ভ্যাট ফাঁকির ৪৮ কোটি টাকা পরিশোধে সিঙ্গারের নয়ছয়!
আন্তর্জাতিক ইলেকট্রনিক্স ব্র্যান্ড হিসেবে বাংলাদেশের বাজারে পরিচিতি পাওয়া সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডের বিরুদ্ধে ৪৮ কোটি ২৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানিটির বাংলাদেশে তিনটি ইউনিটের রেকর্ডপত্র যাচাই-বাছাই শেষে আয়, রেয়াত ও উৎসে ভ্যাট বাবদ ওই টাকা ফাঁকি দেওয়ার তথ্য মিলেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের পৃথক তদন্তে ওই ফাঁকির তথ্য উঠে এসেছে। তদন্তে পাওয়া তথ্যে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে সিঙ্গার বাংলাদেশের বকেয়া বা ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের পরিমাণ ২৭ কোটি ৫৯ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫ টাকা। আর ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভ্যাট বাবদ ২০ কোটি ৬৪ লাখ ৩২ হাজার ৮০৯ টাকা ফাঁকি দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
টাকা আদায়ে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নিতে গত ১ নভেম্বর এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। যেখানে ফাঁকি দেওয়া বা বকেয়া টাকা পরিশোধে সিঙ্গার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অসহযোগীতার বিভিন্ন অভিযোগ তুলেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে ভ্যাট গোয়েন্দা ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির আয়, গৃহীত অতিরিক্ত রেয়াত, উৎসে মূসক ও স্থান এবং স্থাপনা ভাড়ার ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট যথাসময়ে পরিশোধ না করায় সেগুলো আদায় করতে আইনগত ব্যবস্থা নিতে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছি। আমাদের কাছে প্রতিষ্ঠানটির মূসক ফাঁকির তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। সবচেয়ে অবাক লেগেছে অবৈধ রেয়াত সুবিধা নেওয়ার জন্য একীভূত (মার্জ) হওয়া প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেডের নামে ভ্যাট রিটার্ন জমা দিয়েছে সিঙ্গার। অবৈধ রেয়াত নেওয়ার জন্যই এই রিটার্ন জমা দেওয়া হয়। এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট থেকে এ বিষয়ে চিঠি দেওয়া হলেও কোম্পানি কর্তৃপক্ষ পাত্তা দিচ্ছে না।
সিঙ্গার বাংলাদেশের মূসক ফাঁকি সম্পর্কিত গোপন উৎস থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, দেখা গেছে সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড একীভূত হওয়া প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেডের নামে অবৈধভাবে রেয়াত গ্রহণ, প্রতিষ্ঠানটির ১৯টি ওয়্যারহাউস ও ৩২৪টি বিক্রয়কেন্দ্রের মূসক বা ভ্যাটের নিবন্ধন না থাকা এবং ওয়্যারহাউস ও বিক্রয় কেন্দ্র থেকে পণ্য বিক্রির বিপরীতে মূসক জমা দেয়নি। তদন্তে এসব বিষয়ে সত্যতা পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে সিঙ্গার বাংলাদেশের কোম্পানি সচিব কাজী আনিসুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি খুদে বার্তা দেওয়া হলেও তার জবাব মেলেনি।
তবে সিঙ্গার বাংলাদেশের কমিউনিকেশ ইনচার্জ নাজমুস সাকিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি পরে জানাবো।
সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী যেমন- টিভি, ফ্রিজ, এসি, গ্রাইন্ডার, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি উৎপাদন করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে থাকে। তবে কিছু পণ্য বিদেশ থেকে সরাসরি আমদানি করে থাকে।
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডের তিনটি ইউনিট তিন মূসক কমিশনারেটের আওতায় নিবন্ধিত। ইউনিটগুলো হলো- সিঙ্গার বাংলাদেশের দিলকুশা বাণিজ্যিক ইউনিট, সাভারের রাজফুলবাড়ীয়া ও হেমায়েতপুর ইউনিট। এর মধ্যে সিঙ্গার বাংলাদেশের দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার ইউনিট ঢাকা দক্ষিণের কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, সাভারের হেমায়েতপুরের কুলাসুর ইউনিট ঢাকা পশ্চিম ভ্যাট কমিশনারেট এবং সাভারের রাজফুলবাড়ীয়ার জামুল ইউনিট বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (ভ্যাট) আওতাভুক্ত। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর তদন্ত শুরু করে। এরপর শুরু হয় তদন্ত কার্যক্রম।
তদন্তে যা পাওয়া গেল
সিঙ্গার বাংলাদেশের ওই তিন ইউনিটের দাখিলপত্র যাচাই-বাছাই করে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মূসক বা ভ্যাট বাবদ ১৪ কোটি ২৮ লাখ ৪৯ হাজার ৮০০ টাকা ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করেছে ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। যার মধ্যে আয় খাতে ফাঁকি দেওয়া মূসক বা ভ্যাটের পরিমাণ হচ্ছে ১ কোটি ৯৬ হাজার ৬১৮ টাকা, অতিরিক্ত রেয়াত গ্রহণের মাধ্যমে ২ লাখ ২১ হাজার ১০৮ টাকা ও উৎসে ভ্যাট কর্তনের মাধ্যমে ১৩ কোটি ২৫ লাখ ৩২ হাজার ৭৪ টাকা ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে প্রযোজ্য সুদের পরিমাণ ১৩ কোটি ৩০ লাখ ৬৪ হাজার ৪৬৩ টাকা। সব মিলিয়ে ২৭ কোটি ৫৯ লাখ ১৪ হাজার ২৬৪ টাকা আদায়যোগ্য বলে ভ্যাট গোয়েন্দার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
প্রতিষ্ঠানটির মূসক ফাঁকি সম্পর্কিত গোপন উৎস থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে, সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেডের নামে রেয়াত গ্রহণ, প্রতিষ্ঠানটির ১৯টি ওয়্যারহাউস ও ৩২৪টি বিক্রয়কেন্দ্রের মূসক বা ভ্যাটের নিবন্ধন না থাকা, ওয়্যারহাউস ও বিক্রয় কেন্দ্র থেকে পণ্য বিক্রির বিপরীতে মূসক জমা না দেওয়ার বিষয়েও সত্যতা পাওয়া গেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনের চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত মূসক, গৃহীত অতিরিক্ত রেয়াত, উৎসে মূসক ও স্থান এবং স্থাপনা ভাড়ার ওপর প্রযোজ্য মূসক বাবদ সুদসহ সরকারি পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটি ৫৯ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫ টাকা। এই বকেয়া আদায়ে পরবর্তী আইনগত কার্যক্রমের জন্য এনবিআরে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।
২০১৯-২০২১ সালের মেয়াদে আরও ফাঁকি ২০ কোটি
ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের পৃথক তদন্তে আরও দেখা যায়, সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড নামীয় প্রতিষ্ঠানটির ওই তিনটি ইউনিট থেকে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদের নিরীক্ষায় পরিহার করা মূসক, গৃহীত অতিরিক্ত রেয়াত, উৎসে মূসক ও স্থান এবং স্থাপনা ভাড়ার ওপর প্রযোজ্য মূসক বা ভ্যাট বাবদ ২০ কোটি ৩১ লাখ ৫২ হাজার টাকা ফাঁকি দিয়েছে। যা সরকারি কোষাগারে যথাসময়ে জমা হওয়ার কথা ছিল। তা না করে প্রতিষ্ঠানটি বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। প্রযোজ্য ভ্যাটের সঙ্গে ২০১২ সালের মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইনের ১২৭ নং ধারায় মাসিক ২ শতাংশ সুদে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ লাখ ৮০ হাজার ৮০৬ টাকা।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অতিরিক্ত রেয়াত গ্রহণের মাধ্যমে ১৫ কোটি ৯২ লাখ ৭ হাজার ৪১৪ টাকার ভ্যাট ও উৎসের মূসক কর্তনবাবদ ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৪৪ হাজার ৫৮৯ টাকা ফাঁকি দিয়েছে। এভাবে মোট ২০ কোটি ৩১ লাখ ৫২ হাজার টাকার ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। ২ শতাংশ সুদে ৩২ লাখ ৮০ হাজার ৮০৬ টাকার সুদ প্রযোজ্য রয়েছে। সব মিলিয়ে ২০ কোটি ৬৪ লাখ ৩২ হাজার ৮০৯ টাকার ভ্যাট আদায়যোগ্য বলে ভ্যাট গোয়েন্দার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে এনবিআর বরাবর পাঠানো চিঠিতে আরও কিছু বিষয়ের গুরুত্ব দিয়ে সুপারিশ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে- সিঙ্গার বাংলাদেশের সব ইউনিটের নাম একই হওয়ায় পৃথক পৃথক কমিশনারেটে দাখিলপত্র দাখিল করায় রেয়াত যাচাই ও সার্বিক মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন। ফলে একই কমিশনারেটের অধীনে কেন্দ্রীয় নিবন্ধন থাকা বাঞ্চনীয় বলে মনে করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ব্যাপক হওয়ার পরও মূসক বা ভ্যাট কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সফটওয়্যার না থাকার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। সে কারণে দ্রুততার সঙ্গে সফটওয়্যার গ্রহণের জন্য প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট মূসক কমিশনারেটকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
আরএম/জেডএস