কূটনীতিক থেকে ফরেন সার্ভিস একাডেমির প্রথম নারী রেক্টর
মাশফি বিনতে শামস। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্যে স্নাতক শেষে বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের সব ধাপ পার করে ১৯৯১ সালে পা রাখেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর অবসরোত্তর ছুটিতে থাকা এ কূটনীতিককে সম্প্রতি দুই বছরের জন্য চুক্তিতে ফরেন সার্ভিস একাডেমির রেক্টর করেছে সরকার। এর মধ্য দিয়ে মাশফির ক্যারিয়ারে যুক্ত হলো একাডেমির প্রথম নারী রেক্টরের তকমা।
কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ৩০ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে তাকে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। ২০১৫ সালে নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের সময় নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তাকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশিদের নিরাপদ আশ্রয় এবং দেশে ফেরত পাঠানো ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ। এছাড়া তিনি ২০২১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সফরের দেখভালের দায়িত্ব পালন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে।
বিজ্ঞাপন
পররাষ্ট্র ক্যাডারের নবম ব্যাচের কর্মকর্তা মাশফি ইংরেজি সাহিত্য বা আইন বিষয় নিয়ে পড়তে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু প্রকৌশলী বাবার আগ্রহে ভর্তি হন বুয়েটে। স্থাপত্যে স্নাতক অর্জন করেন। ব্যাচে চতুর্থ স্থান অর্জন করেও কেন কূটনীতিক অঙ্গনে পা রাখা— এমন প্রশ্নের জবাবে মাশফি বলেন, ‘বুয়েটে পড়েছি কিছুটা বাবার অনুপ্রেরণায়। আমি খুব আগ্রহী ছিলাম না। আগ্রহ ছিল ইংরেজি সাহিত্য বা আইন বিষয় নিয়ে পড়ার। বুয়েটে পড়েছি, পাস করেছি; তবে খুব বেশি উপভোগ করেছি বলব না। কারণ, এটা একটা সৃজনশীল বিষয়। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি অতটা সৃজনশীল না।’
কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ৩০ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে তাকে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। ২০১৫ সালে নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের সময় নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তাকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশিদের নিরাপদ আশ্রয় এবং দেশে ফেরত পাঠানো ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ
তিনি বলেন, ‘বাবার ইচ্ছা ছিল সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার। বাবা চাইতেন মেয়ে কূটনীতিক হোক। বিসিএস দিতে গিয়ে পছন্দের তালিকায় পররাষ্ট্র ক্যাডারটা রাখলাম। পরীক্ষা দিলাম। সব ধাপ পার করে শেষ পর্যন্ত যোগ দিলাম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।’
বাবার চাওয়াতে কূটনীতিক পেশায় পা রাখা হলেও মায়ের সমর্থনকে সবার ওপরে রাখছেন রেক্টর মাশফি। তার ভাষ্য, ‘পারিবারিক চাপের কারণে আমার মা খুব বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি। মা চাইতেন মেয়ে সর্বোচ্চ অর্জনটা করবে। এর জন্য যত ধরনের সমর্থন দরকার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। চাকরিতে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরই আমার সন্তান হয়। মায়ের সমর্থন না পেলে বিদেশে স্নাতকোত্তর করতে পারতাম না। তিনি আমার সঙ্গে বিদেশ গেলেন। আমার সন্তানকে শত ভাগ আগলে বড় করেছেন আমার মা, যেন আমার কোনো কষ্ট না হয়। মা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, বাবাও দিয়েছেন। আমার স্বামীর সাপোর্ট তো ছিলই।’
এক সময়ে মেয়েদের কূটনীতিক পেশায় যাওয়া আড়চোখে দেখা হতো, বিশেষ করে অনেক পুরুষ সহকর্মীরা বিষয়টিকে ভালোভাবে নিতে পারতেন না। ওই সময়ের চ্যালেঞ্জের কথা জানতে চাইলে ৩০ বছর আগের স্মৃতি হাতড়ে মাশফি বলেন, ‘কূটনীতিক হিসেবে এখন অনেকেই আসছেন। আমি যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিই, এর আগে মাত্র চারজন নারী কূটনীতিক হিসেবে কাজ করছিলেন। অনেক পুরুষ কলিগ আমাদের নিরুৎসাহিত করেছেন। তারা বলতেন, কেন আসছ তোমরা এখানে? কেন ভুল সিদ্ধান্ত নিতে গেলে, ভুল জায়গায় আসছ। আমাদের নারী হিসেবে ট্রিট করত, একজন অফিসার হিসেবে নয়।’
পুরুষ সহকর্মীদের এমন আচরণে তখনকার নারী কূটনীতিকরা নিজেদের প্রমাণ করতে তুলনামূলক বেশি কাজ করতেন বলে জানান রেক্টর মাশফি। তার ভাষায়, আমাদের প্রথম দিককার তিন থেকে চারজন যারা কূটনীতিক পেশায় এসেছিলেন, তাদের চ্যালেঞ্জটা ছিল বেশি। আমরা কিন্তু ওনাদের অনুসরণ বা তৈরি করা পথ ধরে সামনে এগোতে সাহস পেয়েছি। ওনাদের তৈরি করা পথেই চলতে হয়েছে আমাদের। নারী কূটনীতিকদের অনেক বেশি কাজ করে নিজেদের প্রমাণ করতে হয়েছে।’
কূটনীতিক হিসেবে ১৯৯৫ সালে বিদেশের মাটিতে প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে ইতালির রোমে বদলি করা হয় মাশফিকে। পেশাগত কারণে তখন স্বামীকে ছাড়াই কাজে যোগ দিতে হয় এ কূটনীতিককে। তবে, সঙ্গী হিসেবে তখন পাশে ছিলেন বাবা-মা আর ছোট সন্তান। ছোট বাচ্চাকে নিয়ে রোমে দেশের হয়ে কাজ করতে হয়েছিল।
বুয়েট থেকে স্থাপত্যে স্নাতক অর্জন করা মাশফি পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি রোম ছাড়াও ব্যাংককে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কূটনীতিক হিসেবে মাশফির চাকরির বড় সময় কেটেছে দক্ষিণ এশিয়াকে কেন্দ্র করে, বিশেষ করে ভারতে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক থেকে শুরু করে দিল্লি হাইকমিশনের একাধিক পদে দায়িত্ব পালনের পর ঢাকায় ফিরে দক্ষিণ এশিয়ার মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এক দশকের বেশি সময় প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কাজে যুক্ত থাকার সুবাদে ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক ‘স্থলসীমান্ত চুক্তি’ বাস্তবায়নে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
জানতে চাইলে মাশফি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া আমাদের মন্ত্রণালয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ডেস্ক। দিল্লিতে সাড়ে ছয় বছর কাটিয়েছি। ২০০৪ বা ২০০৫ সালের দিকে ওখানে দায়িত্ব পালন করাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অন্য মাত্রা পেল। তখন আমরা স্থল সীমানা নিয়ে কাজ শুরু করি। এর মধ্যে দেশে ফিরে দক্ষিণ এশিয়ার মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করি।’
‘যেখানে যেখানে আমাদের ছিটমহল ছিল, প্রতিটি জায়গায় আমরা হেঁটে হেঁটে কাজ করেছি। যত জায়গায় সমস্যা ছিল, প্রত্যেকটা জায়গার সমাধান করেছি আলোচনার মাধ্যমে। এটা বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের জন্য উত্তম উদাহরণ হতে পারে। তখন খুবই সুন্দর একটা টিম ওয়ার্ক করে ডায়লগের মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছাতে পেরেছি।’
দেশের সাধারণ মানুষ বলে থাকেন, ভারতকে যে পরিমাণে দেওয়া হচ্ছে তার চেয়ে পরিমাণে কম পেয়েছে বাংলাদেশ— এ বিষয়ে মাশফির কাছে জানতে চাওয়া হলে সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘আমিও মোটেও এটাকে ওভাবে দেখি না। কারণ, আমরা তো ভারত থেকে অনেক কিছু পাচ্ছি। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত আমাদের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য, প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি।’
২০১৩ সালের মে মাসে নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পান মাশফি। ২০২০ সালের অগাস্ট পর্যন্ত নেপালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। সাড়ে ছয় বছরের বেশি সময় কাঠমান্ডুতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দুবার কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি।
২০১৫ সালে নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের সময় নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তাকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশিদের নিরাপদ আশ্রয়, খাবার ব্যবস্থা, দেশে ফেরত পাঠানো এবং বিপদে পড়া নেপালের পাশে দাঁড়ানোর মূল কাণ্ডারির দায়িত্বে ছিলেন মাশফি। সেই সময়কার কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই কিছুটা সময় চুপ থেকে তিনি বলেন, ‘নেপালের ভূমিকম্পে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দূতাবাসের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তখন এপ্রিল মাস। ২০১৫ সালের কথা। ওই ভূমিকম্পে নেপালে প্রায় ১০ হাজার লোক মারা যায়। আমাদের পরিবার ও নিজেকে নিয়ে একটা ভয় ছিল। ভয়টাকে চাপা দিয়ে, নিজের নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশিদের কথা চিন্তা করতে হয়েছে।’
‘বাংলাদেশিদের উদ্ধার করতে হয়েছে, তখন নেপালে অনেক বাংলাদেশি টুরিস্ট ছিলেন। কে কোথায় আছেন, তাদের খুঁজে বের করে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া, দেশে পাঠানো, খাবার ব্যবস্থা, নিরাপত্তা— সব দেখতে হয়েছে। ওটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তারপর নেপালিদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের কিছুই ছিল না। আমরা যা যেখান থেকে পেয়েছি, কোনো স্বার্থ ছাড়াই তাদের দিয়েছি।’
‘বাংলাদেশ যখন দেয়, নিঃস্বার্থভাবে দেয়; কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে করে না’— বলেন রেক্টর মাশফি।
নেপালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব সামলে সচিব হিসেবে সদরদপ্তরে ফেরার পর ২০২১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সফরের দেখভালের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল তাকে। ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে এমন দায়িত্ব পাওয়াকে সৌভাগ্য হিসেবেই দেখছেন তিনি।
তার ভাষ্য, ‘আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে আমার ক্যারিয়ারের শেষে এমন একটা দায়িত্ব পেয়েছি। এটা একটা বিরাট পাওয়া। পাঁচ দেশের সরকারপ্রধান এসে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান, সলিডারিটি এবং আমাদের ৫০ বছর পূর্তিকে স্বাগত জানানো— এটা কিন্তু ছোটখাটো বিষয় নয়। এটা আমাদের জন্য বড় পাওয়া যে ওনাদের একসঙ্গে নিয়ে আসতে পেরেছি।’
সৎ ও দক্ষ অফিসার হিসেবে সাউথ এশিয়ার এক্সপার্ট মাশফির বেশ সুনাম রয়েছে। দায়িত্ব পালনকালে দেশের স্বার্থ আগে দেখেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে কিছুটা বিব্রত হন তিনি। বলেন, ‘আমি সবসময় চেয়েছি, দেশের আগ্রহের বিষয়টা ধরে রাখতে। দেশের লাভের পরিমাণ বাড়াতে আর ক্ষতির পরিমাণ কমাতে। তাই বলে আমি কারও সঙ্গে আলাপে বসব না বা দর কষাকষিতে যাব না; সেটা নয়। আমি সবসময় যেটা সঠিক মনে করেছি, তা নোট করে দিয়েছি। নীতিনির্ধারকদের আমার মতামত সমর্থন করা বা না করা ছিল তাদের বিষয়।’
কূটনীতিক হিসেবে অপূর্ণতার প্রশ্নে এক গাল হেসে রেক্টর মাশফি বলেন, ‘আমি হয়তো বা আরও দু-একটা জায়গায় কাজ করতে পারতাম। ওই জায়গায় হয়তো কোনো কারণে সুযোগ হয়নি। সেটা হয়তো আমার চাওয়ার জায়গা রয়ে গেল। আমি মনে করি, মানুষের জীবনে আফসোস করার কিছু নাই। যতটুকু পাচ্ছি, সেটাকে বড় করে দেখা উচিত।’
ফরেন সার্ভিস একাডেমির রেক্টর হিসেবে চিন্তাভাবনা কী— জানতে চাইলে মাশফি বলেন, ‘একাডেমির জন্য নতুন কিছু করতে চাই। আমাদের এখানে অনেক নতুন নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো ভালোভাবে যেন হয়; তার জন্য কাজ করছি। কিছু পরিকল্পনা আছে, সেগুলো বাস্তবে রূপ দিতে চাই।’
এনআই/ওএফ