসপাতালের নয়টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে সাতটিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে, মাত্র দুটি শয্যা ফাঁকা।

ইবনে সিনা হাসপাতালের ২৬টি সাধারণ শয্যার সবকটিতেই রোগী ভর্তি আছেন। চারটি আইসিইউ শয্যার সবই পরিপূর্ণ।

বেসরকারি হাসপাতালের ৫৪০টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ২৯৮টিতে রোগী ভর্তি আছে

ইউনাইটেড হাসপাতালের ৮০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ৬০টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। মাত্র ২০টি শয্যা ফাঁকা। ২২টি আইসিইউ শয্যার ১৬টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। ছয়টি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা।

এভারকেয়ার হাসপাতালের ২৮টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ২৭টিতেই রোগী ভর্তি। মাত্র একটি বেড খালি। ১২টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১১টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। খালি মাত্র একটি আইসিইউ শয্যা।

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে আইসিইউ বেড কিছু ফাঁকা ছিল। এখন তা ফাঁকা নেই। বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের কাছে চাহিদা আসছে। আমরা বাধ্য হয়ে তাদের অপেক্ষায় রাখছি। আজ না কাল, কাল না পরশু— এমনটা বলছি। খালি হলে জরুরি বিবেচনায় নতুন কাউকে দেই

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক, পরিচালক, ঢামেক

ইমপালস হাসপাতালের ২৫০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ৭৮টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে, ফাঁকা ১৭২টি শয্যা। ৩৫টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ২৫টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। ১০টি আইসিইউ শয্যা খালি আছে।

এএমজেড হাসপাতালের ৯১টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ৭৬টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে, ফাঁকা ১৫টি শয্যা। ১০টি আইসিইউ শয্যার সবকটিতে রোগী ভর্তি রয়েছে।

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটালের ৩০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে অতিরিক্ত রোগীসহ মোট ভর্তি ৩৫ জন। ১৪টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে পাঁচটিতে রোগী ভর্তি রয়েছে। আইসিইউ শয্যা খালি রয়েছে নয়টি।

সবমিলিয়ে রাজধানীর নয়টি বেসরকারি হাসপাতালের মোট ৯০৮টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ৪৪৮টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে। ফাঁকা ৪৬০টি সাধারণ শয্যা। ২৬৩টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ২১১টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে। ফাঁকা ৫২টি আইসিইউ শয্যা।

সারাদেশের হাসপাতালগুলোর চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১০ হাজার ৪৫০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে মোট রোগী ভর্তি দুই হাজার ৮৪৫ জন। খালি আছে সাত হাজার ৬০৫টি সাধারণ শয্যা। মোট ৫৪০টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ২৯৮টিতেই রোগী ভর্তি। ফাঁকা রয়েছে ২৪২টি আইসিইউ শয্যা।

রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এখানে সবসময় রোগী বেশি থাকে। অন্যান্য সময়ের চেয়ে গত কয়েকদিন রোগীর সংখ্যা একটু বেশি মনে হচ্ছে। বেশিরভাগই জ্বর, সর্দি আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসছেন। আজ আউটডোরে গিয়ে দেখলাম বিভিন্ন ধরনের রোগীর দীর্ঘ লাইন। শুধু আউটডোরের রোগীর চাপ সামাল দিতে ডাক্তারদের দিনে এক থেকে দুই ঘণ্টা সময় বেশি দিতে হচ্ছে।

নতুন করে ৪/৫টি আইসিইউ বানানোর চেষ্টা চলছে। এক্ষেত্রে সমস্যা হলো দক্ষ জনবল। আইসিইউ বেড বাড়িয়ে লাভ নেই, যদি পরিচালনার লোক না থাকে। যদি দক্ষ চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলেই বেড বাড়ানো সম্ভব

ব্রি. জেনারেল জামিল আহমেদ, পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল

হঠাৎ রোগীর চাপ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাঝে যখন করোনার সংক্রমণের হার কমে গিয়েছিল, তখন হয়তো মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানতে শিথিলতা দেখিয়েছে। রোগীর সংখ্যা বাড়ার এটা একটা কারণ হতে পারে। এ সময় কোনোরকম স্বাস্থ্য সচেতনতা ছাড়াই লোকজন বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। ছুটিতে কক্সবাজারে কী পরিমাণ মানুষ গিয়েছে, আপনারা তা দেখেছেন। অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না, মাস্ক পরছেন না। এছাড়া করোনার নতুন ধরন খুব দ্রুত ছড়ায় বলে শোনা গেছে। সেটা সত্যি হলে, হঠাৎ সংক্রমণ বাড়ার এটাও কারণ হতে পারে।

স্বাস্থ্যবিধি মনে চলার বিকল্প এখন কিছু নেই, বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা   

আইসিইউ প্রসঙ্গে ঢামেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে আইসিইউ বেড কিছু ফাঁকা ছিল। এখন তা ফাঁকা নেই। বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের কাছে চাহিদা আসছে। আমরা বাধ্য হয়ে তাদের অপেক্ষায় রাখছি। আজ না কাল, কাল না পরশু— এমনটা বলছি। খালি হলে জরুরি বিবেচনায় নতুন কাউকে দেই।’

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে আমাদের ওপর চাপ যাচ্ছে। সারাদেশের মানুষ যেভাবে ড্যামকেয়ার মুডে চলাফেরা করছে, সংক্রমণ তো বাড়বেই। সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি কেউ মানছেনই না।

করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। যেসব দেশ স্বাস্থ্যবিধি মানেনি, সেসব দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেছে। আমাদের দেশে এখন কেউ মাস্ক পরতে চান না, স্বাস্থ্যবিধি মানতে চান না। এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন হতে হবে

ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ, অধ্যাপক, ইউজিসি

তিনি আরও বলেন, গত ১ মার্চ কুর্মিটোলা হাসপাতালে রোগী ছিল ১৪৬ জন। এখন তা ৩০০ ছাড়িয়েছে। ১০টি আইসিইউ শয্যা আছে। কিছুদিন আগেও বেশ কয়েকটি বেড খালি ছিল, এখন নেই। রোগী এসে ঘুরে যাচ্ছে।

আইসিইউ শয্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে কি না— জানতে চাইলে জামিল আহমেদ বলেন, ‘নতুন করে ৪/৫টি আইসিইউ বানানোর চেষ্টা চলছে। এক্ষেত্রে সমস্যা হলো দক্ষ জনবল। আইসিইউ বেড বাড়িয়ে লাভ নেই, যদি পরিচালনার লোক না থাকে। যদি দক্ষ চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলেই বেড বাড়ানো সম্ভব।’

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি’র অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। যেসব দেশ স্বাস্থ্যবিধি মানেনি, সেসব দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেছে। আমাদের দেশে এখন কেউ মাস্ক পরতে চান না, স্বাস্থ্যবিধি মানতে চান না। এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন হতে হবে।

করোনার চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা

কে চিকিৎসা দেবে এত মানুষকে, প্রশ্ন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর

দেশে হঠাৎ করেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি ও মৃত্যু নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সব দায়ভার আক্রান্তদের ওপরই চাপিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, দিন দিন মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান হচ্ছে। কেউই স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। করোনা তো বাড়বেই।

আমরা আগে থেকেই বলেছি, আমরা এখন জেনেশুনেই আক্রান্ত হচ্ছি। আমাদের নিজেদেরই সতর্ক হওয়া উচিত। তা না হলে পরে নিজের এবং পরিবারের ক্ষতি হবে

জাহিদ মালেক, মন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়

সম্প্রতি ঢাকা পোস্টকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। জাহিদ মালেক আরও বলেন, আমরা যদি এখনই সতর্ক না হই, স্বাস্থ্যবিধি না মানি, তাহলে আমাদের দেশের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। যা আমরা এখনও বুঝতে পারছি না। কারণ, আমাদের হাসপাতালগুলোতে তো লাখো মানুষের জায়গা হবে না। কোথায় চিকিৎসা হবে? কে চিকিৎসা দেবে এত মানুষকে?

তিনি আরও বলেন, আমরা আগে থেকেই বলেছি, আমরা এখন জেনেশুনেই আক্রান্ত হচ্ছি। আমাদের নিজেদেরই সতর্ক হওয়া উচিত। তা না হলে পরে নিজের এবং পরিবারের ক্ষতি হবে।

সাড়ে আট মাসে করোনায় সর্বোচ্চ শনাক্ত

গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন তিন হাজার ৫৫৪ জন। ফলে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৭৭ হাজার ২৪১ জনে। গত বছরের ২ জুলাইয়ের পর এটিই দেশে একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত। সেদিন আক্রান্ত হিসেবে দেশে শনাক্ত হয়েছিলেন চার হাজার ১৯ জন। এ সময় আক্রান্ত আরও ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৭৩৮ জনে।

আইসিইউ বেডের সংকট সর্বত্র। হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে গুরুতর রোগীদের 

মঙ্গলবার (২৩ মার্চ) স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। সোমবার (২২ মার্চ) করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন দুই হাজার ৮০৯ জন। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছিল ৩০ জনের। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনামুক্ত হয়েছেন এক হাজার ৮৩৫ জন। এখন পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন পাঁচ লাখ ২৫ হাজার ৯৯৪ জন। এ সময়ে ২৬ হাজার ৩৫৭ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পরীক্ষা করা হয়েছে ২৫ হাজার ৯৫৪টি নমুনা। মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৪৪ লাখ ৬০ হাজার ১৮৪টি। দেশে মোট ২১৯টি পরীক্ষাগারে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।

টিআই/এসএম/এমএআর/এমএমজে