মেট্রোরেল-কেন্দ্রিক অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়ার তাগিদ
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর চালু হচ্ছে রাজধানীবাসীর স্বপ্নের মেট্রোরেল। আগামী ২৮ ডিসেম্বর এর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেট্রোরেল চালু হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে অফিসগামী মানুষদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হবে না, যা সরাসরি দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে।
মেট্রোরেল ব্যবহারের মাধ্যমে যোযোগ প্রক্রিয়ায় সফলতা আনার জন্য পারিপার্শ্বিক অন্যান্য সেবা বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন>>চাকা ঘোরার অপেক্ষায় মেট্রোরেল
মেট্রোরেলের আনুষ্ঠানিক কাজ শুরুর পর থেকে রাজধানীর ব্যস্ত সড়কগুলো সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল। দিনের পর দিন চলাচলে নাজেহাল হতে হয়েছে নগরবাসীকে। মেট্রোরেলের উদ্বোধনের মাধ্যমে সে সব বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে রাজধানীবাসী। তবে উপরে মেট্রোরেলে চলাচল করার পর যখন নগরবাসী স্টেশন থেকে নিচের সড়কে নামবে তখন যাত্রী চলাচলের জন্য ভালো ব্যবস্থা দরকার। সেদিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন>>‘প্রসব বেদনা’ ভুলতে মুখিয়ে মিরপুরবাসী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মাদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেট্রোরেল ঢাকা শহরের জন্য অনেক বড় ব্যাপার। পুরো লাইনটা একবারে চালু করা গেলে ব্যাপক প্রভাব দেখা যেত। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত রুটে খুব বেশি উপকৃত হবেন না যাত্রীরা। চালুর প্রথম দিন থেকেই ফার্মগেট পর্যন্ত আসতে পারলেও আমরা বড় একটা ইমপ্যাক্ট দেখতে পারতাম। তবে মেট্রোরেল শুরুর অনেক ইমপ্যাক্ট আছে। অর্থনীতি এবং আবাসনের ইফেক্ট কিন্তু এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে।
এ পরিকল্পনাবিদ বলেন, মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্পের পরিকল্পনা আমরা করতে পেরেছি। কিন্তু মেট্রোরেল কেন্দ্রিক আরও পারিপার্শ্বিক প্ল্যানগুলো আমারা করতে পারিনি। এছাড়া মিরপুর থেকে দিয়াবাড়ির দিকে মধ্যবিত্ত, নিম্ন, নিম্ন মধ্যবিত্ত এ শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বেশি। এখন সেখানে যখন বড় ধরনের ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে তখন সেসব মানুষকে সরে যেতে হচ্ছে; কারণ সেখানে বড় বড় কোম্পানি, প্রভাবশালীরা ঢুকে যাচ্ছে, জমির দাম বাড়ছে, জীবনযাত্রার ব্যয় সেখানে বেড়ে যাচ্ছে। সেগুলোকে চিহ্নিত করে মেট্রোরেল কেন্দ্রিক সকলের জন্য আমরা পরিকল্পনা করতে পারিনি। সরকারের পক্ষ থেকে সবার দিক বিবেচনায় দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা দরকার।
আরও পড়ুন>>আধুনিক প্রবেশ ব্যবস্থা, প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে পারবেন শুধু টিকিটধারী
তিনি বলেন, মেট্রোরেল থেকে নামার পর বিআরটিসির কয়েকটা বাসের উপর নির্ভর করলে তো আর চলবে না। এটার জন্য সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন দৃশ্যমান করতে হবে। এখন যেটা হয়েছে তা হলো পয়েন্ট এ থেকে পয়েন্ট বি-তে যাত্রীদের স্থানান্তর করা হবে। এক্ষেত্রে অর্থনীতি সুফল বলতে সমাজের প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে। যেমন ট্রাফিক জ্যামের কারণে আমাদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, সেটা কমে আসবে নির্দিষ্ট এ রুটে। দিয়াবাড়ি, মিরপুর, আগারগাঁও এলাকায় কিছু কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, ফলে অর্থনীতি জেনারেট করবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিটি খাতে ভূমিকা রাখবে মেট্রোরেল।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের(বুয়েট) অধ্যাপক এবং যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক বলেন, একটি মেট্রো পুরো শহরের যানজট নিরসন করতে পারবে না। কিন্তু এটার একটি নেটওয়ার্ক যখন হবে তখন মূল্যায়নটা করা যাবে। তবে মেট্রোরেল করিডোরে যারা বসবাস করছেন তারা অবশ্যই যাতায়াতে স্বাচ্ছন্দ্য ও নির্ভরতা পাবেন। তারা স্বাচ্ছন্দ্যে দ্রুত গতিতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারবেন। গণপরিবহনের সংজ্ঞা অনুযায়ী, আমাদের দেশে বাস সার্ভিসকে বুঝি। কিন্তু এ বাস আসলে সার্ভিস নয় বরং সমস্যা। সেই হিসাবে একটি ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ এ মেট্রোরেল। যেটা স্বতন্ত্রভাবে চলবে। পিক আওয়ারে যতই চাহিদা বাড়ুক সে বগি ও গতি বাড়িয়ে চাহিদা সামাল দিতে পারবে। এটা পরীক্ষিত একটি প্রক্রিয়া।
আরও পড়ুন>>বিদ্যুতে চলবে মেট্রোরেল, প্রতিদিন লাগবে ৮০ মেগাওয়াট
এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে এ যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, মেট্রো প্রকৃতপক্ষে সেবাধর্মী ও একটি শহুরে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এটা ঘনঘন বিভিন্ন স্টেশনে থামবে এবং শহরের মাঝেই সেবা দেবে। এক্ষেত্রে সরকার অবকাঠামো তৈরি করে দেবে। কিন্তু এই সেবাটা দিতে হয় বেসরকারিভাবে। উন্নত সেবা নিশ্চিত করে জনগণকে সেবা দিতে হলে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে বিদেশে যারা এ ধরনের সেবা দিচ্ছে তাদের নিয়ে এসে সেবা দিতে পারলে সেটি টেকসই হবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী যাত্রী সেবা নিশ্চিত করতে মেট্রোরেলের ভাড়া ৫০ শতাংশ কমানোর দাবি জানিয়ে বলেন, কলকাতায় মেট্রোরেলের ভাড়া সড়ক পরিবহনের তুলনায় সবচেয়ে কম। কলকাতায় মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ রুপি বা ৬ টাকা। আর ঢাকায় মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। বাড়তি ভাড়া নির্ধারণ করায় যাত্রী স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সামর্থ্যহীন যাত্রীসাধারণ মেট্রোরেল ব্যবহারের সক্ষমতা হারাবে। তাই মেট্রোরেলের ভাড়া আরও কমানো উচিত।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ বলেন, ইতোমধ্যে দিয়াবাড়ি থেকে মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যিক আবাসন প্রকল্পগুলো কাজ করছে। এটা একটা বড় পরিবর্তন। এখানে পজিটিভ দিক অবশ্যই আছে, তবে চ্যালেঞ্জও আছে। মেট্রোরেলের লক্ষ্য ছিল বিকেন্দ্রীকরণ। কিন্তু মিরপুর এলাকাসহ যেসবে আন্ডার ডেভেলপিং ছিল সেগুলোতে এখন নতুন করে ফের পপুলেশন হবে। তবে আমরা যে ডিসেন্ট্রালাইজেশন হওয়ার কথা মনে করেছিলাম সেটা হয়ত আর হবে না। এই কন্ট্রোলটা মেট্রোরেল করতে পারেনি। রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি ঘটাতে মেট্রোরেল বেশ ভালো ভূমিকা পালন করবে। তবে এই রেল লাইনকে কেন্দ্র করে যেভাবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে সেদিকে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত। এছাড়াও রেলের ১৬টি স্টেশনকে কেন্দ্র করে অনেক ধরনের ছোট ব্যবসা গড়ে উঠবে এই কারণে যেন ওইসব এলাকা বসবাসের অনুপযোগী না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
আরও পড়ুন>>‘স্বপ্নের বাহন’ মেট্রোরেলের ভেতরটা দেখতে কেমন?
এ বিষয়ে ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, যাত্রীদের ওঠানামা ও আসনে বসা, এসব বিষয়ে অভ্যস্ত ও পরিচিত করাতে স্টেশনে ট্রেন কিছুটা বাড়তি সময় দাঁড়াবে প্রথম অবস্থায়। পরে ট্রেনের সংখ্যা বাড়বে এবং স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ানোর সময়সীমা কমে আসবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সবগুলো লাইন বাস্তবায়িত হলে ঢাকার যানজট কমে যাবে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
মেট্রোরেলে মোট ১৬টি স্টেশন থাকবে। উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, টিএসসি, প্রেসক্লাব এবং মতিঝিল। তবে আপাতত উত্তরা থেকে আগারগাঁও স্টেশন পর্যন্তই চালু হচ্ছে। পরবর্তীতে তা মতিঝিল পর্যন্ত চলাচল করবে।
আরও পড়ুন>>কমবে ভোগান্তি বাঁচবে সময়, অপেক্ষায় চাকরিজীবী-শিক্ষার্থীরা
প্রথমে চালু হওয়া অংশে মেট্রোরেলের স্টেশন থাকবে মোট ৯টি। এতে ভাড়া পড়বে প্রতি কিলোমিটার ৫ টাকা। তবে সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার একবার অতিক্রম করতে সময় লাগবে ২০ মিনিট।
এএসএস/এসকেডি