কথা বেশি বললে নেওয়া হয় টর্চার সেলে
চিকিৎসা নিতে হয় বছরের পর বছর। সুস্থ হলেও অসুস্থ বানিয়ে টাকা নেওয়া হয়। দেখা করতে দেওয়া হয় না পরিবারের সঙ্গে। মুখ খুললেই চলে অমানবিক নির্যাতন। কখনও লাঠি দিয়ে, কখনও রড দিয়ে। আলাদা টর্চার সেলে নিয়ে পেটানো হয় ‘কথা বেশি বলা’ রোগীদের। টর্চারের জন্য আছে আলাদা ‘টর্চার টিম’।
এসব অভিযোগ রাজধানীর মালিবাগে অবস্থিত হলি লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। ২০০৩ সাল থেকে চারটি ফ্লোর নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে কেন্দ্রটি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সনদ নিয়ে পরিচালিত রিহ্যাবিলিটেশন (রিহ্যাব) সেন্টারটির যাত্রার শুরুতেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। ২০০৪ সালে একজন মারা যাওয়ার ঘটনায় মামলা পর্যন্ত হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ চলতি বছরের ২ মার্চ রিহ্যাব সেন্টারটিতে ইয়াসিন মিয়া (১৯) নামের এক যুবকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। এ ঘটনা নিয়ে আবারও বিতর্ক শুরু হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম নিয়ে। পরিবারের অভিযোগ, নির্যাতন করে ইয়াসিনকে হত্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে কর্তৃপক্ষের দাবি, ইয়াসিন আত্মহত্যা করেছে
সর্বশেষ চলতি বছরের ২ মার্চ রিহ্যাব সেন্টারটিতে ইয়াসিন মিয়া (১৯) নামের এক যুবকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। এ ঘটনা নিয়ে আবারও বিতর্ক শুরু হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম নিয়ে। পরিবারের অভিযোগ, নির্যাতন করে ইয়াসিনকে হত্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে কর্তৃপক্ষের দাবি, ইয়াসিন আত্মহত্যা করেছে।
ওই ঘটনার পর হলি লাইফে ‘টর্চার সেল’ ও ‘টর্চার টিম’ রয়েছে বলে আবারও অভিযোগ ওঠে। বলা হয়, অধিক আয়ের আশায় সেখানে ভর্তি হওয়া মাদকাসক্তদের কোনো ধরনের নিয়মনীতি ছাড়াই বছরের পর বছর আটকে রাখছে। কাউকে সাত বছর, কাউকে তিন বছর। দেখা করতে দেওয়া হয় না পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানটির এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে ভুক্তভোগীদের টর্চার সেলে নিয়ে করা হয় অমানবিক নির্যাতন।
হলি লাইফে কয়েক বছর ধরে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তাদের কাছ থেকে রিহ্যাব সেন্টারটিতে চলা এসব অনিয়ম ও নির্যাতনের কথা জানা যায়।
সাত থেকে আটজনের একটি গ্রুপ রয়েছে হলি লাইফের। যারা প্রতিষ্ঠানটির টর্চার সেল পরিচালনা করে। এ টিমের সদস্যদের চেহারা এত ভয়ংকর ও বীভৎস যে, কেউ দেখলেই ভয় পেয়ে যাবেন। আমি একদিন তাদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করি। ওইদিন রাতেই এ টিমের সদস্যরা আমাকে টর্চার সেলে নিয়ে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলে। টানা চারদিন ও চার রাত টিমের সদস্যরা লোহার রড দিয়ে আমাকে পেটায়
অভিযোগ ভুক্তভোগীর
ভুক্তভোগীরা ঢাকা পোস্টকে জানান, মালিবাগে একটি বিল্ডিংয়ের চারটি ফ্লোরে কার্যক্রম পরিচালনা করে হলি লাইফ। নিচতলায় অফিস ফ্লোর, মাঝের দুটি তলায় রোগীদের রাখার ওয়ার্ড ও টর্চার সেল এবং ওপরের তলায় ওষুধ রাখার কক্ষ, রান্নাঘর ও নামাজ পড়ার জায়গা। রিহ্যাব সেন্টারটিতে ৪০ রোগীকে রাখার অনুমোদন থাকলেও কর্তৃপক্ষ ১৫০ রোগীকে এখানে অবৈধভাবে রেখেছেন। ফলে প্রতিটি রুমে ৪-৫ জন রোগীকে গাদাগাদি করে থাকতে হয়।
হলি লাইফের টর্চার সেল
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী ঢাকা পোস্টকে জানান, অবাধ্য রোগীদের নির্যাতন করতে হলি লাইফে রয়েছে একাধিক ‘টর্চার সেল’। এসব টর্চার সেল জেল-হাজতের মতো লোহার রড দিয়ে বানানো। প্রতিটি টর্চার সেলে দুটি করে বেড রয়েছে। যেখানে একসঙ্গে দুজন রোগীকে হাত-পায়ে শিকল বেঁধে রাখা হয় ৩-৪ দিন। এ সময় রোগীদের ওপর চলে দুর্বিষহ নির্যাতন। রোগীর ওপর কর্তৃপক্ষ যদি বেশি ক্ষিপ্ত হয় তাহলে টানা চারদিন লোহার শিকল দিয়ে হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে চালানো হয় নির্যাতন।
আছে টর্চার টিমও
রিহ্যাব সেন্টারটি পরিদর্শনকালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের কাছে যদি কোনো রোগী প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন তাহলে তাকে টার্গেট করা হয়। কর্মকর্তারা চলে যাওয়ার পর অভিযোগ করা রোগীদের রাতে টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে টর্চার টিমের সদস্যরা লোহার রডের রোল দিয়ে টানা চারদিন পাশবিক নির্যাতন চালান। রোলের একেকটি আঘাতে শরীরের চামড়া পর্যন্ত উঠে আসে বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।
এখন পর্যন্ত নয়টি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের লাইসেন্স বাতিল করেছি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে তদন্ত করে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিছু কিছু জায়গায় সীমাবদ্ধতার কারণে অসংগতি রয়েছে। তবে অধিকাংশ মাদক নিরাময় কেন্দ্র সঠিকভাবে চলছে। আমরা নিয়মিত কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করছি
মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার, মহাপরিচালক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর
নোয়াখালীর এক ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাত থেকে আটজনের একটি গ্রুপ রয়েছে হলি লাইফের। যারা প্রতিষ্ঠানটির টর্চার সেল পরিচালনা করে। এ টিমের সদস্যদের চেহারা এত ভয়ংকর ও বীভৎস যে, কেউ দেখলেই ভয় পেয়ে যাবেন। আমি একদিন তাদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করি। ওইদিন রাতেই এ টিমের সদস্যরা আমাকে টর্চার সেলে নিয়ে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলে। টানা চারদিন ও চার রাত টিমের সদস্যরা লোহার রড দিয়ে আমাকে পেটায়।
‘আমি মা-গো, বাবা-গো বলে কত আকুতি-মিনতি করি কিন্তু তারা কর্ণপাত করেনি। লোহার রডের একেকটা আঘাতে আমার শরীরের চামড়া খসে পড়ছিল। সারা শরীর রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল। পানি পানি করে চিৎকার করতাম, সারাদিনে শুধু আধা কাপ পানি দিত। কোনো খাবার দিত না। সেল থেকে বের করে যখন আমাকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলো তখন আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। আমার মতো অনেক অভিযোগকারীর ওপর দিনের পর দিন এভাবে নির্যাতন চলত।’
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয় না
মদপানে আসক্তি থাকায় মো. মিজানকে (ছদ্মনাম) হলি লাইফে ২০১৭ সালে তার ছোট ভাই ভর্তি করান। টানা সাড়ে তিন বছর মাদক নিরাময় কেন্দ্রটিতে থাকেন তিনি। এর মধ্যে একদিনের জন্যও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাননি তিনি। চলতি বছর কেন্দ্রটি থেকে ‘মুক্ত’ হন তিনি।
আমার যদি কোনো অন্যায় হয়, তাহলে প্রশাসন আছে, প্রশাসন দেখবে। আমার জায়গায় আমি আছি। এসব ক্ষেত্রে অন্য প্রতিষ্ঠান হলে মালিক পালিয়ে যেত। আমি কিন্তু পালাইনি। আমাদের এখানে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে অনেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, প্রতিষ্ঠিত জায়গায় কাজ করছেন। এখানে যারা চিকিৎসা নেন, আমরা তাদের নিজের সন্তানের মতো দেখি, পরিবারের সদস্য মনে করি
রিয়াজ উদ্দিন, মালিক, হলি লাইফ
মিজান ঢাকা পোস্টকে বলেন, “এখানে ভর্তির পর প্রতি মাসে আমার পরিবার হলি লাইফকে ৩৫ হাজার করে টাকা দিত। অনেক রোগীর পরিবারপ্রতি মাসে ৩৫ থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিত তারা। প্রতি মাসে তাদের (হলি লাইফ) আয় ৫০ লাখ টাকা। পরিবারের লোকজন নির্যাতনের কথা শুনলে রোগীকে নিয়ে যাবে, তাহলে তো তাদের ব্যবসা শেষ। এ ভয়ে তারা কোনো রোগীকে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দিত না। কেউ দেখা করতে এলে আগেই ওষুধ খাইয়ে অ্যাবনরমাল (অস্বাভাবিক) করে ফেলত। পরে পরিবারের লোকজন এলে সিসি ক্যামেরা দিয়ে দেখিয়ে কর্তৃপক্ষ বলত, ‘দেখেন, আপনার রোগী এখনও ভালো হয়নি। তাকে এখন নেওয়া যাবে না। তার সঙ্গে দেখাও করা যাবে না।’ এসব কথা বলে আমাকে সাড়ে তিন বছর আটকে রাখে। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। পরে পরিবারের সদস্যরা এসব বুঝতে পেরে লোকজন নিয়ে এসে হই-হুল্লোড় করে আমাকে নিয়ে যায়। এখনও সেখানে এমন অনেকে আছেন, যারা ৫-৭ বছর ধরে আটক আছেন। তাদের কাউকেই পরিবারের লোকজনের সঙ্গে তেমন একটা দেখা করতে দেওয়া হয় না।”
চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ প্রয়োগে অনিয়ম
হলি লাইফ থেকে বের হওয়া ভুক্তভোগীরা তাদের চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধের প্রয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের অভিযোগ, এখানকার চিকিৎসকরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ছাড়াই রোগীদের চিকিৎসা দেন। অনেক রোগী চিকিৎসকদের এসব বিষয়ে প্রশ্ন করলে কোনো সদুত্তর দিতেন না। চিকিৎসকরা শুধু বলতেন, ‘মালিক সিসি ক্যামেরায় রোগীর অবস্থা দেখে যে ওষুধ দিতে বলে আমরা সেটাই দেই। এর বাইরে আমাদের কিছু করার নেই।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের নীরব ভূমিকা
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের নীরব ভূমিকার কারণে হলি লাইফ কর্তৃপক্ষ এ ধরনের অনিয়ম ও নির্যাতন চালিয়ে আসছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। তাদের অভিযোগ, ছয় মাস পরপর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা হলি লাইফ পরিদর্শনে আসতেন। এ সময় নির্যাতনের কারণে যদি কারও শরীর পচে দুর্গন্ধ বের হতো বা কেউ অভিযোগ করত, তখন কর্মকর্তারা কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসা করত এসব কী হচ্ছে? কর্তৃপক্ষ জবাব না দিয়ে কর্মকর্তাদের হাতে টাকা ধরিয়ে দিত। ওই টাকা নিয়ে তারা (কর্মকর্তারা) হাসিমুখে সেখান থেকে বের হয়ে আসতেন। আর ভেতরে ঢোকার সময় যদি তাদের হাতে কর্তৃপক্ষ টাকা ধরিয়ে দিত, তাহলে তারা ওপরেই আসত না।
হলি লাইফের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তদন্ত হচ্ছে
ভুক্তভোগীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার বলেন, হলি লাইফের বিষয়ে আমরা কিছু অভিযোগ পেয়েছি। গত ২ মার্চ ইয়াসিন নামে এক যুবকের মৃত্যুর পর সেখানে আমাদের টিম যায়। তাদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো আমরা তদন্ত করে দেখছি।
তিনি আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নয়টি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের লাইসেন্স বাতিল করেছি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে তদন্ত করে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিছু কিছু জায়গায় সীমাবদ্ধতার কারণে অসংগতি রয়েছে। তবে অধিকাংশ মাদক নিরাময় কেন্দ্র সঠিকভাবে চলছে। আমরা নিয়মিত কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করছি।’
এদিকে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশব্যাপী চলা ৩৫৫টি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলোর অবস্থা খারাপ। এসব কেন্দ্র আসক্তদের সুস্থতার কারণ না হয়ে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রোগীদের সন্তানের মতো দেখা হয় : হলি লাইফ
ভুক্তভোগীদের এসব অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছেন হলি লাইফের মালিক রিয়াজ উদ্দিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের তদারকির জন্য যথেষ্ট পরিমাণ সরকারি গাইডলাইন রয়েছে। দু-চারজন যারা এ জগতে থাকে, তারা তো বিভিন্ন কথা বলবেই। কী পরিমাণ অতিষ্ঠ হলে একজন আপনজনকে পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে রিহ্যাব সেন্টারে ভর্তি করায়? তাদের মধ্যে কয়েকজন মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করবেই।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার যদি কোনো অন্যায় হয়, তাহলে প্রশাসন আছে, প্রশাসন দেখবে। আমার জায়গায় আমি আছি। এসব ক্ষেত্রে অন্য প্রতিষ্ঠান হলে মালিক পালিয়ে যেত। আমি কিন্তু পালাইনি। আমাদের এখানে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে অনেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, প্রতিষ্ঠিত জায়গায় কাজ করছেন। এখানে যারা চিকিৎসা নেন, আমরা তাদের নিজের সন্তানের মতো দেখি, পরিবারের সদস্য মনে করি।’
এমএসি/এআর/এসএসএইচ/এমএআর/এমএমজে