প্রত্যাবাসন বহু দূর, সীমান্তে নজর রাখতেই বছর পার
রোহিঙ্গা ইস্যুতে চলতি বছরের মাঝামাঝিতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশের শীর্ষপর্যায়ে কর্তাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অং সান সু চি-কে সরিয়ে ক্ষমতা নেওয়া জান্তা সরকারের সঙ্গে প্রায় দেড় বছর পর হওয়া ওই বৈঠক গতি হারিয়ে ফেলা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় কিছুটা আশার আলো দেখা যয়। কিন্তু বছর শেষে সেই আশার আলোও ফিকে হয়ে আসে।
বিদায়ী বছরে (২০২২) বহুল প্রত্যাশিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন তো হয়ইনি, উল্টো মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টারের আন্তর্জাতিক সীমানা লঙ্ঘন, মর্টারের গোলা পড়ার মতো ঘটনা চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে বাংলাদেশ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কপালে। এরপরও সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা- সীমান্তে শান্তি আসবে, রোহিঙ্গারা তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে পারবে।
বিজ্ঞাপন
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। তবে, বাংলাদেশের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে প্রত্যাবাসন। এ কারণে বাংলাদেশ কূটনৈতিক উপায়ে সংশ্লিষ্ট সবগুলো চ্যানেলে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
আরও পড়ুন>> সাগরে ভাসছে ২০০ রোহিঙ্গা, বাঁচানোর আকুতি আসিয়ানের
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ জটিল পরিস্থিতির কারণে গত কয়েক মাস সীমান্তে আমাদের কড়া নজরদারি রাখতে হয়েছে। স্থানীয়দের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা বেশ উদ্বেগে ছিলাম। সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং আমাদের লোকদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি একটু আড়ালে চলে যায়। এরপরও আমাদের অব্যাহত উদ্যোগ এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় তাদের সহায়তা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে— বলেন ওই কর্মকর্তা।
মন্ত্রণালয়ের অপর এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর দুই দেশের মধ্যে সচিবপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদলের আসার কথা ছিল। কিন্তু মাসখানেক পার হলেও তাদের আসার বিষয়ে দেশটির সরকার আর কিছু জানায়নি। এর মধ্যে মিয়ানমারে ঝামেলা শুরু হয়। দেশটির বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে সামরিক সরকার। সংঘর্ষের জেরে আমাদের সীমান্তে মর্টার শেল পড়া শুরু করে। সীমান্তের নিরাপত্তা জোরদার করতে হয় আমাদের।
‘পরবর্তীতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে কয়েক দফা ডাকা হয়। তাতেও কাজ না হলে চীন, জাপান ও আসিয়ানভুক্ত দেশসমূহসহ ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি মিশনের রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনারদের সহযোগিতা চাওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত জাপানের সহযোগিতায় সীমান্ত পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়।’
আরও পড়ুন>> রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন নীরবে কাজ করছে : রাষ্ট্রদূত
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নেওয়ার বিষয়টি মিয়ানমারের কূট চাল কি না এবং নতুন বছরে (২০২৩ সাল) রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্ভব কি না— জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তারা তো নানা ধরনের টালবাহানা শুরু থেকে করে আসছে। চলতি বছর (২০২২ সাল) রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আর কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ১৪ জুন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের পঞ্চম সভা অনুষ্ঠিত হয়। শীর্ষপর্যায়ের ওই ভার্চুয়াল সভায় ঢাকার পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। অন্যদিকে, নেইপিদোর পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব উ-চান আয়। ওই সভায় সীমিত আকারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর কথা ঢাকাকে জানায় তারা। একই সঙ্গে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার কাজ চালিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেয় দেশটি। বাংলাদেশও আশার আলো দেখতে থাকে।
শীর্ষপর্যায়ের ওই সভায় নিইপিদো জানিয়েছিল, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে বাংলাদেশে একটি প্রতিনিধিদল পাঠাবে। তবে, মাসখানেক কেটে গেলেও প্রতিনিধিদল পাঠানোর বিষয়ে কোনো বার্তা দেয়নি দেশটি। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে জুলাইয়ে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী ও আরাকান আর্মির যুদ্ধ বাধে। সেই যুদ্ধের আঁচ লাগে বাংলাদেশেও। সীমান্তের ওপারে চলা গোলাগুলি এ পারের কক্সবাজার ও বান্দরবান অংশের স্বাভাবিক অবস্থার ব্যাঘাত ঘটে।
সীমান্তে অস্থিরতার কারণে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকার স্থানীয়দের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে পড়ে সরকার। কারণ, মিয়ানমার থেকে কয়েক দফায় মর্টার শেল এসে পড়ে বাংলাদেশের ভেতরে। এর মধ্যে একটি মর্টার শেল এসে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখায় পড়ে। মারা যান এক রোহিঙ্গা যুবক। আহত হন এক শিশুসহ পাঁচ রোহিঙ্গা।
আরও পড়ুন >> রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় সহায়তা অব্যাহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশ সরকার সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়ে-কে এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে চারবার তলব করে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। তবে, ঢাকার পক্ষ থেকে কূটনৈতি চ্যানেলে সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় নিযুক্ত আসিয়ান দূতদের নিয়ে বৈঠক করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরপর জাপান, ভারতসহ পশ্চিমা দূতদের নিয়ে বৈঠকে বসে ঢাকা। বৈঠকে সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দেশগুলোর সহযোগিতা চাওয়া হয়। সেই বৈঠকে চীনকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু বৈঠকে অংশ নেননি দেশটির রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।
পরবর্তীতে চীনের রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে আলাদা করে বৈঠক করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠকের পর কয়েক দিন সীমান্ত পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত থাকে। তবে, পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। সীমান্তে মিয়ানমারের গোলাগুলিও চলতে থাকে।
তিন/চার মাস উত্তেজনা চলার পর বেশ নাটকীয়ভাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। মিয়ানমারে জাপানের ‘বিশেষ প্রতিনিধি’ ইউহেই সাসাকাওয়ার উপস্থিতিতে যুদ্ধ থামাতে রাজি হয় দেশটির সশস্ত্র বাহিনী ও আরাকান আর্মি। এতে সীমান্তে স্বস্তি নেমে আসে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা এর আগে দুবার প্রত্যাবাসনের খুব কাছাকাছি পৌঁছাই। কিন্তু একজনকেও (রোহিঙ্গা) ফেরত পাঠাতে পারিনি। মিয়ানমারের যথেষ্ট আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে কিছু সময় চলে গেছে। তবে, আমরা আশাবাদী রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে। আমরা চাই তারা দেশে ফিরে যাবে এবং উন্নত জীবন লাভ করবে।
আরও পড়ুন>> রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ৫টি প্রস্তাব তুলে ধরেছি
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল চার লাখের অধিক রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি।
২০১৮ সালের নভেম্বর এবং ২০১৯ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। ওই সময় রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা জানায় রোহিঙ্গারা। ফিরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা।
নিজ দেশে ফিরে যেতে না পারলেও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি বছরে ৩০০ থেকে ৮০০ রোহিঙ্গা নেবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের জনসংখ্যা, শরণার্থী ও অভিবাসন বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী জুলিয়েটা ভ্যালস নয়েসের সঙ্গে বৈঠক শেষে গত ৬ ডিসেম্বর এ তথ্য জানান তিনি। এর অংশ হিসেবে গত ৮ ডিসেম্বর সকালে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন ২৪ রোহিঙ্গা।
এনআই/এমএআর