অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম খান। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে তার নামও এসেছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠেছে / ঢাকা পোস্ট

ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইএইউ) উপাচার্য (ভিসি) হিসেবে টানা দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আহসান উল্লাহ (আহসান সাইয়েদ)। গত জানুয়ারিতে তার মেয়াদ শেষ হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় মেয়াদে কোনো উপাচার্য থাকার নজির না থাকায় নতুন ভিসি পেতে যাচ্ছে দেশের মাদ্রাসাগুলোর উচ্চশিক্ষা দেখভাল করা এ বিশ্ববিদ্যালয়।

এরই মধ্যে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদের জন্য নিয়োগ দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একাধিক শিক্ষকের নামের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়েছে। তাদের মধ্যে চৌর্যবৃত্তিতে অভিযুক্ত শিক্ষকের নামও রয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রথম সংস্করণে বাংলা ভাষার পাশাপাশি ফারসি ভাষায় ভূমিকা লেখা হয়। বইটির প্রকাশক মমতাজ বেগম তার স্বামী জেহাদুল ইসলামকে নিয়ে ‘অনুবাদক পরিচিতি’ শিরোনামে একটি লেখা লেখেন। কিন্তু ২০১১ সালে দ্বিতীয় সংস্করণে প্রকাশিত বইয়ে ওই দুটি লেখা বাদ দেওয়া হয়। বইটির প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় অনুবাদক ও সম্পাদক হিসেবে শুধু ড. সাইফুল ইসলাম খানের নাম লেখা হয়। কিন্তু প্রথম সংস্করণে সেখানে দুজনের নাম ছিল

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল কাদির, অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল মারুফ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রশীদ, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম খানের নাম আলোচনায় রয়েছে।

আরও পড়ুন >> ৯ লেখক ও ২ সম্পাদকের লেখা পাঠ্যবইয়ে ‘চৌর্যবৃত্তি’!

তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছেন প্লেজারিজম বা চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম খানের নাম। অন্যের বই নিজের নামে চালানো এবং গবেষণা প্রবন্ধে ৯৫ ভাগ চৌর্যবৃত্তির দুটা অভিযোগ রয়েছে এ অধ্যাপকের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ীও উপাচার্য হওয়ার অযোগ্য ঢাবির এ শিক্ষক।

অন্যের বই নিজের নামে চালানো এবং গবেষণা প্রবন্ধে ৯৫ ভাগ চৌর্যবৃত্তির দুটা অভিযোগ রয়েছে অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে / ঢাকা পোস্ট

জানা গেছে, ফারসি ভাষায় লিখিত ‘দিওয়ান-ই-মঈনুদ্দিন’ নামক গ্রন্থের অনুবাদের কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম খানের সহযোগিতা নেন জেহাদুল ইসলাম। অনুবাদ ও ব্যাখ্যা শেষে ২০০৩ সালে তার স্ত্রী মমতাজ বেগম বইটি প্রকাশ করেন। এতে অনুবাদকের বক্তব্য লেখেন জেহাদুল ইসলাম। কিন্তু গ্রন্থটি প্রকাশের আট বছরের মাথায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অধ্যাপক নিজের নামে প্রকাশ করেন বলে অভিযোগ ওঠে। 

জার্নালের ৭৭নং পৃষ্ঠার ৪-৫ লাইন ছাড়া সবটুকু প্রবন্ধ বিচিত্রার ৪৮নং পৃষ্ঠা থেকে কপি করা। এরপর ৭৮নং পৃষ্ঠা কপি করা হয়েছে ৪৯ ও ৫৬নং পৃষ্ঠা থেকে। সেখানে দেখা যায়, বাংলায় লেখা ‘শ্লোক বিচ্ছেদের অনলে সদা অঙ্গ জ্বলে, বিনয় করিগো প্রিয় আয় আয়রে’ পুরোটা ইংরেজি বর্ণে লেখা হয়েছে। ৭৯ পৃষ্ঠার লেখা ৫০,৫১ ও ৫৭নং পৃষ্ঠা থেকে কপি করা। এভাবে ৮০নং পৃষ্ঠাও মূল গ্রন্থের ৫৩ ও ৫৪নং পৃষ্ঠা থেকে নিয়েছেন অধ্যাপক ড. সাইফুল

বইটি সংগ্রহ করে জানা যায়, প্রথম সংস্করণে বাংলা ভাষার পাশাপাশি ফারসি ভাষায় ভূমিকা লেখা হয়। বইটির প্রকাশক মমতাজ বেগম তার স্বামী জেহাদুল ইসলামকে নিয়ে ‘অনুবাদক পরিচিতি’ শিরোনামে একটি লেখা লেখেন। কিন্তু ২০১১ সালে দ্বিতীয় সংস্করণে প্রকাশিত বইয়ে ওই দুটি লেখা বাদ দেওয়া হয়। বইটির প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় অনুবাদক ও সম্পাদক হিসেবে শুধু ড. সাইফুল ইসলাম খানের নাম লেখা হয়। কিন্তু প্রথম সংস্করণে সেখানে দুজনের নাম ছিল।

আরও পড়ুন >> গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি: সামিয়া রহমানসহ ৩ শিক্ষকের পদাবনতি

অপরদিকে, ঢাকা ইউনিভার্সিটি জার্নাল অব পারসিয়া অ্যান্ড উর্দু নামে বিভাগীয় গবেষণা জার্নালে ‘বাংলা কবিতায় ফারসি ভাবধারা’ শিরোনামে ফারসি ভাষায় একটি প্রবন্ধ লেখেন অধ্যাপক ড. সাইফুল। যা ১৯৯০ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত ‘প্রবন্ধ বিচিত্রা’ নামক গ্রন্থের ৪৮ থেকে ৬৩নং পৃষ্ঠায় বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ছৈয়দ আহমদুল হকের লেখার পুরোটা অনুবাদ।

জানা গেছে, জার্নালের ৭৭নং পৃষ্ঠার ৪-৫ লাইন ছাড়া সবটুকু প্রবন্ধ বিচিত্রার ৪৮নং পৃষ্ঠা থেকে কপি করা। এরপর ৭৮নং পৃষ্ঠা কপি করা হয়েছে ৪৯ ও ৫৬নং পৃষ্ঠা থেকে। সেখানে দেখা যায়, বাংলায় লেখা ‘শ্লোক বিচ্ছেদের অনলে সদা অঙ্গ জ্বলে, বিনয় করিগো প্রিয় আয় আয়রে’ পুরোটা ইংরেজি বর্ণে লেখা হয়েছে। ৭৯ পৃষ্ঠার লেখা ৫০,৫১ ও ৫৭নং পৃষ্ঠা থেকে কপি করা। এভাবে ৮০নং পৃষ্ঠাও মূল গ্রন্থের ৫৩ ও ৫৪নং পৃষ্ঠা থেকে নিয়েছেন অধ্যাপক ড. সাইফুল।

এছাড়া তিনি মাত্র তিন মাস নয় দিনে পিএইচডি করেছেন এবং যেদিন থিসিস জমা দিয়েছেন সেই দিনেই নিরীক্ষা হয়েছে এবং ওই দিনই ভাইভা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

আরও পড়ুন >> টার্নিটিন কি প্ল্যাজারিজম বা চৌর্যবৃত্তি শনাক্তকরণ টুল?

অভিযোগের বিষয়ে অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিষয়গুলো ভিত্তিহীন। আমার নতুন কোনো ইস্যু আসলে নতুন করে অভিযোগ ওঠে। এটা নিয়ে তদন্ত হয়েছে, কমিটি হয়েছে। এসব সত্য হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করতে পারতাম না। অতীতেও অনেকে ষড়যন্ত্র করেছে, কিন্তু সাদা সাদা রয়েছে। কালো কালোই রয়েছে।’

চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ অস্বীকার করে অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম খান বলেন, ‘বিষয়গুলো ভিত্তিহীন’ / ঢাকা পোস্ট

ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন যা বলছে 

ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১৩-তে বলা হয়েছে, ‘চ্যান্সেলর, আরবি বা ইসলামি শিক্ষা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি ডিগ্রিসহ শিক্ষকতা ও প্রশাসনিক কাজে অন্যূন ২০ (বিশ) বৎসরের বাস্তব কর্ম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অধ্যাপক পদমর্যাদার একজন শিক্ষাবিদকে চার বৎসর মেয়াদের জন্য ভাইস-চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ দান করিবেন।’

অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম খানের আরবি কিংবা ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি ডিগ্রি নেই বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে। এমন একজন শিক্ষককে উপাচার্য পদে নিয়োগ দিলে আইনের ব্যত্যয় ঘটবে এবং চৌর্যবৃত্তিতে অভিযুক্ত শিক্ষককে না দিয়ে যোগ্য কোনো শিক্ষককে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদে নিয়োগ দেওয়ার দাবি সংশ্লিষ্টদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে আরবি কিংবা ইসলামি শিক্ষা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর থাকতে হবে। সে অনুযায়ী ভিসি নিয়োগ দেওয়া উচিত। আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজে এমন যোগ্য শিক্ষকের কোনো অভাব নেই। এছাড়া চৌর্যবৃত্তির মতো অভিযোগে অভিযুক্ত কাউকে ভিসি নিয়োগ দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ক্ষুণ্ন হবে বলে আমি মনে করি।

আরও পড়ুন >> পাঠ্যবইয়ে কপি : স্বীকার করে জাফর ইকবাল ও হাসিনা খানের বিবৃতি

ড. সাইফুল ইসলাম খানের চৌর্যবৃত্তির বিরুদ্ধে উপাচার্য বরাবর অভিযোগকারী বিভাগের সাবেক শিক্ষক ড. আবু মুসা মো. আরিফ বিল্লাহ এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি অভিযোগ করছিলাম প্রায় সাত বছর আগে। প্রবন্ধ জালিয়াতির বিষয়ে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সিন্ডিকেটে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে অনিয়মের জন্যও ওই শিক্ষককে তিন বছরের জন্য এ সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান উপাচার্য ওই শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে তাকে একটি হলের প্রাধ্যক্ষের পদ দিয়েছেন। সাইফুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে আর কোনো তদন্ত বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ এবং ফাজিল (স্নাতক) ও কামিল (স্নাতকোত্তর) পর্যায়ের পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচির আধুনিকীকরণ ও উন্নতিসাধন, শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতা বৃদ্ধিসহ মাদ্রাসা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ন্যস্ত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। বর্তমানে এক হাজার ৩০০টিরও বেশি ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসার যাবতীয় কার্যক্রম তদারকি, শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষক নিয়োগ ও অনুমোদনের কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

অধ্যাপক মুহাম্মদ আহসান উল্লাহ দুই মেয়াদে টানা আট বছর পূর্ণ করে গত ৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নিয়েছেন। তিনিই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। পরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ফিরে গেছেন। বর্তমানে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন।

এইচআর/এমএআর/