‘সন্তান পেটে ধারণ করার পর থেকে একজন মা দীর্ঘ নয় মাস যেমন লড়াই করেন, ভোগান্তি পোহান, তেমনি সব রকম ভোগান্তি ও কষ্ট সহ্য করেছে মিরপুরবাসী। আর সন্তান জন্মদানের পর তার মুখ দেখে যেমন সব কষ্ট ভুলে যান মা, তেমনি আমরাও এখন দীর্ঘ সময়ের বেদনা ভুলে প্রস্তুত মেট্রোরেলকে গ্রহণ করতে।’

মেট্রোরেল উদ্বোধন হওয়ার খবরে এভাবে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লাহ। শুধু এ সংসদ সদস্যই নন, উন্নয়ন আর পরিবর্তনের প্রত্যাশায় দীর্ঘদিনের দুঃখ-কষ্ট ভুলতে চান মিরপুরের সব বাসিন্দা।

দেশের প্রথম মেট্রোরেল উদ্বোধনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তিনদিন পর আগামী ২৮ ডিসেম্বর প্রথম ধাপে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আরও পড়ুন : চাকা ঘোরার অপেক্ষায় মেট্রোরেল

মেট্রোরেল চালু হচ্ছে। এর উপকার বা সুফল কতটুকু পাবে মিরপুর এলাকা?

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মিরপুর-১০ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের নিচের মূল সড়কে এখনো চলছে সংস্কার কাজ। কোথাও কোথাও খানাখন্দ-ভাঙা রাস্তা। মিরপুর শেওড়াপাড়া-কাজীপাড়া এলাকার অলিগলির পথের অবস্থা আরও খারাপ। ফলে মেট্রোরেলের স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

পুরো মেট্রোরেল পথের দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পথের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এ পথে ৯টি স্টেশন রয়েছে। উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ি), উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও।

মিরপুর ১৩ নং ওয়ার্ডের কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহমান বলেন, মূল সড়কে কাজ চলছে, মেট্রোরেলের কাজও শেষ পর্যায়ে। কিন্তু অলিগলির অবস্থা খারাপ।

তিনি বলেন, কল্যাণপুর, পীরেরবাগের কেউ কাজীপাড়া স্টেশনে এসে মেট্রো রেলে চড়তে চাইলে তাকে ভুগতে ভুগতে আসতে হবে। এর সমাধান জরুরি। অবশ্যই মেট্রো রেলের কারণে এই এলাকার আমূল পরিবর্তন আসবে, জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। খরচাও বাড়বে বাসিন্দাদের। আশা করছি এতদিনের যে ভোগান্তি হয়েছে, এই মেট্রোরেল চালু হওয়ার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবক্ষেত্রে মিরপুরবাসীর সুদিন ফিরে আসবে।

উত্তরা থেকে আগারগাঁও পৌনে ১২ কিমি পথে স্টেশন ৯টি

পুরো মেট্রোরেল পথের দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পথের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এ পথে ৯টি স্টেশন রয়েছে। উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ি), উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও।

এর মধ্যে ছয় স্টেশনের সুবিধা পাবে মিরপুরবাসী। এগুলো হলো- পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও।

আরও পড়ুন : মেট্রোরেল : মিরপুর-উত্তরার ফ্ল্যাট আগ্রহী ক্রেতারা

আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন ২৪ সেট ট্রেন নিয়ে শুরু হবে এমআরটি লাইন-৬ এর যাত্রা। প্রতি সেট ট্রেনে প্রাথমিকভাবে ৬টি করে কোচ থাকবে। যাতে পরবর্তী সময়ে আরও ২টি কোচ যোগ করে কোচের সংখ্যা ৮টিতে উন্নীত করার ব্যবস্থা থাকবে।

আরও পড়ুন : মেট্রোরেল উদ্বোধন : ভায়াডাক্ট সংলগ্ন এলাকায় ৭ নির্দেশনা

মেট্রোরেল চালুর কারণে কতটুকু উপকৃত হবে কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়ার মানুষ? জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা ও সাফান এক্সপ্রেস ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক মোর্শেদ বলেন, মেট্রোরেল আমাদের জন্য খুবই উপকারি হবে। আমরা দ্রুত গন্তব্যে যেতে পারব। সময় বাঁচবে ও খরচ কমবে।

উত্তরার হাউজবিল্ডিং এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট্যান্ট আশরাফ আলী বলেন, আমার বাসা এখানে। নিজের গাড়িও আছে। কিন্তু যে পরিমাণ যানজট প্রতিদিন ঠেলে যেতে হয় তা অবর্ণনীয়। মেট্রোরেল চালু হলে আমার জ্বালানি খরচ ও সময় বাঁচবে। যানজট ভোগান্তিও থাকবে না। দিয়াবাড়ী নেমে ৩০ টাকা খরচায় পৌঁছাতে পারব গন্তব্যে। প্রথম প্রথম হয়তো অনেকের অসুবিধা হবে। তবে পুরো মেট্রোরেল চালু হলে তা আর থাকবে না।

আরও পড়ুন : পরিকল্পিত মেট্রোরেল কেন জরুরি

উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইসমাইল মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ওয়ার্ডের মধ্যেই মেট্রোরেলের স্টেশন কাজীপাড়া। কিন্তু এর অলিগলি পথ সব সরু। ৮/১০ ফিটের বড় প্রশস্ত রাস্তা নেই। জলাবদ্ধতা লেগেই থাকত। মেট্রো রেলের ওঠার সুবিধা পেতে হলে এই অলিগলি পথ প্রশস্ত করা প্রয়োজন। আমরা এই কাজটা মেয়র মহোদয়ের নির্দেশে শুরু করেছি।

তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ১৭৭টা বাড়ির সীমানা প্রাচীর ভেঙেছি। আদর্শ রোড, মোল্লা রোডসহ ৮/১০ ফিটের সড়ক প্রশস্ত করছি ১৭/১৮ ফিট পর্যন্ত। আগামী ২ সপ্তাহের মধ্যে এসব রাস্তা প্রশস্ত করা হবে। এরপর মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে পূর্ণসংস্কার করা হবে। এরফলে বড়বাগ, মনিপুর, পীরেরবাগসহ আশপাশের ওয়ার্ড থেকে মেট্রোরেল স্টেশনে যাতায়াত করতে পারবেন। আমরা চাই সর্বোচ্চ সুবিধাটাই নিশ্চিত করতে।

প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে এ কাউন্সিলর বলেন, মিরপুরের এ অংশটা অপরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। কিন্তু মিরপুরই পাচ্ছে মেট্রো রেলের সুবিধা। বিশ্বে যেখানে মেট্রোরেল হয়েছে তার আশপাশের এলাকার জীবনযাত্রার চিত্র বদলে গেছে। আমরাও সেই স্বপ্ন দেখছি।

কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়ায় রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে জীবিকা চালানো বগুড়ার হাফিজুর রহমানের ভাবনা ভিন্ন রকম।

তিনি বলেন, মূল সড়কে রিকশা চালাতে পারি না। অলিগলির অবস্থা খুব খারাপ। তবে মেট্রো রেলের কারণে সড়কে যানজট কমবে, অলিগলি সড়ক বদলে যাবে। বাসা থেকে মেট্রো রেল স্টেশন পর্যন্ত আসা যাত্রীদের অধিকাংশই চলবেন রিকশায়। সে হিসেবে আমরা ভাগ্যবান। আমাদের যাত্রী বাড়বে।

ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেট্রোরেলের পুরো সুবিধাভোগীদের যাতায়াতের জন্য ইস্টার্ন হাউজিং বাদে পুরো এলাকার রাস্তাঘাটের কাজ পুরোপুরি শেষ করা হয়েছে। কালশীর ফ্লাইওভারের কাজও শেষ পর্যায়ে। মেট্রোতে উঠতে আর কোনো অসুবিধা হবে না।

তিনি বলেন, মেট্রোরেলের কাজ শুরুর পর থেকে আমরা ‘প্রসব বেদনা’র মতো ভুগেছি। অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে মিরপুরবাসীকে। একজন মা যেমন বোঝেন প্রসব বেদনা, সন্তান পেটে ধারণ করা কত কষ্টের, আমরাও তেমন করে বুঝতে পারি মেট্রোরেল নির্মাণের সময়টাতে কী পরিমাণ কষ্ট পেতে হয়েছে সবাইকে। এখন আমাদের কষ্ট লাঘবের সময়। আমি বিশ্বাস করি, মায়ের প্রসব বেদনা ভুলে বাচ্চা কোলে নেওয়ার অনুভূতির মতো মেট্রোরেলে উঠতে মুখিয়ে আছে মিরপুরবাসী।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্রে জানা গেছে, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের স্টেশন হবে নয়টি। এর ভাড়া প্রতি কিলোমিটার ৫ টাকা, সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। প্রথম দিকে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটারের এই পথে (উত্তরা নর্থ স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত) ভাড়া হবে ৬০ টাকা।

এই পথ চলতে মেট্রোরেল সময় নেবে ২০ মিনিট। পূর্ণমাত্রায় চালু হলে সময় কমে আসবে ১৬-১৭ মিনিটে। সর্বশেষ প্রযুক্তিতে তৈরি ছয় বগির ট্রেন সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে ছুটবে। জাপান সরকারের অর্থায়নে ঢাকাবাসীর স্বপ্নের মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি ডিএমটিসিএল।

জেইউ/এসএম