• বিএনপি রাষ্ট্রকে মেরামত করবে, এটা হাস্যকর : ওবায়দুল কাদের
• তাদের রাষ্ট্র মেরামতের কথা ‘ভুতের মুখে রাম-রাম’ অবস্থা : নানক
• প্রথমে দিয়েছিল ১০ দফা, এখন ২৭, পরে দেবে ২২৭ দফা : মায়া
• তারা যখন এসব বলে তখন মানুষ হাসে, গাধাও হাসে : হাছান মাহমুদ 

সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের নামে ‘২৭ দফা রূপরেখা’ দিয়েছে বিএনপি। দলটির এই রূপরেখায় স্থান পেয়েছে আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ সংস্কারের প্রতিশ্রুতি। এছাড়া জাতীয় সরকার গঠনের পাশাপাশি দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না— এমন প্রতিশ্রুতিও রয়েছে।

বিএনপির এসব রূপরেখা ঘোষণার পর বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারা। তাদের কাছে দলটির রূপরেখা ‘হাস্যকর’ বলে মনে হয়েছে। তারা বলছেন, বিএনপি-জামায়াত রাষ্ট্রকে ধ্বংস করেছে। এখন আবার তারাই রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের কথা বলছে। এখন দেশের সবকিছুই দারুণভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তাই রাষ্ট্রকে আর মেরামতের কিছু নেই। তাদের (বিএনপির) হাতে তো রক্তের দাগ। কাজেই যারা ধ্বংস করে, উল্টো তারা মেরামত করবে কীভাবে? এটা তো নতুন কিছু নয়, এটা তাদের স্টান্টবাজি। তাদের আন্দোলন জমবে না। পাশাপাশি জনগণও বিভ্রান্ত হবে না।

তারা আরও বলছেন, ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট গ্রহণের জন্য ‘রাজনীতির কাকেরা’ সমবেত হয়ে বিএনপি গঠন করেছিল। ওই উচ্ছিষ্ট গ্রহণকারী নেতারা যখন রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলে তখন সেটি হাস্যকর ছাড়া অন্য কোনো কিছু নয়। এটা পাগলের প্রলাপ। তাদের একটা দফাও পূরণ হবার নয়। প্রথমে দিয়েছে ১০টা, এখন ২৭টা। পরে দেবে ২২৭টা।

এরই মধ্যে বিএনপির রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখার সমালোচনায় মেতেছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ অনেকেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

বিএনপির রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের নামে ২৭ দফা রূপরেখাকে কীভাবে দেখছেন— জানতে চাইলে দলটির সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি রাষ্ট্রকে মেরামত করবে এটা হাস্যকর। ১৪ বছর আগের বাংলাদেশ, আর আজকের বাংলাদেশে উন্নয়ন অর্জনের যে দৃশ্যপট, এই বাংলাদেশকে চেনাই যায় না। অথচ এই রাষ্ট্রকে তারা (বিএনপি) ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। সেই রাষ্ট্রকে দৃঢ় পদক্ষেপে ডিজিটাল হিসেবে মেরামত করা হয়েছে। সরকার এখন ২০৪০ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছে।

‘বিএনপি গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ধ্বংস করেছে। স্বাধীনতার আদর্শ পদদলিত করেছে এবং খুনিদের পুরস্কৃত করেছে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ৩ নভেম্বর তারা খুনের রাজনীতি শুরু করে। এছাড়া ২১ আগস্ট পর্যন্ত আমাদের ২১ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করে। আহসান উল্লাহ মাস্টার, শাহ কিবরিয়া, খুলনার মুঞ্জুরুল ইমাম, যশোরের শামসুর রহমান এমনকি সাংবাদিকরাও তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। তাদের হাতে তো রক্তের দাগ। কাজেই যারা ধ্বংস করে, তারা মেরামত করবে কীভাবে? এটা নতুন কিছু নয়, এটা তাদের স্টান্টবাজি।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিএনপি রাষ্ট্র মেরামতের জন্য ২৭ দফা দিয়েছে। তারা যেসব ফর্মুলা দিয়েছে তা দেখে আমি খুবই আশ্চর্য হয়েছি। কারণ, তারা পেছনের কথাগুলো ভুলে গেছে। এটা মানুষের কাছে হাস্যাস্পদে পরিণত হয়েছে। বিএনপি দীর্ঘসময় ক্ষমতায় ছিল। জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিএনপি নামক দলটিকে আবিষ্কার করেছেন। দীর্ঘ সময় তাদের দুঃশাসন ও অনাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি-জামায়াতের আমলে রাষ্ট্রকে ধ্বংস করা হয়েছে। সেসময় রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সেই রাষ্ট্রকে মেরামতের কথা যারা বলছেন, এটা ভূতের মুখে রাম-রাম ছাড়া কিছুই না।

‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দুবারের বেশি থাকতে পারবেন না, এটা সাংবিধানিক কথা হতে পারে না। এমন কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে না। কথাগুলো কী লক্ষ্য নিয়ে বলা হয়েছে, সেটা চিন্তার বিষয়। তাদের মূল লক্ষ্য কী, মূল টার্গেট কী, আমরা জানি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তিন দফায় দেশ পরিচালিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। এখন ক্যান্টনমেন্টে কোনো গুলির শব্দ পাওয়া যায় না। পুলিশের মধ্যে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশ ছাপিয়ে বিশ্বের মধ্যে সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তখন তাদের টার্গেট কিন্তু শেখ হাসিনা।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিএনপির ২৭ দফা পাগলের প্রলাপ ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাদের এক দফাই পূরণ হয় না, আবার দিয়েছে ২৭ দফা। প্রথমে ১০ দফা, এখন দিয়েছে ২৭ দফা। পরে হয়তো দেবে ২২৭ দফা।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের কথা বলে তারা যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, আমি সেটা দেখেছি। ১৩ নম্বর প্রস্তাবে আছে, দুর্নীতির বিষয়ে কোনো আপস করা হবে না। যারা পরপর পাঁচবার দেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছিল, যাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দুর্নীতির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত, তারা যখন এসব কথা বলে তখন মানুষ হাসে... গাধাও হাসে।

‘খন্দকার মোশাররফ সাহেব তো ছাত্রলীগ করতেন। ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করার জন্য রাজনীতির কাকেরা সমবেত হয়ে বিএনপি গঠন করেছিল। এই উচ্ছিষ্ট গ্রহণকারী নেতারা যখন রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলেন তখন সেটা হাস্যকর ছাড়া অন্য কোনো কিছু থাকে না।’

বিএনপি ২৭ দফায় গতানুগতিক কিছু কথা বলেছে। আমাদের দেশে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা হয় তখন রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের ওপর অনাস্থার কথাই চলে আসে। কারণ, রাজনীতিতে আমরা সহনশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে চাই, সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তবে সেটা তারা করতে চায় না বিধায় অগণতান্ত্রিক কিছু আনতে চায়। এটা কখনই সমীচীন নয়— বলেন হাছান মাহমুদ।

বিএনপির সংবিধান পরিবর্তনে ‘সংবিধান কমিশন’ গঠনের সমালোচনা করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু। বিএনপির উদ্দেশে তিনি বলেন, গাত্রদাহ কোথায়? তাদের গাত্রদাহ হলো- সংবিধানের যে চার মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ; যেটা জিয়াউর রহমান ছুড়ে ফেলেছিল, আজ সেটা পুনঃস্থাপিত হয়েছে। এটাই তাদের গাত্রদাহের কারণ।

গতকাল সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) ১৪ দলের এক আলোচনা সভায় তিনি আরও বলেন, তারা এখন সংবিধান নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু তারা ভুলে যায় যে এই দেশ পাকিস্তানের মতো করে সৃষ্টি হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-উপজাতিদের রক্তের মধ্য দিয়ে এই দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে।

নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারলে সমমনাদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবে বিএনপি। সেই জাতীয় সরকার রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে অনেকগুলো সংস্কার আনবে। তেমন কিছু সংস্কার আর সিদ্ধান্তের কথা যুক্ত করে গতকাল সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) ২৭ দফা রূপরেখা দিয়েছে দলটি।

রূপরেখায় বলা হয়েছে-

১. বিগত এক দশকের অধিককাল ব্যাপী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার হীন উদ্দেশে অনেক অযৌক্তিক মৌলিক সাংবিধানিক সংশোধনী এনেছে। একটি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করে সকল বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনগুলো পর্যালোচনা করে এসব রহিত/সংশোধন করা হবে এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় সাংবিধানিক সংস্কার করা হবে। সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা পুনর্প্রবর্তন করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃস্থাপন করা হবে।

২. প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এজন্য অব্যাহত আলোচনা, মতবিনিময় ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভবিষ্যতমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে। এজন্য একটি ‘জাতীয় সমঝোতা কমিশন’ গঠন করা হবে।

৩. বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এবং স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্থায়ী সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে একটি “নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে।

৪. অর্থবিল, আস্থা ভোট, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন এবং সংবিধান সংশোধনী বিল ছাড়া অন্য সব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে।

৫. প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ও সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুসমন্বয় করা হবে। পরপর দুই মেয়াদে কেউ রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।

৬. বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা” প্রবর্তন করা হবে।

৭. রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত এবং বিশিষ্টজনের অভিমতের ভিত্তিতে স্বাধীন, দক্ষ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন করার লক্ষ্যে বর্তমান ‘নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন’ সংশোধন করা হবে। ইভিএম নয়, সব কেন্দ্রে পেপার-ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান নিশ্চিত করা হবে। আরপিও, ডেলিমিনেশন অর্ডার এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন সংস্কার করা হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা হবে।

৮. সংকীর্ণ রাজনৈতিক দলীয়করণের ঊর্ধ্বে উঠে সব রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করা হবে। শুনানির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ভেটিং সাপেক্ষে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রদান করা হবে।

৯. বাংলাদেশের সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। বর্তমান বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি ‘জুডিশিয়াল কমিশন’ গঠন করা হবে। জুডিশিয়াল সার্ভিসে পেজ ২ নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ চাকরির শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক পরিচালিত হবে। বিচার বিভাগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি পৃথক সচিবালয় থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসন প্রশ্নে সংবিধানে বর্ণিত ইতোপূর্বেকার ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করা হবে। এজন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা করা হবে। দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে কেবল জ্ঞান, প্রজ্ঞা, নীতিবোধ, বিচারবোধ ও সুনামের কঠোর মানদণ্ডে যাচাই করে বিচারক নিয়োগ করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৫(গ) অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও মানদণ্ড সম্বলিত ‘বিচারপতি নিয়োগ আইন’ প্রণয়ন করা হবে।

১০. দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ পরিষেবা, জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন উপহার দেওয়ার লক্ষ্যে যোগ্য ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করে প্রশাসন পুনর্গঠন করা হবে। মেধা, সততা, সৃজনশীলতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

১১. সুপ্রিম কোর্টের একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে একটি ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন করা হবে। সৎ সাংবাদিকতার পরিবেশ পুনরুদ্ধার করা হবে এবং চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যাসহ সব সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যার বিচার নিশ্চিত করা হবে।

১২. দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না। বিগত দেড় দশক ধরে সংগঠিত অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা এবং শ্বেতপত্রে চিহ্নিত দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দেশের বাইরে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনার প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন ও দুর্নীতি দমন আইন সংস্কারের পাশাপাশি পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। সংবিধান অনুযায়ী ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ করা হবে।

১৩. সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ ও মানুষের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং গুম, খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং অমানবিক নিষ্ঠুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হবে। ইউনিভার্সাল হিউম্যান রাইটস চার্টার অনুযায়ী মানবাধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে মানবাধিকার কমিশনে নিয়োগ প্রদান করা হবে। গত দেড় দশক ধরে সংগঠিত সব বিচারবহির্ভূত হত্যা, ক্রসফায়ারের নামে নির্বিচারে হত্যা, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্মম শারীরিক নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সব ব্যক্তির সুবিচার নিশ্চিত করা হবে।

১৪. অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ, অভিজ্ঞ ব্যাংকার, কর্পোরেট নেতা, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নিরিখে প্রবৃদ্ধির সুফল সুষম বণ্টনের মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করা হবে। উপরোক্ত সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন, জুডিশিয়াল কমিশন, মিডিয়া কমিশন এবং অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশনগুলো সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্ব-স্ব প্রতিবেদন দাখিল করবে যেন সংশ্লিষ্ট সুপারিসগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।

১৫. ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ এই মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করবেন। দলমত ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাহাড়ি ও সমতলের ক্ষুদ্র-বৃহৎ সব জাতিগোষ্ঠীর সংবিধান প্রদত্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্ম-কর্মের অধিকার, নাগরিক অধিকার এবং জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হবে।

১৬. শ্রমজীবী মানুষ এবং চা-বাগান, বস্তি, চরাঞ্চল, হাওর-বাওর ও মঙ্গাপীড়িত ও উপকূলীয় অঞ্চলের বৈষম্য দূরীকরণ ও সুষম উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।

১৭. সব কালাকানুন বাতিল করা হবে এবং অপ্রয়োজনীয় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বন্ধ করা হবে। আমদানি নির্ভরতা পরিহার করে নবায়নযোগ্য ও মিশ্র এনার্জি-নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং উপেক্ষিত গ্যাস/খনিজ সম্পদ আহরণ/আবিষ্কারে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

১৮. বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে কোনোরকম সন্ত্রাসবাদী তৎপরতাকে বরদাশত করা হবে না এবং কোনো সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না। ভিন্নমতের বিরোধী শক্তি দমনে সন্ত্রাসবাদকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা এবং সন্ত্রাসবাদের তকমা লাগিয়ে বিরোধী দল দমনের অপতৎপরতা বন্ধ করা হবে।

১৯. দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত, যুগোপযোগী এবং সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলা হবে। স্বকীয় মর্যাদা বহাল রেখে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা হবে।

২০. ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর স্বাধীন, শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান করা হবে। এসব প্রতিষ্ঠানকে এমনভাবে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে যেন তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন পরিষেবা প্রদান ও উন্নয়ন কার্যক্রমে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন ও অন্য কোনো জনপ্রতিনিধির খবরদারি মুক্ত স্বাধীন স্থানীয় সরকার নিশ্চিত করা হবে এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সরকারি প্রশাসক নিয়োগ বন্ধ করা হবে। আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাহী আদেশবলে সাসপেন্ড/বরখাস্ত/অপসারণ করা হবে না।

২১. রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাদের যথাযথ মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। এ তালিকার ভিত্তিতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কল্যাণার্থে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করে একটি সঠিক তালিকা প্রস্তুত করা হবে।

২২. যুবসমাজের ভিশন ও চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব-উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। বেকার যুবকদের যথাযথ কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত অথবা ন্যূনতম এক বছর পর্যন্ত (যা আগে ঘটে) বেকার ভাতা প্রদান করা হবে। যুব-দক্ষতা বৃদ্ধি করে ‘ডিমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ আদায়ের লক্ষ্যে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে এবং বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে নানামুখী বাস্তবসম্মত কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

২৩. নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। জাতীয় সংসদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে নারীদের গুরুত্ব প্রদান এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

২৪. বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর করে নিম্ন ও মধ্য পর্যায়ে চাহিদা ভিত্তিক শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা-কারিকুলামকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হবে। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হবে।

২৫. ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই নীতির ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করার লক্ষ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন করা হবে। জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হবে।

২৬. শ্রমিকদের প্রাইস-ইনডেক্স বেজড ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা হবে। শিশু-শ্রম বন্ধ করা হবে।

২৭. কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও শস্য বিমা, পশু বিমা, মৎস্য বিমা এবং পোল্ট্রি বিমা চালু করা হবে। কৃষি জমির অকৃষি ব্যবহার বন্ধ করা হবে।

এমএসআই/কেএ