মেট্রোরেলে গতি পাবে ঢাকা, ত্বরাণ্বিত হবে সমৃদ্ধি
রাজধানীবাসীর প্রতিদিনের ভোগান্তির নাম যানজট। স্বল্প দূরত্বের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেও সীমাহীন দুর্ভোগের পাশাপাশি সময়ের প্রচুর অপচয় হচ্ছে। যানজটের কারণে ঢাকায় যানবাহনের গতি ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটারের নিচে নেমেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে রাজধানীবাসীর শরীর ও মনে।
বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে, যানজটের কারণে ঢাকা মহানগরীতে দৈনিক ৫০ লাখ কর্ম ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে কর্মজীবীদের। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে ১ লাখ ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা।
বিজ্ঞাপন
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সমীক্ষাও দিচ্ছে একই তথ্য। সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের গড় গতি ছিল প্রায় ২১.২ কিমি/ঘণ্টা। ২০১৫ সালে তা ৬.৮ কিমি-এ নেমে আসে। ২০২০ সালের ঢাকায় যানবাহনের গতি মানুষের হাঁটার গতির মতো ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটারে নামে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা অনুসারে রাজধানীতে যানজটের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। যা আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৯ শতাংশ। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মাথাপিছু আয়েও।
প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা অনুসারে, যানজটের কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমছে ৩ শতাংশের বেশি, এমনকি দারিদ্র্য বিমোচনের হারও কমছে আড়াই শতাংশের কাছাকাছি। এসব পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিয়ে সরকার ফ্লাইওভার ও ইউলুপসহ নগরভিত্তিক বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।
সর্বশেষ সংযোজন হতে যাচ্ছে মেট্রোরেল। আধুনিক নগর-পরিকল্পনায় গণপরিবহনে সবচেয়ে কার্যকর হিসেবে দেখা হচ্ছে মেট্রোরেলকে। যানজট নিরসন, দ্রুত বিপুলসংখ্যক যাত্রী পরিবহনের জন্য উন্নত বিশ্বে মেট্রোরেল সবচেয়ে বেশি সমাদৃত। সেই বিবেচনায় ২০১২ সালে হাতে নেওয়া হয় মেট্রোরেল প্রকল্প। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তির পর মূল কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে।
এ প্রকল্পের আওতায় উত্তরা (দিয়াবাড়ি) থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের কাজ চলছে। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের কাজ শেষ হয়েছে। ২৮ ডিসেম্বর বুধবার এই অংশটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
পুরো মেট্রোরেল পথের দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পথের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকা শহর যানজটের কবল থেকে অনেকটা মুক্তি পাবে। পাশাপাশি আর্থিক হিসাবের বিবেচনায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৫ শতাংশের সমান। আর যানজট থেকে মুক্তি মিললে আমদানি-রপ্তানির সরবরাহ লাইনও গতিশীল হবে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, যানজট সমস্যা নিরসনের পথে নতুন একটি মাইলফলক হচ্ছে মেট্রোরেল। এর সঙ্গে শুধু জিডিপি নয়, মানুষের ভোগান্তির বিষয়টি সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত। এটা জনকল্যাণের বিষয়। সাধারণ জ্ঞান থেকে আমি যেটা মনে করি, ঢাকায় একটা ম্যাস ট্রানজিট সিস্টেমের অভাব আছে। এখন আংশিকভাবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল যদি চালু হয়, সেটার একটা পজিটিভ যাত্রা হিসেবে ধরে নিতে পারি। এটাও অনেক বড় বিষয়।
তিনি বলেন, আংশিক চালু হতে যাওয়া মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশন রয়েছে, ৬০ হাজার মানুষ দিনে আসা-যাওয়া করতে পারবে। যদিও এর কারিগরি অনেক বিষয় রয়েছে। মেট্রোরেল থেকে নেমে যাত্রীদের পরিবহন কী হবে? তখন নতুন সমস্যা তৈরি হবে কি না ইত্যাদি। তবে কথা হচ্ছে, সব তো এক সঙ্গে হবে না, ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে। নতুন অভিজ্ঞতা হিসেবে মেট্রোরেল সিস্টেমের সঙ্গেও আমাদের অভ্যস্ত হতে হবে।
জ্বালানি সংকটের এই সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছেন ড. জাহিদ। তিনি বলেন, মেট্রোরেলের যাত্রার শুরুতে কিছু জটিলতা সৃষ্টির সুযোগ থাকলেও আমি আশাবাদী। মেট্রোরেলে প্রচুর বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মেট্রোরেলে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা বড় একটি চ্যালেঞ্জ। আমরা এখনও জানি না, সরকার এই বিষয়টি কীভাবে মোকাবিলা করবে? এটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছি।
ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুরো মেট্রোরেল চালু হলে সাধারণ জনগণের জন্য খুবই উপকারে আসবে। ব্যবসায়ীদের উপকার হবে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হলে এসব এলাকার ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের কিছুটা উপকার হবে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ব্যবসায়ীদের খুব বেশি লাভ হবে না। তবে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চালু হলে ব্যবসায়ীদের উপকার হবে। এটা বর্তমান সরকারের বড় সাফল্য।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঢাকার যানজট এবং পরিবেশে মেট্রোরেলের অসামান্য প্রভাব পড়বে। মেট্রোরেল চালু হলে দুই জায়গায় প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি।
প্রথমত, সময় বাঁচবে। উত্তরা থেকে কমলাপুর যেতে এখন ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগে। মেট্রোরেল হলে সময় লাগবে মাত্র ৩৮ মিনিট। এই সময়ের মধ্যেই ১৭টি স্টেশনের প্রতিটিতে ৩০-৪৫ সেকেন্ড থামবে। এই বেঁচে যাওয়া সময় অন্য ব্যক্তিগত ও সামাজিক কাজে লাগাতে পারবে মানুষ।
দ্বিতীয়ত, তখন শহরে জ্বালানি পোড়ানো অনেক কমে যাবে। এতে ঢাকার পরিবেশের উন্নয়ন হবে। ঢাকায় কেবল মেট্রোরেল প্রতিদিন ৫ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেট্রোরেল চালু হলে মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে, সময় কম লাগবে, কর্মক্ষমতা বাড়বে, ভোগান্তিও কমবে। ফলে মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট এলাকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ হবে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে মেট্রোরেল এলাকায় জমির দাম বেড়েছে। বড় বড় ভবন হচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও বসে নেই, তারা পরিকল্পনা অনুসারে নতুন নতুন অফিস ও কারখানা তৈরি করছেন। মেট্রোরেলের এলাকা ছাড়িয়ে আশুলিয়া, বেড়িবাঁধ ও উত্তরা এলাকায় কারখানা করছেন শিল্পপতিরা। জমি কিনছেন, এলাকার চেহারাই পাল্টে যাচ্ছে।
তবে বেশ কিছু শঙ্কার কথা উল্লেখ্য করে পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আগামী ১০ বছর এসব এলাকায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাদের এসব এলাকায় টিকিয়ে রাখতে পরিকল্পনা নিতে হবে। মেট্রোরেল চালু হওয়ার আগেই ধনীরা এসব এলাকায় চলে এসেছেন। ফলে উন্নত দেশের মতো নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে এই এলাকায় রাখতে বিশেষ সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন।
মেট্রোরেলের আশপাশে ব্যাপক যানজটের আশঙ্কা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে যে ট্রান্সপোর্ট ও মোবিলিটি প্ল্যান করার দরকার ছিল সেটা করা হয়নি। শুধু বিআরটিসির কয়েকটি বাসের উপর নির্ভর না করে মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোতে যানবাহন রাখতে হবে। আগারগাঁওসহ স্টপেজগুলো থেকে নামার ডেসপাজ হবে কীভাবে, সেটার জন্য পর্যাপ্ত গাড়ির ব্যবস্থা নেই। ফলে এ জায়গাটাতেও সংকট হতে পারে।
এক নজরে মেট্রোরেল প্রকল্প
মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালে। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি হয় পরের বছর। মূল কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। পুরো মেট্রোরেল পথের দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পথের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এ পথে ৯টি স্টেশন রয়েছে। উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ি), উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত স্টেশন রয়েছে সাতটি—বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, টিএসসি, প্রেসক্লাব ও মতিঝিল। অবশ্য মেট্রোরেল কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার সম্প্রসারণ করা হবে। মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল আগামী বছরের শেষ দিকে চালুর কথা রয়েছে। কমলাপুর পর্যন্ত চালু হতে ২০২৫ সাল লেগে যেতে পারে।
ডিএমটিসিএলের তথ্য মতে, মেট্রোরেল ছুটবে সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে। শুরুর দিকে রাজধানীর উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও যেতে সময় লাগবে প্রায় ২০ মিনিট। পরে যাত্রার সময় ১৬ থেকে ১৭ মিনিটে নেমে আসবে।
আরএম/এমআই/এসকেডি