বিএনপির রূপরেখা : ‘ইতিবাচক’ হলেও ‘সন্দিহান’ তারা
সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন সামনে রেখে দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামত’ শীর্ষক একটি রূপরেখা দিয়েছে। তাদের এই রূপরেখার কিছু প্রস্তাব ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখছেন সুশীল সমাজ। তবে, এর বাস্তবায়ন নিয়ে ‘সন্দিহান’ তারা।
বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গীরা ২৭ দফা রূপরেখা অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গীরা বলছেন, এটি বিএনপির স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতিকে পাকাপোক্ত করার একটি হাতিয়ার মাত্র।
বিজ্ঞাপন
গত সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে বিএনপির ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামত’ শীর্ষক ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করা হয়। সেখানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনা এবং দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া সংবিধান সংস্কারে কমিশন গঠন, দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ বেশকিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়।
বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখা প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কিছু দ্বিমত থাকলেও বিএনপির রূপরেখায় অনেকগুলো ভালো দিক আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- পরপর দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। এটি বেশ ইতিবাচক। আগে এটি থাকলে দেশে যে একনায়কতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদী শাসন, এটি হতো না।
‘দুর্নীতি, অদক্ষতা ও দলীয়করণের কারণে আমাদের শাসন ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। নিঃসন্দেহে এর মেরামত প্রয়োজন। এজন্য অনেকগুলো সংস্কার দরকার। আমরা দুর্ভাগা জাতি। এখানে রাজনৈতিক দলগুলো যখন বিরোধী দলে থাকে তখন তারা সংস্কারের পক্ষে। আওয়ামী লীগও বিরোধী দলে থাকতে ২৩ দফা দিয়েছিল। এগুলোর কোনোটা তারা মানেনি। কিছুটা হয়েছে। তবে, সেটি আওয়ামী লীগের প্রচেষ্টায় হয়নি।’
আরও পড়ুন >> বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখা হাস্যকর : আওয়ামী লীগ
‘কিছুটা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রচেষ্টায়, কিছুটা হয়েছে সুশীল সমাজের প্রচেষ্টায়। যেমন- নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য দেওয়া। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর একবার নির্বাচন কমিশনে গিয়ে বলেছিলেন, এই হলফনামা দেওয়া বন্ধ করতে। এখন নির্বাচন কমিশন এটি আর প্রকাশ করে না।’
২৭ দফা রূপরেখার বাস্তবায়ন সম্ভব কি না— জানতে চাইলে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রূপরেখার প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য লাগবে। একা আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি চাইলে পারবে না। এখন আমাদের একটা রাজনৈতিক সমঝোতা দরকার। সর্বোপরি সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। তা না হলে এটি করা যাবে না।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, বিএনপির ঘোষিত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখার অনেক বিষয় দলটির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ঘোষিত ভিশন ২০৩০-এ ছিল। জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা থেকেও কিছু নেওয়া হয়েছে।
‘এখানে দুটি বিষয় নতুন এসেছে। একটি হলো- জাতীয় সরকার গঠন, অন্যটি হলো- পরপর দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। এই দুটিকে আমি পজিটিভ প্রস্তাব হিসেবে মনে করি। এছাড়া তারা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কারের কথা বলেছেন, এটিও পজিটিভ দিক। দেশের অনেক লোক, শুধু আওয়ামী লীগ ছাড়া, তারা মনে করেন যে আমাদের সংবিধানের সংস্কার প্রয়োজন।’
আরও পড়ুন >> টানা দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়, আইনসভায় উচ্চকক্ষ
বাংলাদেশ এখন একটি সংকটের মধ্যে আছে— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এর থেকে উত্তরণের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন দরকার। যেটি বিএনপি তাদের রূপরেখায় বলেছে। সেই নির্বাচনে তারা জয়ী হলে জাতীয় সরকার গঠন করবে। সেই সরকারে আন্দোলনকারী দলগুলো থাকবে, যারা রূপরেখাগুলো বাস্তবায়ন করবে।’
রূপরেখার বাস্তবায়নের বিষয়ে এই অধ্যাপক বলেন, আসলে তারা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবে বা করবে সেটি ভবিষ্যতে দেখা যাবে। তবে, এটি নির্ভর করে নাগরিক সমাজ ও সুশীল সমাজের ওপর। যদিও এখন বাংলাদেশে কোনো সুশীল সমাজ নেই। তারা কোনো না কোনো পার্টির (দল) সঙ্গে জড়িত। তারপরও একটি দেশের সরকারকে অনেক কিছু করতে বাধ্য করতে পারেন নাগরিক ও সুশীল সমাজ। কাজটি তখনই তারা (সুশীল সমাজ) করতে পারেন, যখন দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে, আইনের শাসন থাকে।
সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির সঙ্গে আমাদের কোনো মিল নেই। তারা উভয়ই মুক্তবাজার অর্থনীতি বিশ্বাস করে। বিএনপির ঘোষণায় কি সমাজতন্ত্রের কথা বলা আছে? তারপরও আমি মনে করি, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের কাঠামোতে রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার বা মেরামত সম্ভব।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, বিএনপি যে স্বাধীনতাবিরোধী ও গণতন্ত্রবিরোধী রাজনীতি করছে, সেটি পাকাপোক্ত করতে তাদের এই রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের রূপরেখা। সংবিধান সংশোধনের যে কথা তারা বলছে, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে যে সংবিধান ছিল সেটিতে নিয়ে যাওয়াই তাদের পায়তারা।
এক ব্যক্তি পরপর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না— এমন প্রস্তাবনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এগুলো সাময়িক ব্যাপার। মৌলিক কোনো বিষয় নয়। তাছাড়া তাদের নেত্রী তো চারবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তখন তাদের বোধোদয় হয়নি? এখন কেন এই কথা বলছে।’
আরও পড়ুন >> সামনে ডাক আসছে : খন্দকার মোশাররফ
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা এবং নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘বিএনপির মতো পার্টি এই ধরনের কমিটমেন্ট করেছে, এটা তো ভালো। তাদের রূপরেখায় আমরা একটা গুণগত পরিবর্তনের চেষ্টা দেখছি। তারপরও রূপরেখার ভেতরে কী আছে সেটি নিয়ে আলোচনা করব। তবে, আমরা চেয়েছি তারা এটা জনসম্মুখে প্রকাশ করুক।’
গণতন্ত্র মঞ্চের আরেক নেতা এবং গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে শাসন ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কথা আমরা বলে আসছি। বিএনপি যখন আমাদের সঙ্গে সংলাপ করতে এসেছিল তখনও আমরা সাংবাদিকদের এসব কথা বলেছি। এখন বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব এসেছে। আমরা ইতিবাচক হিসেবে এটি নিয়েছি। তবে, আমরা বিএনপির এসব প্রস্তাব আরও সুনির্দিষ্টভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করব।’
‘এখন বল আওয়ামী লীগের কোর্টে। তারা রাষ্ট্রকাঠামো নিয়ে ভাবেন কি? তারা রাষ্ট্রকে একটি গণতান্ত্রিক জায়গায় নিয়ে যেতে চান কি? নাকি চলমান জমিদারি চলবে? বাংলাদেশের মানুষ এই জমিদারি শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের আশা করে। তারা সেটি না করলে, দেশের মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে ভোটাধিকারসহ অপরিহার্য গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটাবে।’
আরও পড়ুন >> বিএনপি কি সংস্কারের নামে দেশকে মার্শাল ডেমোক্রেসিতে নিতে চায়?
বিরোধী দলে থাকলে সবাই রাষ্ট্রের সংস্কারের কথা বলে। আওয়ামী লীগও বিরোধী দলে থাকতে ২৩ দফা দিয়েছিল। সুশীল সমাজের এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সাকি বলেন, তাদের ২৩ দফার মধ্যে রাষ্ট্র-ব্যবস্থা সংস্কারের কোনো প্রস্তাব ছিল না। বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক সংকট চলছে। শাসন-ব্যবস্থার বদল না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। ফলে, এখন বিএনপি যেহেতু শাসন-ব্যবস্থার বদল চাইছে, সুষ্ঠু নির্বাচন-ব্যবস্থা চাইছে, তাই সংস্কারের কর্মসূচি দিয়েছে। এটি আওয়ামী লীগের দিক থেকেও আসতে বাধ্য। কারণ, আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় তাহলে তাদের নিরাপত্তার জায়গা কোথায়? শাসন-ব্যবস্থার বদল, ক্ষমতার ভারসাম্য— এগুলোর মধ্যে তো সবার নিরাপত্তা রক্ষিত।
বিএনপি-নেতৃত্বাধীন সাবেক ২০ দলীয় জোটের শরিক এবং বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, সরকারের দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী দুঃশাসনে বাংলাদেশের জনজীবন ও রাষ্ট্রকাঠামো সার্বিকভাবে ভেঙে পড়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, বিচার ও নির্বাচন-ব্যবস্থাসহ জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র চরমভাবে বিপর্যস্ত। এই সময় বিএনপির রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখা দেশবাসীর মনে স্বস্তি, সাহস ও আশা জাগিয়েছে। এটি অত্যন্ত সময়োপযোগী। দল-মত নির্বিশেষে সবার মতামত ও সম্মতির মাধ্যমে নেওয়া এই রূপরেখা একটি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রয়াস বলেই আমি মনে করি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২৭ দফা রূপরেখা নিঃসন্দেহে দেশের রাজনীতিতে আস্থা তৈরিতে রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করবে। দল-মত নির্বিশেষে জাতিগত ঐক্য গড়ে তুলতে ‘রেইনবো নেশন’-এর বিকল্প নেই। এছাড়া অন্যদের পক্ষ থেকে আরও কোনো প্রস্তাব আসলে সেটি যুক্ত হবে এই রূপরেখায়।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারলে সমমনাদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবে বিএনপি। সেই জাতীয় সরকার রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে অনেকগুলো সংস্কার আনবে। তেমন কিছু সংস্কার আর সিদ্ধান্তের কথা যুক্ত করে গতকাল সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) ২৭ দফা রূপরেখা দিয়েছে দলটি।
রূপরেখায় বলা হয়েছে-
১. বিগত এক দশকের অধিককাল ব্যাপী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার হীন উদ্দেশে অনেক অযৌক্তিক মৌলিক সাংবিধানিক সংশোধনী এনেছে। একটি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করে সকল বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনগুলো পর্যালোচনা করে এসব রহিত/সংশোধন করা হবে এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় সাংবিধানিক সংস্কার করা হবে। সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা পুনর্প্রবর্তন করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃস্থাপন করা হবে।
২. প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এজন্য অব্যাহত আলোচনা, মতবিনিময় ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভবিষ্যতমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে। এজন্য একটি ‘জাতীয় সমঝোতা কমিশন’ গঠন করা হবে।
৩. বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এবং স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্থায়ী সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে একটি “নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে।
৪. অর্থবিল, আস্থা ভোট, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন এবং সংবিধান সংশোধনী বিল ছাড়া অন্য সব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে।
৫. প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ও সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুসমন্বয় করা হবে। পরপর দুই মেয়াদে কেউ রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।
৬. বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা” প্রবর্তন করা হবে।
৭. রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত এবং বিশিষ্টজনের অভিমতের ভিত্তিতে স্বাধীন, দক্ষ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন করার লক্ষ্যে বর্তমান ‘নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন’ সংশোধন করা হবে। ইভিএম নয়, সব কেন্দ্রে পেপার-ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান নিশ্চিত করা হবে। আরপিও, ডেলিমিনেশন অর্ডার এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন সংস্কার করা হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা হবে।
৮. সংকীর্ণ রাজনৈতিক দলীয়করণের ঊর্ধ্বে উঠে সব রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করা হবে। শুনানির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ভেটিং সাপেক্ষে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রদান করা হবে।
৯. বাংলাদেশের সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। বর্তমান বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি ‘জুডিশিয়াল কমিশন’ গঠন করা হবে। জুডিশিয়াল সার্ভিসে পেজ ২ নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ চাকরির শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক পরিচালিত হবে। বিচার বিভাগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি পৃথক সচিবালয় থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসন প্রশ্নে সংবিধানে বর্ণিত ইতোপূর্বেকার ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করা হবে। এজন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা করা হবে। দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে কেবল জ্ঞান, প্রজ্ঞা, নীতিবোধ, বিচারবোধ ও সুনামের কঠোর মানদণ্ডে যাচাই করে বিচারক নিয়োগ করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৫(গ) অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও মানদণ্ড সম্বলিত ‘বিচারপতি নিয়োগ আইন’ প্রণয়ন করা হবে।
১০. দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ পরিষেবা, জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন উপহার দেওয়ার লক্ষ্যে যোগ্য ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করে প্রশাসন পুনর্গঠন করা হবে। মেধা, সততা, সৃজনশীলতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
১১. সুপ্রিম কোর্টের একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে একটি ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন করা হবে। সৎ সাংবাদিকতার পরিবেশ পুনরুদ্ধার করা হবে এবং চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যাসহ সব সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যার বিচার নিশ্চিত করা হবে।
১২. দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না। বিগত দেড় দশক ধরে সংগঠিত অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা এবং শ্বেতপত্রে চিহ্নিত দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দেশের বাইরে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনার প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন ও দুর্নীতি দমন আইন সংস্কারের পাশাপাশি পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। সংবিধান অনুযায়ী ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ করা হবে।
১৩. সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ ও মানুষের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং গুম, খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং অমানবিক নিষ্ঠুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হবে। ইউনিভার্সাল হিউম্যান রাইটস চার্টার অনুযায়ী মানবাধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে মানবাধিকার কমিশনে নিয়োগ প্রদান করা হবে। গত দেড় দশক ধরে সংগঠিত সব বিচারবহির্ভূত হত্যা, ক্রসফায়ারের নামে নির্বিচারে হত্যা, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্মম শারীরিক নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সব ব্যক্তির সুবিচার নিশ্চিত করা হবে।
১৪. অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ, অভিজ্ঞ ব্যাংকার, কর্পোরেট নেতা, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নিরিখে প্রবৃদ্ধির সুফল সুষম বণ্টনের মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করা হবে। উপরোক্ত সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন, জুডিশিয়াল কমিশন, মিডিয়া কমিশন এবং অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশনগুলো সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্ব-স্ব প্রতিবেদন দাখিল করবে যেন সংশ্লিষ্ট সুপারিসগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।
১৫. ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ এই মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করবেন। দলমত ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাহাড়ি ও সমতলের ক্ষুদ্র-বৃহৎ সব জাতিগোষ্ঠীর সংবিধান প্রদত্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্ম-কর্মের অধিকার, নাগরিক অধিকার এবং জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হবে।
১৬. শ্রমজীবী মানুষ এবং চা-বাগান, বস্তি, চরাঞ্চল, হাওর-বাওর ও মঙ্গাপীড়িত ও উপকূলীয় অঞ্চলের বৈষম্য দূরীকরণ ও সুষম উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।
১৭. সব কালাকানুন বাতিল করা হবে এবং অপ্রয়োজনীয় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বন্ধ করা হবে। আমদানি নির্ভরতা পরিহার করে নবায়নযোগ্য ও মিশ্র এনার্জি-নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং উপেক্ষিত গ্যাস/খনিজ সম্পদ আহরণ/আবিষ্কারে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১৮. বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে কোনোরকম সন্ত্রাসবাদী তৎপরতাকে বরদাশত করা হবে না এবং কোনো সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না। ভিন্নমতের বিরোধী শক্তি দমনে সন্ত্রাসবাদকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা এবং সন্ত্রাসবাদের তকমা লাগিয়ে বিরোধী দল দমনের অপতৎপরতা বন্ধ করা হবে।
১৯. দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত, যুগোপযোগী এবং সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলা হবে। স্বকীয় মর্যাদা বহাল রেখে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা হবে।
২০. ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর স্বাধীন, শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান করা হবে। এসব প্রতিষ্ঠানকে এমনভাবে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে যেন তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন পরিষেবা প্রদান ও উন্নয়ন কার্যক্রমে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন ও অন্য কোনো জনপ্রতিনিধির খবরদারি মুক্ত স্বাধীন স্থানীয় সরকার নিশ্চিত করা হবে এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সরকারি প্রশাসক নিয়োগ বন্ধ করা হবে। আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাহী আদেশবলে সাসপেন্ড/বরখাস্ত/অপসারণ করা হবে না।
২১. রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাদের যথাযথ মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। এ তালিকার ভিত্তিতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কল্যাণার্থে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করে একটি সঠিক তালিকা প্রস্তুত করা হবে।
২২. যুবসমাজের ভিশন ও চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব-উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। বেকার যুবকদের যথাযথ কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত অথবা ন্যূনতম এক বছর পর্যন্ত (যা আগে ঘটে) বেকার ভাতা প্রদান করা হবে। যুব-দক্ষতা বৃদ্ধি করে ‘ডিমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ আদায়ের লক্ষ্যে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে এবং বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে নানামুখী বাস্তবসম্মত কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
২৩. নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। জাতীয় সংসদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে নারীদের গুরুত্ব প্রদান এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
২৪. বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর করে নিম্ন ও মধ্য পর্যায়ে চাহিদা ভিত্তিক শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা-কারিকুলামকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হবে। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হবে।
২৫. ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই নীতির ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করার লক্ষ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন করা হবে। জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হবে।
২৬. শ্রমিকদের প্রাইস-ইনডেক্স বেজড ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা হবে। শিশু-শ্রম বন্ধ করা হবে।
২৭. কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও শস্য বিমা, পশু বিমা, মৎস্য বিমা এবং পোল্ট্রি বিমা চালু করা হবে। কৃষি জমির অকৃষি ব্যবহার বন্ধ করা হবে।
এএইচআর/এমএআর