মৃত্যুপথযাত্রী নির্বাচনী জোট, ব্যতিক্রম বাম
নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক জোট গঠন বাংলাদেশে নতুন নয়। সেই আশির দশক থেকে জোট রাজনীতির সূচনা। এরই ধারাবাহিকতায় গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে বেশ কয়েকটি জোট হয়। কিন্তু নির্বাচন শেষে ‘লক্ষ্য-উদ্দেশ্যহীন-স্বার্থ’ কেন্দ্রিক গঠিত জোটগুলো চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে না পেরে ভেঙে যায় অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক দলগুলোর মধ্যে অনেক চাওয়া-পাওয়া তৈরি হয়। দলগুলোর মধ্যে জোটবদ্ধ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জন্মে। চাওয়া-পাওয়া থাকায় এসব জোটের মধ্যে কোনো নীতিগত আদর্শ বা লক্ষ্য থাকে না। একমাত্র লক্ষ্য রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া। নির্বাচনের পরে হিসাব না মিললে জোটগুলোর কার্যক্রম নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এর ব্যতিক্রমও ঘটে। নির্বাচনের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় বসতে যখন অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, তখন জোট গঠনের হিড়িক পড়ে।
বিজ্ঞাপন
একাদশ সংসদ নির্বাচনের (২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর) আগে ছয়টি রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়। এগুলো হলো- ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট, বামগণতান্ত্রিক জোট, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট, মিসবাহুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স, নাজমুল হুদার নেতৃত্বে জাতীয় জোট (বিএনএ) গঠিত হয়। এর বাইরে আটটি জোটের অস্তিত্ব রয়েছে। এগুলো বিভিন্ন সময় গঠিত হয়।
নির্বাচনী হালুয়া-রুটি ভাগের আসায় কর্মী-সংগঠনবিহীন ব্যক্তিরা বড় দলগুলোর সঙ্গে জোট করে। নির্বাচন শেষে ওই জোটের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়। কারণ, এসব জোটের কোনো আদর্শ বা লক্ষ্য থাকে না
বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন
এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট, বাম মোর্চা, সিপিবি-বাসদ জোট, মো. জাকির হোসেনের নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল জোট, শেখ ছালাউদ্দিন ছালুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, আলমগীর মজুমদারের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক জোট রয়েছে। এছাড়া এরশাদের নেতৃত্বে সম্মিলিত জাতীয় জোটও হয়েছিল।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক জোট গঠন পাকিস্তান আমল থেকে হয়ে আসছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম জোটরাজনীতির সূচনা হয় আশির দশকের গোড়ার দিকে। নির্বাচনী হালুয়া-রুটি ভাগের আসায় কর্মী-সংগঠনবিহীন ব্যক্তিরা বড় দলগুলোর সঙ্গে জোট করে। নির্বাচন শেষে ওই জোটের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়। কারণ, এসব জোটের কোনো আদর্শ বা লক্ষ্য থাকে না।’
‘রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার জন্য মূলত জোট গঠন’— উল্লেখ করে বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, ‘১৯৯১ সালের নির্বাচনে সবগুলো দল আলাদাভাবে অংশ নেয়। কিন্তু বিএনপি সরকার গঠন করতে গিয়ে জামায়াতের সমর্থন নেয়। ১৯৯৬ সালে একই কাজ করে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও জাতীয় পার্টির সহায়তা ছাড়া সরকার গঠন সম্ভব ছিল না তাদের। পরে এরশাদের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় বসে তারা।’
উভয়পক্ষ প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে তাদের সঙ্গে অনেক রাজনৈতিক দল আছে। আর জোট থাকলে নেতাকর্মীদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব থাকে
অধ্যাপক জিনাত হুদা, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিনাত হুদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভোটের রাজনীতিতে জোট কোনো প্রভাব ফেলে না। জোটের গঠন বিষয়টি প্রতীকী ও মনস্তাত্ত্বিক।’
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জোট গঠনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘উভয়পক্ষ প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে তাদের সঙ্গে অনেক রাজনৈতিক দল আছে। আর জোট থাকলে নেতাকর্মীদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব থাকে।’
মৃত জোট বিএনএ
বিএনপির সাবেক নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে গঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ)। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগত নির্বাচনে অংশ নেয় তারা। নাজমুল হুদা ঢাকা- ১৭ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। যদিও তাকে মনোনয়ন দেয়নি দলটি। বর্তমানে জোটটি মৃত। এ অবস্থার জন্য বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে দায়ী করেন তারা।
‘তৃণমূল বিএনপি’র চেয়ারম্যান নাজমুল হুদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জোটের মৃত্যু বা অস্তিত্ব নেই— এটা ঠিক এভাবে বলা যাবে না। মূলত জোটের পক্ষে সেই রকম কোনো কর্মসূচি নেওয়া হয়নি। আসলে ত্রাণ দেওয়ার মতো কর্মসূচি নির্ভর করে অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর। আমাদের জোটের তো সেই অবস্থা নেই। এছাড়া রাজনীতি তো এখন নেই, কাজেই রাজনৈতিকভাবে আলোচনা করারও সুযোগ নেই। যে কারণে সারাদেশের রাজনীতি স্থবির, আমাদের রাজনীতিও স্থবির।’
আসলে ত্রাণ দেওয়ার মতো কর্মসূচি নির্ভর করে অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর। আমাদের জোটের তো সেই অবস্থা নেই। এছাড়া রাজনীতি তো এখন নেই, কাজেই রাজনৈতিকভাবে আলোচনা করারও সুযোগ নেই
ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, চেয়ারম্যান, তৃণমূল বিএনপি
‘জোটের রাজনীতি একটু অন্য রকম হয়’— উল্লেখ করে সাবেক বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ১৪ দলীয় জোটের কি কর্মসূচি আছে? তাদেরও তো তৎপরতা নেই। আমার কাছে যেটা মনে হয়, একক দলগুলো নিজেদের আরও শক্তিশালী করার পর্যায়ে আছে। আমিও আমার দল তৃণমূল বিএনপিকে শক্তিশালী করার পর্যায়ে আছি। আওয়ামী লীগ যেমন সার্বিকভাবে তার দলকে শক্তিশালী করা নিয়ে ব্যস্ত, বিএনপিও ঠিক একইভাবে নিজেকে নিয়ে ভাবছে। তারা ২০ দলীয় জোট বা ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে ভাবে না। আওয়ামী লীগও ১৪ দলীয় জোট বা অন্যদের নিয়ে ভাবে না। যে কারণে জোটগত কর্মসূচি খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না।’
রাজনৈতিক কর্মসূচি দিলে লাভ কী— এমন প্রশ্ন তুলে সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদা বলেন, ‘সবাই তো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ভোটাধিকার রক্ষা ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলবে। কিন্তু এগুলো বলার সুযোগ কি এখন আছে? এখন একটাই রাজনীতি, উন্নয়নের রাজনীতি। এই উন্নয়নের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ তার নিজের রাজনীতি প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে। অন্য দলগুলো সেই সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ, তারা তো উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়।’
ভেঙে গেছে যুক্তফ্রন্ট
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারাকে নিয়ে বিএনপির জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের কথা ছিল। কিন্তু আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জটিলতা দেখে দিলে বিকল্পধারাকে বাদ দেওয়া হয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে। পরবর্তীতে বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগত নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচিত হন বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান (লক্ষ্মীপুর- ৪), যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী (মুন্সীগঞ্জ- ১)। কিন্তু জোটের অন্য শরিকরা কিছুই পায়নি। ফলে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে না পেরে নির্বাচনের পরই জোটের কার্যক্রম ‘নাই’ হয়ে যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ভাঙনের ঘোষণা না এলেও বেরিয়ে গেছে কয়েকটি দল।
নির্বাচনে পর জোটের পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করতে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিকল্পধারাকে। কিন্তু তারা সেটা করতে ব্যর্থ হয়। ফলে আমরা জোট থেকে বেরিয়ে আসি। এখন যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই
গোলাম মোস্তাফা, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাপ
যুক্তফ্রন্টের দলগুলো হলো- বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বিএলডিপি (সভাপতি নাজিম উদ্দিন আল আজাদ), বাংলাদেশ ন্যাপ (সভাপতি জেবেল রহমান গানি), এনডিপি (চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা), জাতীয় জনতা পার্টি (সভাপতি শেখ আসাদুজ্জামান), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (সভাপতি অধ্যক্ষ মতিন), গণসাংস্কৃতিক দল (সভাপতি সর্দার শামস আল মামুন), বাংলাদেশ জনতা লীগ (সভাপতি ওসমান গণি বেলাল), বাংলাদেশ শরিয়া আন্দোলন (সভাপতি মাসুম বিল্লাহ), বাংলাদেশ লেবার পার্টি ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট।
জোটের শরিক বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তাফা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নির্বাচনে পর জোটের পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করতে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিকল্পধারাকে। কিন্তু তারা সেটা করতে ব্যর্থ হয়। ফলে আমরা জোট থেকে বেরিয়ে আসি। এখন যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’
জোটের আরেক শরিক বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রধান আবু লায়েস মুন্না ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একটা পরিস্থিতির কারণে আমরা নির্বাচনের আগে যুক্তফ্রন্টে গিয়েছিলাম। এখন জোটের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
করোনাভাইরাসের কারণে আপাতত জোটের কোনো কর্মসূচি নেই। এখন কেউ চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে না পেরে জোট থেকে বেরিয়ে গেলে কিছুই করার নেই
শমসের মবিন চৌধুরী, প্রেসিডিয়াম সদস্য, বিকল্পধারা বাংলাদেশ
বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য শমসের মবিন চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে আপাতত জোটের কোনো কর্মসূচি নেই। এখন কেউ চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে না পেরে জোট থেকে বেরিয়ে গেলে কিছুই করার নেই। সব চাওয়া-পাওয়া তো পূরণ করা সম্ভব নয়। যাদের চাওয়া পূর্ণ হবে না, তাদের মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক।’
দিবসভিত্তিক ভার্চুয়াল সভায় সীমাবদ্ধ ১৪ দলীয় জোট
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন এক দশকের পুরানো ১৪ দলীয় জোট এখন দিবসভিত্তিক ভার্চুয়াল আলোচনায় সীমাবদ্ধ। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে জোটের শরিকদের কাউকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। মূলত এ ইস্যুতে জোটের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।
জোটের নেতারা বলছেন, ১৪ দলীয় জোটের কার্যক্রম স্থবির হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগই দায়ী। কারণ, আওয়ামী লীগ জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিলেও সরকার গঠন করে এককভাবে। জোটের শরিকরা এটা ভালোভাবে নেয়নি। ফলে এখন জোট নিয়ে শরিকদের আগ্রহ কম। তাই বিজয় দিবস, স্বাধীনতার দিবসসহ অন্যান্য দিবসভিত্তিক কর্মসূচিতে আটকে গেছে জোটের কার্যক্রম। করোনাকালে ১৪ দলীয় জোটের একমাত্র কার্যক্রম ছিল বিজয় দিবসের ভার্চুয়াল আলোচনা সভা।
অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো কার্যক্রম নেই। শুধুমাত্র বামপন্থী দলগুলো ইস্যুভিত্তিক কিছু কর্মসূচি পালন করছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ বা দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির প্রতিবাদে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। এখন আমরা যেহেতু সরকারি দলের জোটের শরিক, চাইলেও এসব ইস্যুতে আমরা রাস্তায় নামতে পারি না
ব্যারিস্টার আরশ আলী, সভাপতি, গণতন্ত্রী পার্টি
জোটের শরিক গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি ব্যারিস্টার আরশ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার কারণে জোটের কার্যক্রম নাই, এটা ঠিক। সর্বশেষ গত বছর বিজয় দিবসে জোটের ভার্চুয়াল সভা হয়েছিল।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো কার্যক্রম নেই। শুধুমাত্র বামপন্থী দলগুলো ইস্যুভিত্তিক কিছু কর্মসূচি পালন করছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ বা দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির প্রতিবাদে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। এখন আমরা যেহেতু সরকারি দলের জোটের শরিক, চাইলেও এসব ইস্যুতে আমরা রাস্তায় নামতে পারি না।’
ভাঙন ঠেকাতে ব্যস্ত ঐক্যফ্রন্টের শরিকরা
নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া নিয়ে গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। জোটবদ্ধভাবে ৩০০ আসনের নির্বাচনেও অংশ নেয় তারা। মাত্র সাত আসনে জয় পান জোটের প্রার্থীরা। ৩০ ডিসেম্বর রাতেই ভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ না নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান জোটের শীর্ষনেতারা। কিন্তু সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রথম সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন গণফোরাম থেকে নির্বাচিত সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। যদিও পরবর্তীতে নানা নাটকের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া অন্য সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন। এরপরই জোট থেকে বেরিয়ে যায় কাদের সিদ্দিকীর দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগে থেকেই কোনো কর্মসূচি ছিল না ঐক্যফ্রন্টের। করোনার মধ্যে জোটের তেমন কার্যক্রমও ছিল না। কিন্তু দলীয় উদ্যোগে জোটের শরিকরা পৃথকভাবে ত্রাণকার্যক্রম পরিচালনা করে। করোনার আগে এবং করোনার মধ্যেই জোটের দুই শরিক জেএসডি ও গণফোরামে ভাঙন দেখা দেয়। এর মধ্যে জেএসডি ভেঙে দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। আর গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন দলের ভাঙন ঠেকাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও দলটি বর্তমান সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়া এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফা মহসিন মন্টুর নেতৃত্বে দুভাবে বিভক্ত।
করোনা আসার পর থেকে জোটের বড় দুই নেতা ঘর থেকেই বের হন নাই। তাহলে কীভাবে জোটের কর্মসূচি থাকবে? বর্তমানে ঐক্যফ্রন্ট হিমঘরে পৌঁছে গেছে
মাহমুদুর রহমান মান্না, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রতি ইঙ্গিত করে জোটের শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘করোনা আসার পর থেকে জোটের বড় দুই নেতা ঘর থেকেই বের হন নাই। তাহলে কীভাবে জোটের কর্মসূচি থাকবে? বর্তমানে ঐক্যফ্রন্ট হিমঘরে পৌঁছে গেছে। তবে আশা করি জোট আবারও সক্রিয় হবে।’
তিনি আরও বলেন, অবৈধভাবে ক্ষমতায় বসে থাকা সরকারকে হটাতে হলে বৃহত্তর আন্দোলনের বিকল্প নাই। সেজন্য আরও বৃহত্তর জোট প্রয়োজন। আমরা সেদিকে নজর দিচ্ছি।
জোট থেকে দল হয়েছে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স
একাদশ নির্বাচনের আগে নামসর্বস্ব ১৫টি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল মিলে গঠিত হয় ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স জোট। নির্বাচনে জোটটি আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়। কিন্তু নির্বাচনের পর জোট গঠনের পাঁচ মাসের মাথায় এটি ভেঙে যায় এবং জোটের আট দল মিলে একটি দল গঠন করে। সেটি হচ্ছে ইসলামিক গণতান্ত্রিক পার্টি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলটির বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। নেই সাংগঠনিক কোনো কার্যক্রমও। তবে সরকার ঘেঁষা দলটির চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়ালকে বিভিন্ন ইস্যুতে বক্তব্য-বিবৃতি দিতে দেখা যায়।
এম এ আউয়াল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের জোট ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। তবে জোটের মধ্যে থাকা সবগুলো দল মিলে একটি দল করা হয়েছে। বর্তমানে দলের জেলা কমিটি গঠনের কাজ চলছে। এরপরই রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করব।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ইসলামিক গণতান্ত্রিক পার্টি বছরব্যাপী কর্মসূচি পালন করবে বলে উল্লেখ করেন আউয়াল। বলেন, এ মাসের শেষের দিকে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে কর্মসূচির ঘোষণা দেব।
ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচিতে সক্রিয় বাম জোট
নির্বাচনী জোটগুলোর মধ্যে এখনও মাঠের রাজনীতিতে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। বিভিন্ন জনদাবিতে এ জোটের পক্ষ থেকে মানববন্ধন, বিক্ষোভ-প্রতিবাদ, হরতাল এবং গণশুনানির মতো কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এ জোটের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা টানাপোড়েনের খবর পাওয়া যায়নি।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন মিলে গঠিত হয় বাম গণতান্ত্রিক জোট। জোটের ব্যানারে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় তারা। যদিও জোটের কোনো প্রার্থী নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি।
জোটের নেতারা বলছেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বাম জোটই প্রথম নির্বাচনের কারচুপির ওপর গণশুনানি করে এবং পুনর্নির্বাচনের দাবিতে আলোচনা সভাও করে। এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে হরতাল, কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি, ধর্ষণ-হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন জনদাবিতে ধারাবাহিকভাবে নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করে আসছে। সর্বশেষ নির্বাচনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
তেল-গ্যাস,বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বাম জোটই হরতাল পালন করেছে। আমাদের জোটের ভেতরে কোনো সমস্যা নাই
সাইফুল হক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাম জোট তাদের সাংগঠনিক শক্তির ভিত্তিতে অব্যাহতভাবে কর্মসূচি দিয়ে আসছে। জনগুরুত্ব ইস্যু থেকে শুরু করে ভোট ডাকাতির নির্বাচন বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছে। আগামীতেও কর্মসূচি দেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, তেল-গ্যাস,বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বাম জোটই হরতাল পালন করেছে। আমাদের জোটের ভেতরে কোনো সমস্যা নাই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় গঠন হওয়া বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট, বাম মোর্চা, সিপিবি-বাসদ জোটগুলো অনেকটা নিষ্ক্রিয়। যদিও একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির সংসদ সদস্যরা শপথ নেওয়াকে কেন্দ্র করে ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যায় দীর্ঘদিনের সঙ্গী আন্দালিব রহমান পার্থের দল বিজেপি। আর মো. জাকির হোসেনের নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল জোট, শেখ ছালাউদ্দিন ছালুর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, আলমগীর মজুমদারের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক জোট এবং এরশাদের নেতৃত্বে সম্মিলিত জাতীয় জোটের এখন কোনো অস্তিত্ব নেই।
এএইচআর/এমএআর/