বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না— নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ সরকারপ্রধানকে জানিয়ে থাকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। অর্থাৎ এডিপিভুক্ত প্রকল্পগুলো সবসময়ই আইএমইডি’র কঠোর নজরদারিতে থাকে যাতে সেখানে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি না হয়।

অথচ সেখানেই ঘটেছে ব্যত্যয়। চরম অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন আইএমইডি’র ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা। যেন ‘শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়া’র মতো অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে ‘সরষের ভেতর ভূতের দৃষ্টান্ত’ বলেও মন্তব্য করেছেন।

ঢাকা পোস্টের নিজস্ব অনুসন্ধানে আইএমইডি’র ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতা মিলেছে। বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্প থেকে অনিয়মের মাধ্যমে তিনি অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন, যার তথ্য-প্রমাণ ঢাকা পোস্টের কাছে সংরক্ষিত আছে। তিনি আর কেউ নেন, সদ্য বিদায়ী আইএমইডি এবং বর্তমানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব মো. আবু হেনা মোরশেদ জামান।

আরও পড়ুন >> ডিজিটাল বাংলাদেশে সেবা কি ফ্রি? 

চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) দুই লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন করছে সরকার। প্রতি বছরই জাতীয় বাজেটের একটা বিরাট অংশ উন্নয়ন প্রকল্পের পেছনে ব্যয় হয়। এসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম ও দুর্নীতি ঠেকাতে প্রতিনিয়ত ফায়ার ব্রিগেডের মতো সচেষ্ট থাকে আইএমইডি। কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতি ঠেকানোর দায়িত্বে থাকা বিভাগটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তখন এর নিরপেক্ষ কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন ওঠে
উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতি ঠেকানোর দায়িত্বে থাকা আইএমইডি’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তখন এর নিরপেক্ষ কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন ওঠে / ফাইল ছবি

এ বিষয়ে আইএমইডি’র বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তারা জানান, চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) দুই লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন করছে সরকার। প্রতি বছরই জাতীয় বাজেটের একটা বিরাট অংশ উন্নয়ন প্রকল্পের পেছনে ব্যয় হয়। এসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম ও দুর্নীতি ঠেকাতে প্রতিনিয়ত ফায়ার ব্রিগেডের মতো সচেষ্ট থাকে আইএমইডি। কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতি ঠেকানোর দায়িত্বে থাকা বিভাগটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তখন এর নিরপেক্ষ কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

আইএমইডি’র সদ্য সাবেক সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান গত এক বছরে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। তার এসব কর্মকাণ্ডে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন তারই একান্ত সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব মো. মাহবুব আলম— জানান তারা।

আরও পড়ুন >> অতিরিক্ত দায়িত্বে ‘চাপে’ আইএমইডি, শুনছে না জনপ্রশাসন

সম্পাদনা প্যানেলের টাকা আত্মসাৎ

নাম প্রকাশ না করে ওই কর্মকর্তারা আরও জানান, সদ্য বদলি হওয়া সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান গত বছরের ৩১ অক্টোবর বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে যোগ দেন। অর্থাৎ এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি আইএমইডি’র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রথমে আইএমইডি’র কাজে হস্তক্ষেপ না করলেও ধীরে ধীরে তিনি চর্চাটি করতে থাকেন। আউটসোসিংয়ের সম্পাদনা প্যানেলের সদস্য না হয়েও ৭২টি আউটসোসিং কোম্পানি থেকে ১৫ লাখ ১২ হাজার টাকা নেন। কিন্তু টাকাটা সম্পাদনা প্যানেলের সদস্য ছাড়া অন্য কারও পাওয়ার কথা নয়। অতীতেও কোনো সচিব সম্পাদনা প্যানেলের টাকায় হাত দেননি। কিন্তু আবু হেনা মোরশেদ জামান সম্পাদনা প্যানেলের সদস্য না হয়েও প্রত্যেক কোম্পানি থেকে ২১ হাজার টাকা গ্রহণ করেন। মোট ৭২টি কোম্পানি থেকে তিনি ১৫ লাখ ১২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন।

আউটসোর্সিংয়ের সম্পাদনা প্যানেলের সদস্য না হয়েও ৭২টি আউটসোসিং কোম্পানি থেকে ১৫ লাখ ১২ হাজার টাকা নেন তিনি। কিন্তু টাকাটা সম্পাদনা প্যানেলের সদস্য ছাড়া অন্য কারও পাওয়ার কথা নয়। অতীতেও কোনো সচিব সম্পাদনা প্যানেলের টাকায় হাত দেননি। কিন্তু আবু হেনা মোরশেদ জামান সম্পাদনা প্যানেলের সদস্য না হয়েও প্রত্যেক কোম্পানি থেকে ২১ হাজার টাকা গ্রহণ করেন। মোট ৭২টি কোম্পানি থেকে তিনি ১৫ লাখ ১২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন
আইএমইডি’র জন্য ভাড়া করা ছয়টি গাড়ি নিজ ক্ষমতাবলে ছয়জনকে বণ্টন করেন সচিব। প্রতি মাসে প্রতিটি গাড়ির পেছনে ভাড়াবাবদ আড়াই লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে / ফাইল ছবি

স্টেশনারি সামগ্রী ও গাড়ি বণ্টনে অনিয়ম

স্টেশনারি সামগ্রী ক্রয়ের বরাদ্দ থেকে ১৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা গ্রহণ করেন আবু হেনা মোরশেদ জামান। এ খাতে পণ্য ক্রয়ে আউটসোর্সিং কোম্পানিগুলো আইএমইডিকে বরাদ্দ দিয়ে থাকে। আইএমইডিকে ৭২টি কোম্পানির বরাদ্দ দেওয়া অর্থ ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজের করে নিয়েছেন মোরশেদ জামান।

আরও পড়ুন >> জনগণের টাকায় আনন্দ উল্লাস! 

ওই কর্মকর্তারা ঢাকা পোস্টকে জানান, সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান নিজেকে সৎ বলে জাহির করলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। প্রকল্প মনিটরিংয়ে “ফলাফলভিত্তিক পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন পদ্ধতির কার্যকর ব্যবহারে আইএমইডি’র সক্ষমতা বৃদ্ধি (সিইইপিআরএম অ্যান্ড ইএসআই)” শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বিভাগটির ভাড়া করা ছয়টি গাড়ি নিজ ক্ষমতাবলে ছয়জনকে বণ্টন করেন। প্রতি মাসে প্রতিটি গাড়ির পেছনে ভাড়াবাবদ আড়াই লাখ টাকা করে মোট ব্যয় হচ্ছে ১৫ লাখ টাকা। একটি গাড়ি সচিব তার বাসায়, একটি গাড়ি তার দপ্তরে, একটি সচিবের একান্ত সচিব (পিএস) মাহবুব আলম, একটি সেক্টর-২ এর পরিচালক (উপসচিব) মো. মাহমুদ হাসান, একটি প্রকল্প পরিচালক এবং একটি গাড়ি পরিকল্পনামন্ত্রীর এপিএস ব্যবহার করেন।

গত এক বছরে ওই ছয়টি গাড়ি প্রকল্প ভিজিটের ক্ষেত্রে ২০ দিনও ব্যবহার হয়নি। উন্নয়ন প্রকল্প পর্যবেক্ষণের জন্য ভাড়া নেওয়া গাড়ি সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের নির্দেশেই বণ্টন করা হয়। এতে প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যত্যয় হয়। যেটা আইএমইডি’র বিধিবহির্ভূত কাজ। এছাড়া, পিএস মাহবুব আলমকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিবের পিএস হিসেবে যোগদানের লক্ষ্যে তিনি গত ৫ জানুয়ারি আইএমইডি থেকে তাকে অবমুক্ত করেন। আইএমইডি থেকে যাওয়ার সময় ভাড়া করা গাড়িগুলোর লগবইসহ বিভিন্ন বিল-ভাউচার তিনি নিয়ে যান।

ব্যাগের বদলে আড়ং-এর ফ্রি গিফট ভাইচার প্রদান

তারা জানান, নভেম্বরের শেষের দিকে সিইইপিআরএম অ্যান্ড ইএসআই প্রকল্পের আওতায় আইএমইডি’র কর্মকর্তাদের নিয়ে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। প্রকল্প থেকে কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের জন্য ব্যাগ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু সচিব সেই ব্যাগ না দিয়ে সবাইকে ফ্রি পাওয়া আড়ং-এর গিফট ভাইচার দেন। অথচ ব্যাগের পেছনে তিন লাখ আট হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। যা পরে তুলে নেন মোরশেদ জামান। এক্ষেত্রে ভুয়া চালানে দুই হাজার ৮০০ টাকা দরে মোট ১১০ পিস ব্যাগ ক্রয় দেখানো হয়।

যেই প্রতিষ্ঠানটির মূল ম্যান্ডেটই হচ্ছে প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, সেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে এ ধরনের কাজ করলে সেটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক- ড. ইফতেখারুজ্জামান / ফাইল ছবি

খাবার সরবরাহ নিয়েও তুঘলকি কাণ্ড

শুধু ব্যাগ নয় আইএমইডি’র ওই কর্মশালায় খাবার সরবরাহ নিয়েও তুঘলকি কাণ্ড ঘটান আবু হেনা মোরশেদ জামান। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের জন্য সোনারগাঁও হোটেল থেকে খাবার আনা হতো। ফলে সরকারের অর্থের অপচয় হয়। অন্যদিকে, আউটসোর্সিং কোম্পানির সব সভাসহ অন্যান্য কর্মশালায় মি. কুকের খাবার নিতে বাধ্য করেন সচিব। যা দিতে বাধ্য করা হয় আউটসোর্সিং কোম্পানিগুলোকে। জানা যায়, খাবারবাবদ মি. কুককে ৪৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছে ৭২টি আউটসোর্সিং কোম্পানি।

আরও পড়ুন >> তথ্য গোপন করে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত বাগিয়ে নিল আইএমইডি

সচিবের স্বজনপ্রীতি

নিজ ভাগনে তাসকিনকে আইএমইডি’র কাজ দিতেও বাধ্য করেন সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান। বিভিন্ন আসবাবপত্র সরবরাহসহ টেন্ডারের কাজও পাইয়ে দেন তিনি। সচিবের ওই ভাগনে এখনও আইএমইডিতে কাজের বিলবাবদ টাকা পান বলে জানা গেছে। শুধু ভাগনে নন, প্রকল্পে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ছয়জনকে নিয়োগ দেন সচিবের পিএস মাহবুব আলম। অর্থের বিনিময়ে পিএস মাহবুব আলম ওই ছয়জনকে নিয়োগ দিতে বাধ্য করেন। পিএস মাহবুব আলম সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন সময় কর্মকর্তাদের কাছেও মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। ঢাকা পোস্টের কাছে টাকা চাওয়ার স্ক্রিনশটও সংরক্ষিত আছে। টাকা দিতে না পারলে কর্মকর্তাদের ফাইল নিয়ে নানা জটিলতা সৃষ্টি করতেন তিনি।

আইএমইডি’র কাজ কী

সরকারের উন্নয়ন বাজেট এবং বিশেষ করে সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের মনিটরিং ও মূল্যায়ন জোরদার করতে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যুরো (পিআইবি)’ সৃষ্ট করে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে ন্যস্ত করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্মপরিধি বাড়ার কারণে ১৯৭৭ সালে পিআইবি-কে ‘প্রজেক্ট মনিটরিং ডিভিশন (পিএমডি)’ করে একটি স্বতন্ত্র বিভাগে উন্নীত করা হয়। পরবর্তীতে পিএমডি-কে ১৯৮৪ সালে ‘বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)’ করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। বর্তমানে বিভাগটির কাজ হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্পে কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি হলে সেগুলোর প্রতিবেদন করে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করাসহ সরকারপ্রধানকে জানানো

সম্মানি নেওয়ার ক্ষেত্রেও কম যান না

সম্মানি নেওয়ার ক্ষেত্রেও কম যাননি সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান। সিপিটিইউয়ের ই-জিপি সংক্রান্ত ১০টি ট্রেনিংয়ে প্রধান অতিথি হিসেবে ১০ লাখ টাকা সম্মানি নেন তিনি। বিষয়টি নিশ্চিত করেন আইএমইডি’র বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা। তারা জানান, প্রতিটি সেমিনারে এক লাখ টাকা করে সম্মানি নেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের নতুন সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান। ঢাকা পোস্টের কাছে পাঁচটি ট্রেনিংয়ের প্রধান অতিথির সম্মানির আয়করবাবদ ৫৪ হাজার টাকা পরিশোধের রশিদ সংরক্ষিত আছে।

আরও পড়ুন >> টাকার নাকি পাখা গজাইছে! 

যথেচ্ছা গাড়ির ব্যবহার

ঢাকা পোস্টের হাতে আসা তথ্য-প্রমাণে দেখা গেছে, গত বছরের জুনে ২১-৪১৩৩ নম্বরের গাড়িটি ১ থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত আবু হেনা মোরশেদ জামানের পিএস মো. মাহবুব আলম ব্যক্তিগত কাজে এবং অফিসে যাতায়াতে ব্যবহার করেছেন। ১৮ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ওই নম্বরের গাড়িটি আইএমইডি’র সেক্টর-২ এর পরিচালক মো. মাহমুদ হাসান অফিসে যাতায়াত এবং ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। জুলাই মাসেও মাত্র সাত দিন গাড়িটি আইএমইডি’র অন্যান্য কর্মকর্তারা ব্যবহারের সুযোগ পেলেও মাসের বাকি দিন পরিচালক মাহমুদ হাসান ও পিএস মাহবুব আলম অফিসে যাতায়াত এবং ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। একইসঙ্গে ২১-১৯৮৭ নম্বরের গাড়িটিও বিভিন্ন সময় পরিচালক মাহমুদ হাসান ব্যবহার করেন। এছাড়া ১৭-১৪১২ নম্বরের গাড়িটি পরিকল্পনামন্ত্রীর এপিএস মাসুম বিল্লাহ ব্যবহার করছেন। ২১-২৩১৭ নম্বরের গাড়িটি জুলাই মাসে কয়েকবার দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার হলেও সচিব আবু হেনার দ্বিতীয় পিএস রফিকুল ইসলাম ব্যবহার করেছেন। ঢাকা মেট্রো-চ ২০-৪০৪০ নম্বরের গাড়িটি প্রকল্প পরিচালক মুহাম্মদ মশিউর রহমান ব্যবহার করেন।

অন্যদিকে, ১৭-৩৩৮৫ নম্বরের গাড়িটি বেশির ভাগ সময় কী কাজে ব্যবহার হয়েছে সেটি লগবইয়ে উল্লেখ নেই। তবে, গাড়িটি সচিবের বাসার কাজে ব্যবহার হয়েছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণে ভাড়া করা গাড়িগুলো ব্যবহারের কথা থাকলেও প্রতিনিয়ত তা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার হয়েছে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতিসহ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পূরণে ব্যত্যয় হয়েছে।

প্রকল্পের গাড়ি কেন ব্যবহার করেছেন— এমন প্রশ্নের জবাবে আবু হেনা মোরশেদ জামানের পিএস মো. মাহবুব আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মানে কি? কোথা থেকে আপনি কী তথ্য পেয়ে কী বলছেন? আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো গাড়ি ব্যবহার করছি না। প্রকল্পের গাড়ি আমি কেন ব্যবহার করব? আপনি বিভ্রান্ত তথ্য দিচ্ছেন, না জেনে কথা বলছেন।’ উত্তেজিত হয়ে এটুকু বলে ফোন কেটে দেন তিনি।

আরও পড়ুন >> পাঁচ কোটি টাকার কাজে বিল উত্তোলন ১১ কোটি!

উনি কেন এগুলো করলেন, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে— পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান / ফাইল ছবি

আইএমইডি পরিচালক যা বলছেন

এ প্রসঙ্গে আইএমইডি পরিচালক মো. মাহমুদ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি সরকারি কাজ ছাড়া কোনো গাড়ি ব্যবহার করি না। সচিব স্যারের দপ্তরের কাজ ছাড়া আমি গাড়ি ব্যবহার করি না। আমার তো কোনো ক্ষমতা নাই। আপনি যার সঙ্গেই কথা বলেন না কেন, আমার কোনো অসুবিধা নাই। আমি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া সরকারি কোনো গাড়ি ব্যবহার করি না।’

প্রকল্পের গাড়িগুলো ব্যক্তিগত কাজে কেন ব্যবহার করা হলো— এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক মুহাম্মদ মশিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটা আমাদের আগের প্রকল্প পরিচালক বলতে পারবেন। আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে কামাল হোসেন তালুকদার এ প্রকল্পের পিডি ছিলেন।’

আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কি—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিন গাড়িগুলো দিয়েছি। গাড়িগুলো যারা ব্যবহার করেছেন, তাদের বিষয়গুলো আগে থেকেই চলে আসছিল। এজন্য আমার আর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য-বহির্ভূত কাজ হয়েছে কি না, আমি বলতে পারব না।’

আরও পড়ুন >> মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা 

মি. কুকের খাবার নিতে বাধ্য করা হয়েছে— এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘এটাও আমি জানি না। আমরা ওইভাবে নির্দেশিত হয়েই এটা করেছি।’ নির্দেশ কে দিয়েছেন— এ বিষয়েও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি পিডি। ‘এটা ওখান থেকেই (ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) দেওয়া হয়েছে’— বলেন তিনি।

প্রকল্পের কর্মশালায় গিফট-ভাউচার দেওয়ার নামে সচিবের টাকা আত্মসাৎ— এমন অনিয়মের দায় কি আপনি নেবেন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বুঝতে পারছি না। আমি আড়ংয়ের বিষয়টা জানি না। এটা আসলে দেখা লাগবে। আমি এটার খোঁজ নেব। সব দায়ভার কীভাবে নেব, বলেন। বিষয়টি নিয়ে সচিব স্যারের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। আগে থেকেই এভাবে চলে আসছিল। এজন্য আলোচনা করা হয়নি। আগের পিডির সঙ্গে কথা বললে তিনি বলতে পারবেন। তারপরও আমি এসব বিষয়ে কথা বলব।’

পিএস মাহবুব আলম ভাড়া করা গাড়িগুলোর লগবই নিয়ে গেছেন কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে পিডি বলেন, ‘আসলে উনি এ প্রকল্পের ডিপিডি ছিলেন। সেজন্য হয়তো নিয়ে গেছেন। তবে, গাড়ির লগবইসহ বিল-ভাউচার নেওয়া উনার ঠিক হয়নি। আমি বিষয়টি বর্তমান সচিব স্যারকে জানিয়েছি। তিনি এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। তবে, লগবইসহ বিল-ভাউচার ফিরে পেতে আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করছি। উনি দ্রুতই দিয়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন।’

উন্নয়ন প্রকল্পে কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি হলে সেগুলোর প্রতিবেদন করে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশসহ সরকারপ্রধানকে জানানো হচ্ছে আইএমইডি’র কাজ / ফাইল ছবি

হোয়াটসঅ্যাপে যা বললেন সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান

আইএমইডি’র অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে বর্তমান ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে প্রশ্ন পাঠালে তিনি লিখিতভাবে তার বক্তব্য পাঠান।

আরও পড়ুন >> দুদকের ধার গেল কই? 

ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে আবু হেনা মোরশেদ জামানকে সুনির্দিষ্টভাবে সাতটি লিখিত প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্নগুলোর বিপরীতে তিনিও লিখিত বক্তব্য পাঠান। নিচে তা তুলে ধরা হলো—

সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বলেন, ‘প্রতিটি প্রশ্নই অপ্রাসঙ্গিক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অসত্য। এর একটিও সত্য নয়, সেটি আপনিও জানেন এবং এগুলোর কোনো প্রমাণ বা এর সঙ্গে আমার কোনোরকম যুক্ততা আছে, আপনি এরকম প্রমাণ দিতে পারবেন না। এ আস্থা আমার নিজের ওপর আছে। অনিয়মের দায়ে সন্দেহভাজন দুজন কর্মকর্তা/কর্মচারী নিয়মিত বদলিতে পড়াতেই আপনি তাদের পক্ষে রিপোর্ট করতে চাচ্ছেন, অনুসন্ধান ও প্রমাণ ছাড়া। তাদের বদলির আদেশের পরই তো এসব অভিযোগ, এতদিন তো ছিল না। আমার সততা নিয়ে আমি নিশ্চিত এবং এ সম্পর্কে সাধারণ একটি ধারণা নিশ্চয়ই আছে। সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে কলঙ্কিত করতে চাইলে কী করা? আপনি সৎ, ভদ্রলোক। এ আস্থা রেখে এটাই আমার বক্তব্য হিসেবে ছাপাবেন, আশা করছি।’

সরষের ভেতর ভূতের একটা দৃষ্টান্ত : ইফতেখারুজ্জামান

প্রকল্পের আওতায় থাকা গাড়ির অপব্যবহার প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আপনার দেওয়া তথ্যগুলো যদি সঠিক হয় তাহলে এটা ক্ষমতার অপব্যবহার। বিভিন্ন কারণে এটা ক্ষমতার অপব্যবহার, ব্যক্তিগত স্বার্থেই এমনটি হয়েছে। যার অপর নাম দুর্নীতি এবং এটা দৃষ্টান্ত হবে একাধিক কারণে। প্রথমত, কিসের ওপর ভিত্তি করে গাড়িগুলো ভাড়া করা হলো এবং কী কারণে প্রতি মাসে আড়াই লাখ টাকা করে গাড়িগুলো ভাড়া করা হলো। তার ডকুমেন্টেশন থাকতে হবে। যদি ডকুমেন্টেশন না থাকে তাহলে এখানে এক ধরনের অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। কারণ, যেই আইএমইডি’র পরিবীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ করে প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি তুলে আনার কথা সেই আইএমইডি’র কর্ণধার হিসেবে সিদ্ধান্তটা সম্পূর্ণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং সরষের ভেতর ভূতের একটা দৃষ্টান্ত।’

‘ভাড়া করা গাড়িগুলোর অপব্যবহারের ফলে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যাহত হয়েছে। প্রকল্পের অনুকূলে গাড়ি ভাড়া করে প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ না করে ব্যক্তিগত কারণে পারিবারিক উদ্দেশ্যে গাড়ি ব্যবহার করে থাকলে এটা গুরুতর অন্যায়। এটা জনগণের অর্থের অপব্যবহার এবং আত্মসাতের মতো একটা ঘটনা। এছাড়া, যারা গাড়িগুলো ব্যবহার করেছেন, তারা প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার করার এখতিয়ার রাখেন কি না, এটা নিশ্চিত না হয়ে তাদের গাড়ি ব্যবহার করতে দেওয়াও একটা অন্যায়। যেই প্রতিষ্ঠানটির মূল ম্যান্ডেটই হচ্ছে প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, সেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে যদি তিনি এ ধরনের কাজ করে থাকেন তাহলে এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কাজেই এখানে যথাযথ প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’

আরও পড়ুন >> উন্নয়নের মাঝেও আছে পিছুটান

সম্পাদনা পরিষদ ও স্টেশনারি খাত থেকে সচিবের টাকা নেওয়া প্রসঙ্গে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “আইএমইডি’র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে এটা সম্পূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতা অপব্যবহার হয়েছে এবং দুর্নীতি অবশ্যই হয়েছে। এখানে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। কারণ, তিনি যে দায়িত্ব পালন করেন নাই অথচ সে খাত থেকে তিনি টাকা নিয়েছেন। এখানে প্রতারণামূলক একটা দুর্নীতি হয়েছে।”

বিভাগটির ভাড়া করা ছয়টি গাড়ি নিজ ক্ষমতাবলে ছয়জনকে বণ্টন করেন। প্রতি মাসে প্রতিটি গাড়ির পেছনে ভাড়াবাবদ আড়াই লাখ টাকা করে মোট ব্যয় হচ্ছে ১৫ লাখ টাকা। একটি গাড়ি সচিব তার বাসায়, একটি গাড়ি তার দপ্তরে, একটি সচিবের একান্ত সচিব (পিএস) মাহবুব আলম, একটি সেক্টর-২ এর পরিচালক (উপসচিব) মো. মাহমুদ হাসান, একটি প্রকল্প পরিচালক এবং একটি গাড়ি পরিকল্পনামন্ত্রীর এপিএস ব্যবহার করেন

অনিয়ম হলে ব্যবস্থা নেব : পরিকল্পনামন্ত্রী

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আবু হেনাকে আমি খুব ভালো অফিসার হিসেবে জানি। উনি কেন এগুলো করলেন, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। যদি প্রকল্পের অর্থে ভাড়া করা গাড়ি নিজেরা ব্যবহার করেন, তাহলে এটা অন্যায় হয়েছে। এছাড়া, সম্পাদনা পরিষদের সদস্য না হয়েও আইএমইডি থেকে টাকা নেওয়াসহ সবকিছু খতিয়ে দেখতে হবে। আপনি তথ্যপ্রমাণ নিয়ে আসলে আমি এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’

এসআর/এআর/এমএআর/