মেট্রোরেলে সমন্বিত উন্নয়ন না হওয়ায় সেবাও কাঙ্ক্ষিত হবে না
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক। ঢাকার মেট্রোরেল, হাতিরঝিল প্রকল্পসহ উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক এবং কুড়িল ইন্টারচেঞ্জের পরিকল্পনাকারী তিনি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক এ পরিচালক বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির পুরকৌশল বিভাগে অধ্যাপনা করছেন।
সম্প্রতি তিনি মেট্রোরেলের পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয়তার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্ট : মেট্রোরেল দেশের জন্য কেন জরুরি ছিল?
ড. এম শামসুল হক : আমাদের দেশে গণপরিবহনের যে চাহিদা রয়েছে তা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পর্যাপ্ত নয়। বিশেষ করে পিক আওয়ারে অফিসগামী যাত্রীদের সমস্যা প্রকট হয়। এর একটাই টেকসই সমাধান ‘পরিকল্পিত গণপরিবহন ব্যবস্থা’।
আরও পড়ুন : মেট্রোরেলের ভাড়ায় আপত্তি বিএনপির
গণপরিবহনের সংজ্ঞা অনুযায়ী, আমরা আমাদের দেশের বাস সার্ভিসকে বুঝি। কিন্তু এ বাস আসলে সার্ভিস নয় বরং সমস্যা। সেই হিসেবে একটা ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ হলো এ মেট্রো। যেটা স্বতন্ত্রভাবে চলবে। পিক আওয়ারে যতই চাহিদা বাড়ুক সে বগি ও গতি বাড়িয়ে চাহিদাকে সামাল দিতে পারবে। এটা পরীক্ষিত একটা প্রক্রিয়া। সে কারণে আমাদের দেশেও এ সেবার প্রস্তাব করা হয়। জনজীবনকে আরও সহজ ও গতিশীল করতে মেট্রো একটা ভালো বিকল্প।
ঢাকা পোস্ট : আমাদের দেশে সাধারণ ট্রেন পরিচালনাতেই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকা এবং রক্ষণাবেক্ষণের ব্যর্থতা স্পষ্ট। সেক্ষেত্রে মেট্রোরেলের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু?
ড. এম শামসুল হক : দূরপাল্লার সাধারণ রেলসেবা ও মেট্রোরেল— এ দুই সেবার ধরন ভিন্ন। মেট্রো প্রকৃতপক্ষে সেবাধর্মী ও শহুরে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এটা ঘন ঘন বিভিন্ন স্টেশনে থামবে এবং শহরের মাঝেই সেবা দেবে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে এ ধরনের সেবা সরকার দেয় না।
সরকারি জনবল কখনোই এ সেবা দিতে পারে না— এটা শতভাগ পরীক্ষিত। এসব ক্ষেত্রে সরকার অবকাঠামো তৈরি করে দেবে। সেবাটা দিতে হবে বেসরকারিভাবে। কারণ, বেসরকারি সংস্থা প্রয়োজনে যেকোনো সময় জনবল পরিবর্তন করতে পারে। তাদের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না, জনবল নিয়োগের সময় কোনো চাপ থাকে না। ফলে, উন্নত সেবা নিশ্চিত করা সহজ হয়।
আরও পড়ুন : মেট্রোরেল-কেন্দ্রিক অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়ার তাগিদ
অর্থাৎ, সরকারিভাবে গড়ে ওঠা অবকাঠামোতে বেসরকারিভাবে সেবা দেওয়া হয়। যেমন- মোবাইল সেবা কিন্তু বাঙালিরা দিচ্ছে না; বাইরের প্রতিষ্ঠান দিচ্ছে। টিঅ্যান্ডটি তো পারছে না সেবা নিশ্চিত করতে। কিন্তু সেখানে গতানুগতিক কিছু সুবিধাভোগী বসে আছেন। যাদের দায় বা দায়িত্ব নেই, পারফরম্যান্সও দেখাতে হয় না। এটা আসলে উদাহরণও নয়। জনগণকে সেবা দিতে হলে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে বিদেশে যারা এ ধরনের সেবা দিচ্ছে তাদের নিয়ে এসে সেবা দিতে পারলে টেকসই হবে।
যদি এখানে সরকার নিজে পরিচালনা করতে যায় তাহলে অবশ্যই পারফরম্যান্সের ঘাটতি হবে। কারণ, সেবা সরকারিভাবে কখনওই দেওয়া যায় না। এটা স্পেসিফিকেশনের মধ্যেই নাই। সরকারিভাবে যে ২৪ ঘণ্টা খাটবে তার মুনাফা কি সে পাবে? নিশ্চয়ই পাবে না। ফলে, সেখানে সেবাদানে ত্রুটি দেখা দেবে। সুতরাং, সেবা মানেই প্রাইভেট ও মুনাফা-নির্ভর। এখানে মুনাফা বৃদ্ধির জন্য রাইডারশিপ বাড়াতে হবে।
রাইডারশিপ বাড়াতে সেবাটা হাসিমুখে দিতে হবে। হাসিমুখে সেবা দেওয়ার জন্য যাকে বেসরকারিভাবে নিয়োগ করা হবে সে যদি কাজ না করে তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাবে। কিন্তু সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায় না। এ প্রক্রিয়ায় একটা অথর্বকে দেখে আরও ১০টি অথর্ব তৈরি হয়। এটা অবিতর্কিত বিষয় নয়। সুতরাং, এখানে যদি আমরা সরকারিভাবে এটা পরিচালনা করতে চাই তবে সেটা সেবা হবে না বরং জোড়াতালি হবে।
ঢাকা পোস্ট : দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি বারবার খবরের শিরোনাম হয়েছে। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎচালিত মেট্রোরেল পরিচালনা করতে নতুন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজন আছে কি না?
ড. এম শামসুল হক : না। মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য নিজস্ব সাব-স্টেশন থাকবে। ফলে, এটা পরিচালনায় যে শক্তির প্রয়োজন হবে সেটা ডেডিকেটেড হবে। এটাই হচ্ছে মুড অব অপারেশন। শহরের ভেতরে যেহেতু মেট্রোরেল ঘন ঘন চলবে সুতরাং এখানে যাতে বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ কম হয় সেদিকে খেয়াল রেখে ডিজেলের সেকেলে পদ্ধতি ছাপিয়ে এটা বিদ্যুতে পরিচালিত হবে। ফলে, শহরকে দূষণমুক্ত করতে হলে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সাব-স্টেশন স্থাপন করা হবে।
ঢাকা পোস্ট : শহরের যানজট নিরসনে মেট্রোরেল কেমন ভূমিকা রাখবে?
ড. এম শামসুল হক : একটা মেট্রো পুরো শহরের যানজট নিরসন করতে পারবে না। কিন্তু যখন একটা নেটওয়ার্ক তৈরি হবে তখন মূল্যায়নটা করা যাবে। তবে, মেট্রোরেল করিডোরে যারা বসবাস করছেন তারা অবশ্যই যাতায়াতে একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ পাবেন, নির্ভরযোগ্যতা পাবেন। যেটা ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি সংকট। আমাদের দেশে নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে যাওয়া যাবে, এটা কেউই বলতে পারে না। এমনকি ভিআইপি মুভমেন্টও করতে পারে না। যেহেতু, মেট্রোরেল স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হবে সেহেতু নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তিতে এটা গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। এ নির্ভরযোগ্যতাই মানুষ পছন্দ করবে। তারা স্বাচ্ছন্দ্যে দ্রুতগতিতে যেতে পারবে। এক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে পৌঁছানো নিয়ে যাত্রীদের মাথাব্যথা থাকবে না।
তবে, মেট্রো অনেকের জন্য পরিপূর্ণ সেবা দিতে পারবে না। কারণ, নির্ধারিত রুট থাকায় দোরগোড়ায় সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে বাসা থেকে আসতে হবে ভিন্ন একটা বাহনে। তারপরও গন্তব্যে সরাসরি যাওয়া যাবে না। এজন্য উন্নত দেশগুলোতে মেট্রোকে একটা সমন্বিত উন্নয়ন কাঠামোর মধ্যে আনা হয়েছে। সেসব দেশে স্টেশনের পাশেই মিনিবাস, অলিগলি হলে ছোট মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা থাকে। সেখানে যাত্রীদের দরজা থেকেই নিয়ে আসা হয়। যে টিকিটে যাত্রীদের নিয়ে আসা হয় সেই টিকিটেই তারা মেট্রো ভ্রমণ করতে পারেন। এর মাধ্যমে মেট্রোরেল থেকে কাঙ্ক্ষিত উপকারিতা মেলে।
অন্যথায় মেট্রো স্টেশনে নেমেই আবার রিকশা, সিএনজি ও বাইক খুঁজতে খুঁজতে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। সুতরাং, পরিকল্পিতভাবে মেট্রো গড়ে উঠলে এবং উঠা-নামার জন্য স্টেশনে যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা দেওয়া গেলে মেট্রো স্টেশন থেকে দূরের যাত্রীরাও সেবাগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করবেন। কিন্তু সেগুলো এখানে সমন্বিতভাবে করা হয়নি। সেই হিসেবে মেট্রো থেকে অর্থনৈতিক রিটার্নের যে অংশ দৃশ্যমান হবার কথা সেটা একটা প্রকল্প দিয়েই হবে না। যেহেতু মেট্রোরেলে সমন্বিত উন্নয়ন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি সেহেতু সেবাও কাঙ্ক্ষিত হবে না।
ঢাকা পোস্ট : এ প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে পরিবর্তন আসবে কি?
ড. এম শামসুল হক : অর্থনৈতিক পরিবর্তন খুব একটা দেখা যাবে না। তবে, মানুষের প্রতিদিনের যে কর্মঘণ্টার ক্ষতি ও পরিবেশ দূষণ হচ্ছে তা থেকে কিছুটা পরিবর্তন আসবে। এখানে দৃশ্যমান কোনো অর্থনৈতিক লাভ, সেভাবে আসবে না। একজন চাকরিজীবী তার অফিসে যেতে বাস ধরতে বা দৌড়াতে এনার্জি লস করবেন, অফিসে গিয়ে ক্লান্তিবোধ করবেন, কাজের উদ্দীপনা হারাবেন— এ সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও বের হয়ে আসা যাবে।
ঢাকা পোস্ট : মেট্রোরেল রক্ষণাবেক্ষণে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির সক্ষমতা সম্পর্কে জানতে চাই…
ড. এম শামসুল হক : সেবা যদি বেসরকারি সংস্থা দেয় তাহলে শুধু সার্ভিস নয়, রক্ষণাবেক্ষণও তার দায়িত্বে থাকে। একটা বেসরকারি সেবা সংস্থায় দক্ষ জনবল যেমন লাগে তেমনি এর রক্ষণাবেক্ষণেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটা পরিচালনার সফল উদাহরণ হচ্ছে বেসরকারি সংস্থাকে এর দায় দিয়ে দেওয়া। তা না হলে সরকারিভাবে পরিচালনায় যাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে তারা যেমন দায়িত্ব পালনে নয়-ছয় করবে তেমনি যে যন্ত্রাংশ লাগবে না সেগুলো আমদানি করে পত্রিকার শিরোনাম হবে। অবশেষে অবস্থা হবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স অথবা বাংলাদেশ রেলওয়ের মতো। অনেকটা দেউলিয়ার পথে হাঁটবে। সুতরাং, সরকার যদি এটা নিজে চালাতে চায় তবে সেটা বড় ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত হবে।
ঢাকা পোস্ট : সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. এম শামসুল হক : আপনাকেও ধন্যবাদ। ঢাকা পোস্টের জন্য শুভকামনা।
এমএম/এমএআর/