জঙ্গিদের ‘পরিকল্পনা-প্রশিক্ষণস্থল’ কাশিমপুর কারাগার
প্রতি বছরই বিভিন্ন কারণে গণমাধ্যমগুলোর খবরে জায়গা করে নেয় দেশের কারাগারগুলো। এর মধ্যে রয়েছে অনেক ইতিবাচক ও নেতিবাচক খবরও। বিদায়ী ২০২২ সালও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কারাগারে বসে জঙ্গিদের ফোনে কথা বলার সুযোগ দেওয়া থেকে শুরু করে, চোখ ওঠা বন্দিদের সু-চিকিৎসা করানোসহ নানা খবর ছিল বছরজুড়ে।
তবে, বছরের শেষভাগে এসে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় কাশিমপুর কারাগার-২। ঢাকার আদালত চত্বর থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গে নাম আসে কাশিমপুর কারাগারের। অভিযোগ রয়েছে, কারাগারে বসেই জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়।
বিজ্ঞাপন
এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, চলতি বছরে আত্মপ্রকাশ হওয়া নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার গঠনের পরিকল্পনাও কারাগারে বসে হয়েছে।
মূলত জঙ্গি-সংশ্লিষ্ট ওই দুই বড় ঘটনার পর থেকে কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এমনকি প্রশাসনের উচ্চ মহল থেকে কারাগারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর দাবিও তোলা হয়। যদিও বরাবরের মতো এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে কারাগার কর্তৃপক্ষ।
তাদের দাবি, এসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা না মিললেও তদন্ত চলছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় যেভাবে জড়িয়েছে কারাগার
গত ২০ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে দুই জঙ্গিকে একটি মামলায় আদালতে হাজির করা হয়। হাজিরা শেষে পুলিশ সদস্যরা তাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় পুলিশের চোখে-মুখে স্প্রে করে জঙ্গি সদস্য মইনুল হাসান শামীম ও আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তারা দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তাদের ছিনতাইয়ের ঘটনার পর দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে। এরপর সংশ্লিষ্ট ১০ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হলেও পলাতক জঙ্গিদের এখনও ধরতে পারেনি পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
রিমান্ড জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার জঙ্গিরা সিটিটিসিকে জানায়, আদালত প্রাঙ্গণ থেকে জঙ্গি আসামি ছিনতাইয়ের মাস্টারমাইন্ড হলেন নিষিদ্ধ-ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের প্রধান সমন্বয়ক মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া। তার অনুমতিতে ওই ছিনতাই অপারেশন পরিচালনা করেন সংগঠনের সামরিক শাখার প্রধান মশিউর রহমান ওরফে আইমান।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল কয়েক মাস আগে। সহযোগীদের সঙ্গে জঙ্গিরা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ রাখত। কাশিমপুর কারাগার থেকে দীর্ঘদিন ধরে সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিল তারা। মোবাইল ফোন নিয়ে একবার কারারক্ষীর কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে জঙ্গিরা। সেটি জব্দ করা হয়। পরে আবারও তারা মোবাইল ফোন ব্যবহার শুরু করে।
গ্রেপ্তার আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, বিভিন্নজনকে টাকা দিয়ে জঙ্গিরা কারাগারে মোবাইল ফোন ব্যবহার করত। এছাড়া জঙ্গিদের সেলে দীর্ঘদিন টেলিভিশনও ছিল। তারা নিয়মিত টেলিভিশন দেখত, সংবাদ দেখত। টাকার বিনিময়ে কারাগারে বসে জঙ্গিরা নিয়মিত এসব সুবিধা নিত।
এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ (সিটিটিসি) কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কারাগারে জঙ্গিরা কীভাবে ছিল তা খতিয়ে দেখছে তদন্ত কমিটিগুলো। বিস্তারিত তদন্ত কমিটি বলতে পারবে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গঠিত তদন্ত কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, তারা সব বিষয় সামনে রেখে তদন্ত করছেন। এর মধ্যে বেশকিছু তথ্যও তারা পেয়েছেন, যা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে।
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সভাপতি ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এ কে এম হাফিজ আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা সব বিষয় সামনে রেখে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করছি। তদন্ত প্রতিবেদনে সব বিষয় উঠে আসবে। তদন্ত শেষ করতে আরও সময় লাগবে।’
এদিকে, আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার পরিকল্পনা কারাগারে হয়েছে— এমন তথ্য সামনে আসার পর নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ। এসব আলোচনার মধ্যে নভেম্বর মাসে কারা অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাকে বদলি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের এক বদলির আদেশে বলা হয়, চট্টগ্রাম বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক এ কে এম ফজলুল হককে ঢাকা বিভাগে, রংপুর কারা উপ-মহাপরিদর্শক মো. আলতাব হোসেনকে চট্টগ্রাম বিভাগে এবং ঢাকা বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ তৌহিদুর হককে রংপুর বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক হিসেবে বদলি করা হলো।
আদেশে আরও বলা হয়, হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. আব্দুল জলিলকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার এবং রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালাকে হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার হিসেবে বদলি করা হলো।
অন্যদিকে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, জঙ্গিদের কারাগারে হাই সিকিউরিটি সেলে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় রাখা হয়। তারপরও যদি কারাগারে বসে পরিকল্পনা করা এবং জঙ্গিদের হাতে ফোন তুলে দেওয়ার ঘটনা প্রমাণিত হয় বা কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কারাগারে জঙ্গিরা বসে আদালত থেকে পালানোর পরিকল্পনা করেছে, এটা যদি প্রমাণিত হয় বা এই পরিকল্পনা করতে কারাগারের কেউ সহযোগিতা করেছে বা তাদের ফ্যাসিলিটেট করেছে তাহলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
নতুন জঙ্গি সংগঠনের পরিকল্পনাও হয় কারাগারে
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া গঠনের পরিকল্পনা হয় কারাগারে। বিগত ২০১৭ সাল থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনটি গঠনের কাজ শুর করে সংশ্লিষ্টরা। এরই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণও শুরু হয় সংগঠনটির। সম্প্রতি সংগঠনটির বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অক্টোবর মাসে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘নতুন সংগঠনটির প্রথম আমির মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি। বিগত ২০২১ সালের পূর্ব পর্যন্ত রক্সি ছিল এই সংগঠনের আমির। ওই বছরই রক্সিকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। অক্টোবর মাসে আমরা রক্সিকে আবার রিমান্ডে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করি। রক্সি আমাদের জানায়, এই সংগঠনের মূল মাস্টারমাইন্ড শামিন মাহফুজ ওরফে স্যার। বিগত ২০১৪ সালে শামিন মাহফুজ ওরফে স্যারকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। এর আগে রক্সিও ২০১৫ সালে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিল। রক্সি ও শামিন যখন একসঙ্গে জেলখানায় ছিল তখন তারা সেখানে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবু সাঈদের সংস্পর্শে আসে। এরপর তারা বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে। এমনকি ওই তিনজন জেলখানায় বসে নতুন সংগঠনটি তৈরির পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনামাফিক রক্সি ও শামিন জেলখানা থেকে বের হয়ে জঙ্গিদের নিয়ে শক্তিশালী একটি সংগঠন গঠনের কাজ শুরু করে।’
জেলখানা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যত চিন্তা
গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর থেকে দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, যা এখনও চলমান। সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেফতারও হয়েছেন দুই হাজারের মতো জঙ্গি সদস্য। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অনেকের মৃত্যুও হয়েছে।
জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি করা এসব সফলতার মাঝেও রয়েছে দুশ্চিন্তার রেখা। এর পেছনে দুটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। একটি হলো- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যেখানে নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ছে জঙ্গি-মতাদর্শ। আরেকটি হলো কারাগার।
কারাগার থেকেই শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন
সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, কারাগারে থাকা জঙ্গিরা নানা কৌশলে তাদের সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। এদিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে নব্য জেএমবির সদস্যরা।
গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, তুরস্কে থাকা জেএমবির আমির মাহাদী হাসান ওরফে জনের সঙ্গে কারাগারে বসেই নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন তারা।
তুরস্কে বসেই কারাগারে থাকা জঙ্গিদের দিকনির্দেশনা দেন মাহাদী হাসান ওরফে জন। তার নির্দেশেই কারাগারে নব্য জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জামিনে বের করা হয়। মুক্ত হয়ে নব্য জঙ্গিরা সরাসরি মাহাদী হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে।
কারাগারে কেন নজরদারি চায় সিটিটিসি
সূত্রে জানা গেছে, সদ্য জঙ্গিবাদে যুক্ত হওয়া তরুণরা যেন দুর্ধর্ষ জঙ্গি না হয়ে ওঠে, সেজন্য সিটিটিসি কারাগারে নজরদারি করতে চায়। এমনকি সদ্য জঙ্গিবাদে জড়ানো তরুণদের কারাগারে দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের সেলে না পাঠিয়ে আলাদা রাখতে চায় পুলিশের সংস্থাটি। তারা বলছে, এর ফলে নতুনদের কাউন্সিলিং করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যাবে।
অন্যদিকে দুর্ধর্ষ যে জঙ্গিরা কারাগারে রয়েছে, তাদের কঠিন নজরদারির মধ্যে রাখলে জঙ্গি কার্যক্রম চালাতে পারবে না বলে মনে করছে সিটিটিসি। এক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা নিয়ে কাজটি করতে চায় সংস্থাটি।
এ বিষয়ে বিগত ২০২১ সালে সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘জামিন পাওয়া অনেক জঙ্গি আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। কোনো জঙ্গির জামিন হলে আমরা তাকে পর্যবেক্ষণ করি। দেখি, সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে কি না, নাকি পুনরায় সংগঠনের কাজ-কর্মে যুক্ত হয়েছে। যাকে নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করি, তাদের নজরদারিতে রাখি।’
‘কিন্তু কারাগারে আমরা নজরদারি করতে পারি না, কারণ আমাদের সেই অনুমতি নেই। তবে, আমরা কারাগারে নজরদারির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে একটি চিঠি দিয়েছি। কীভাবে কারাগারে থাকা জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে আমরা কাজ করব। আশা করছি, এ বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষের ইতিবাচক সাড়া পাব।’
তবে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত কারাগারে নজরদারির কোনো অনুমতি পায়নি সিটিটিসি।
এমএসি/এমজে/এমএআর/