নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার অভিযোগ রয়েছে সরকারি মালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের বিরুদ্ধে। যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দেয়া, পরবর্তী সময়ে তা আদায় না হওয়া; জাল-জালিয়াতির সঙ্গে রয়েছে অর্থপাচার ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও। এসব কারণে দুরবস্থায় নিমজ্জিত ব্যাংকটি। তবুও টনক নড়ছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির।

নতুন করে অভিযোগ উঠেছে, ঋণ পুনঃতফসিলসহ নানা কৌশলে বড় খেলাপিদের ঋণ দিয়ে যাচ্ছে জনতা ব্যাংক। এমনই এক প্রতিষ্ঠান গ্লোব জনকণ্ঠ গ্রুপ। বড় খেলাপিদের মধ্যে অন্যতম এ গ্রুপটির জন্য নতুন করে ২২৫ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দিয়েছে জনতা ব্যাংকের পর্ষদ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ পেতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নতুন ঋণের আবেদন করে গ্রুপটি। ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জনকণ্ঠ গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠান গ্লোব মেটাল কমপ্লেক্স লিমিটেড, গ্লোব ইনসেকটিসাইডস লিমিটেড, জনকণ্ঠ লিমিটেড, গ্লোব ক্যাবলস লিমিটেড ও গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার লিমিটেডের অনুকূলে সর্বমোট ২২৫ কোটি টাকার লিমিট (কম্প্রোমাইজ অ্যামাউন্ট শিথিলকরণ পূর্বক) মঞ্জুরের অনাপত্তি দিয়েছে জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, দীর্ঘদিনের এই ঋণখেলাপি গ্রুপকে নতুন করে ঋণ দেওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না ব্যাংকের। সে কারণেই তারা অনাপত্তিপত্র নিতে কেসটি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠায়। কিন্তু গায়েবি চাপে বেশকিছু শর্ত দিয়ে ঋণ বিতরণের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সব শর্ত পুরোপুরি না মানার অভিযোগ রয়েছে।

ঋণ বিতরণের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতির শর্ত জুড়ে দেয় জনতা ব্যাংক। এদিকে সরাসরি ঋণ দিতে নিষেধ না করলেও পাঁচ শর্তে ওই গ্রুপকে ঋণ দেওয়ার পক্ষে মত দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। শর্তগুলো হলো- নতুন ঋণ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে ইতোপূর্বে গ্রাহকের পুনঃতফসিল ঋণস্থিতির কমপক্ষে পাঁচ শতাংশ অর্থ ‘কম্প্রোমাইজ অ্যামাউন্ট’ হিসেবে আদায় নিশ্চিত করতে হবে। একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রমের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফ-সাইট সুপারভিশনের অনাপত্তি নিতে হবে। ঋণটি বিতরণের ক্ষেত্রে ঋণ-নিয়মাচার যথাযথ পরিপালনসহ এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ঋণ আদায়ের ঝুঁকির বিষয় বিবেচনায় নিয়ে গ্রাহকের ঋণ হিসাবগুলো প্রয়োজনীয় জামানত দিয়ে আচ্ছাদনের পাশাপাশি ঋণ আদায়ে নিবিড় তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। কম্প্রোমাইজ অ্যামাউন্ট গ্রহণ সংক্রান্ত শর্ত ছাড়াও বিআরপিডি সার্কুলার নং- ১৫/২০১২ এর অন্যান্য শর্তসহ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দেওয়া সব শর্ত পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে।

গ্লোব জনকণ্ঠ গ্রুপ থেকে ব্যাংক বরাবর ঋণ আবেদনপত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘২০১৮ সালে ঋণখেলাপিতে পরিণত হয় প্রতিষ্ঠানটি। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া বিশেষ প্রণোদনার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে ঋণগুলো পুনঃতফসিল করা হয়েছে। ঋণগুলো নিয়মিত করার জন্য মোট আট কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।’ গ্লোব জনকণ্ঠ গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪০০ কোটি টাকা। বোর্ডে অনুমোদন করে এই আবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তির জন্য পাঠিয়ে দেয় জনতা ব্যাংক।

এ বিষয়ে জানার জন্য জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুছ ছালাম আজাদের সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। তবে ব্যাংকের ক্রেডিট ডিপার্টমেন্ট বা ঋণ বিভাগের প্রধান মাশফিউল বারী বলেন, ‘গ্লোব জনকণ্ঠ গ্রুপ দিলকুশা শাখার ক্লায়েন্ট। বিষয়টি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট শাখাই ভালো বলতে পারবে। তবে ঋণটি বিতরণের ক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েছি। তারপরই বিতরণ করেছি।  

নিয়ম অনুযায়ী, বড় ঋণের ক্ষেত্রে বোর্ডের অনুমোদনের পর প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিতে হয়। এক্ষেত্রে আমরা পুরো প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ঋণ দিয়েছি

জনতা ব্যাংকের ঋণ বিভাগের প্রধান মাশফিউল বারী

 ঋণটি বিতরণের আগে কম্প্রোমাইজ অ্যামাউন্ট আদায়ের শর্ত পূরণ হয়েছে কি-না, সে বিষয়ে জানতে চাইলে দিলকুশা শাখার ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন মাশফিউল বারী। তবে দিলকুশা শাখার ম্যানেজার মো. হারুন এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রকাশিত ব্যাংক খাতের শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের একটি গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার লিমিটেড। জাতীয় সংসদে প্রকাশিত শীর্ষ খেলাপিদের ওই তালিকায় ২৩১তম অবস্থানে রয়েছে গ্রুপটি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি অনেক আগে থেকেই বলে আসছি যে, ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। যেসব খেলাপি গ্রাহকের আগের রেকর্ড ভালো নয় তাদের ঋণ দিলে আবার খেলাপি হবে। 

পর্ষদকে খুশি রাখার জন্য যেসব ব্যাংকার এই ঋণগুলো অনুমোদন করছেন, ব্যাংকের প্রতি বা জনগণের আমানতের প্রতি তাদের কোনো দরদ নেই

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

‘যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তি খেলাপি গ্রাহকের পক্ষে সুপারিশ করছেন তাদেরও বিষয়টি বোঝা উচিত। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের জন্য সুপারিশের কোনো প্রশ্নই আসে না’— মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। 

এসআই/এমএআর