মিলেছে ২৪০ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ
ইন্সপেক্টর সোহেলের পরিকল্পনায় ই-অরেঞ্জ বিক্রির নাটক!
• ই-কমার্সের ১১ অর্থপাচার মামলা তদন্তে সিআইডি
• ই-অরেঞ্জে অর্থপাচারের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি
• তদন্তে বাড়ছে আসামি ও প্রতারণার টাকার পরিমাণ
• জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্পে ই-অরেঞ্জ বিক্রির নাটক
গ্রাহকের টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহ করেনি ২০০৭ সালে যাত্রা শুরু করা অনলাইন শপ ‘ই-অরেঞ্জ’। পণ্যবাবদ অগ্রিম নেওয়া টাকাও ফেরত দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। গত বছর ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রাহকদের মামলার পর প্রতিষ্ঠানটির মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান বর্তমানে কারাগারে। এরপর হতে থাকে একের পর এক মামলা। এর মধ্যে অর্থপাচারের (মানি লন্ডারিং) অভিযোগে দায়ের করা মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর গুলশান থানায় ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ২৩২ কোটি ৪৩ লাখ তিন হাজার ৭৮৬ টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা দায়ের হয়। মামলায় অর্থপাচারের সত্যতা পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থাটি।
সিআইডি সূত্র জানায়, তদন্তে পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ আরও আট কোটি বেড়েছে। শুধু অর্থপাচার নয়, গ্রাহকদের টাকা মেরে দিতে এবং লোকসানের দায় এড়াতে ই-অরেঞ্জ বিক্রির নাটকও সাজানো হয়। পলাতক বিথি আক্তারকে কেন্দ্র করে বিক্রির নাটক সাজান ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিনের ভাই বনানী থানার বরখাস্ত হওয়া পরিদর্শক সোহেল রানা।
শুধু সিটি ব্যাংকের হিসাব থেকে ‘অল জোন’ নামক হিসাবে ই-অরেঞ্জ শপের পণ্য সরবরাহ বন্ধ হওয়ার আগে ও পরে গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত মোট ২২ বার ১৮৮ কোটি ৬৪ লাখ ৪৯ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। এছাড়া অভিযুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের সহযোগী অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান রেড অরেঞ্জ ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে ৯৯ লাখ টাকা এবং অরেঞ্জ বাংলাদেশের হিসাবে মোট ১৫ লাখ ১৮ হাজার ৫৩৪ টাকা প্রতারণাপূর্বক গ্রহণের উদ্দেশ্যে সরাসরি স্থানান্তর করা হয়
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ জানায়, ই-অরেঞ্জের সাবেক মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, বর্তমান মালিক পলাতক বিথি আক্তার, চিফ অপারেটিং অফিসার আমান উল্লাহ চৌধুরী, উপদেষ্টা মাসুকুর রহমান এবং অরেঞ্জ বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালক শেখ সোহেল রানাসহ অজ্ঞাত পাঁচ-ছয়জন ছাড়াও ‘ই-অরেঞ্জ সপ’ ও এর অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান ‘রেড অরেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল’, সহযোগী অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান ‘অরেঞ্জ বাংলাদেশ লিমিটেড’ এবং সন্দেহভাজন প্রতিষ্ঠান ‘অল জোন’ গত ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত বেসরকারি সিটি ব্যাংক ছাড়াও অজ্ঞাত একাধিক প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে ই-অরেঞ্জের গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম পণ্যের ক্রয়াদেশ বাবদ পাওয়া টাকা উত্তোলন এবং ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে অর্থপাচার করেছেন।
আরও পড়ুন >> এক বছরেও ভারত থেকে ফেরানো যায়নি সোহেল রানাকে
শুধু সিটি ব্যাংকের হিসাব থেকে অল জোন নামক হিসাবে ই-অরেঞ্জ শপের পণ্য সরবরাহ বন্ধ হওয়ার আগে ও পরে গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত মোট ২২ বার ১৮৮ কোটি ৬৪ লাখ ৪৯ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। এছাড়া অভিযুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের সহযোগী অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান রেড অরেঞ্জ ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে ৯৯ লাখ টাকা এবং অরেঞ্জ বাংলাদেশের হিসাবে মোট ১৫ লাখ ১৮ হাজার ৫৩৪ টাকা প্রতারণাপূর্বক গ্রহণের উদ্দেশ্যে সরাসরি স্থানান্তর করা হয়।
২৬ ভুক্তভোগী গ্রাহকের দাবি, তাদের কাছ থেকে ক্রয়াদেশবাবদ মোট আট কোটি ৫৫ লাখ ৫১ হাজার ৪০ টাকা পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে ব্যাংক হিসাবে নেওয়া এবং পণ্য সরবরাহের সময়সীমা পার হলেও তাদের পণ্য সরবরাহ করা হয়নি। তাদের অভিযোগেরও সত্যতা পেয়েছে সিআইডি।
আরও পড়ুন >> ২৮ কোটি টাকা লোপাট, পুলিশ পরিদর্শক সোহেলের বিরুদ্ধে মামলা
তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, ই-অরেঞ্জের অর্থপাচার মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। অভিযুক্তরা সংঘবদ্ধভাবে ২৪০ কোটি টাকার বেশি সরিয়ে অর্থপাচার (মানি লন্ডারিং) আইনে অপরাধ করেছেন। এ অপরাধে আসামির সংখ্যাও বাড়তে পারে।
লোকসানের দায় এড়াতে ই-অরেঞ্জ বিক্রির নাটক
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর লোকসানের দায় এড়াতে পরিকল্পিতভাবে ই-অরেঞ্জ বিক্রির নাটক সাজানো হয়। গত বছরের শুরুতে গ্রাহকদের ধোঁকা দিয়ে ই-অরেঞ্জের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) আমান উল্লাহর ২০ বছরের বান্ধবী বিথি আক্তারকে বেছে নেয় তারা। বিথি ৫০ কোটি টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেন। তবে, তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া হরিণপালা এলাকার বিথি আক্তারের অন্য কাহিনী। তার জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) সব ঠিক থাকলেও বাবার নাম দেওয়া ছিল মালেক। তদন্তে বেরিয়ে আসে তার বাবার নাম মালেক নয় ফিরোজ। এনআইডিতে ভুল ছিল তার বাবার নাম। আসল বাবা ফিরোজ কর্মজীবনের শুরুতে রিকশাচালক ছিলেন। পরে তিনি সিএনজি চালালেও এখন অটোচালক। বিথির ভাইও অটোরিকশা চালান। এ অবস্থায় ঢাকায় এসেই বিথির ৫০ কোটি টাকা দিয়ে ই-অরেঞ্জ কেনা অবাস্তব ছিল।
ই-অরেঞ্জ বিক্রির নাটকে রেভিনিউ স্ট্যাম্প জালিয়াতি
ই-অরেঞ্জ বিক্রির রেভিনিউ স্ট্যাম্পে তারিখ ১ জানুয়ারি ২০২১ লেখা থাকলেও বিক্রির স্বাক্ষরে লেখা ৪ জানুয়ারি। ইব্রাহিম নামে যে ভেন্ডরের কাছ থেকে স্ট্যাম্প কেনা হয়েছিল, ট্রেজারি বিভাগে চিঠি দিয়ে এমন নামের কোনো ভেন্ডরের অস্তিত্ব মেলেনি। মানে ভুয়া স্ট্যাম্প পেপার ছিল তা।
ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিনকে বাঁচাতে তার ভাই বনানী থানার বরখাস্ত হওয়া পরিদর্শক সোহেল রানা প্রতিষ্ঠানটি বিক্রির নাটক সাজান। তবে, গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের মামলায় পরোয়ানা জারির খবরে ই-অরেঞ্জের পরিচালক গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের চ্যাংড়াবান্দায় পালিয়ে যান। সেখানে বিএসএফের হাতে ধরা পড়েন সোহেল রানা
ই-অরেঞ্জের মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত-তত্ত্বাবধায়ক সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের (ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম) বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুরুতে ই-অরেঞ্জের মোটিভ প্রতারণামূলক ছিল না। তবে, বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকতে না পেরে প্রতারণায় জড়িয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি।
আরও পড়ুন >> ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়াসহ ৩ জন রিমান্ডে
হুমায়ুন কবির বলেন, আসলে ই-অরেঞ্জের মালিকানা পেতে এক পয়সাও দিতে হয়নি কথিত ক্রেতাকে। উল্টো ক্রেতা বিথিকে দেওয়া হয়েছিল বিপুল অঙ্কের টাকা এবং ইউরোপে স্থায়ী বসবাসের প্রলোভন। পরিকল্পনা ছিল ক্রেতা বিথি আক্তারের নামে মালিকানা হস্তান্তরের পর তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। অর্থাৎ সব দায় বিথিকে দিয়ে নিজেদের কোটি-কোটি টাকার প্রতারণার অপরাধ আড়াল করা। আর বিথি আক্তারও বিদেশে থাকবেন নিরাপদে।
বিক্রির নাটকের পরিকল্পনায় বরখাস্ত ইন্সপেক্টর সোহেল
ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিনকে বাঁচাতে তার ভাই বনানী থানার বরখাস্ত হওয়া পরিদর্শক সোহেল রানা প্রতিষ্ঠানটি বিক্রির নাটক সাজান। তবে, গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের মামলায় পরোয়ানা জারির খবরে ই-অরেঞ্জের পরিচালক গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের চ্যাংড়াবান্দায় পালিয়ে যান। সেখানে বিএসএফের হাতে ধরা পড়েন সোহেল রানা।
আরও পড়ুন >> সিআইডি এখন ডাম্পিং-পোস্টিং স্টেশন নয়
সিওও আমান ও কথিত সেই বিথিকে খুঁজছে সিআইডি
বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং (অর্থপাচার) আইনে হওয়া ১১টি মামলার তদন্ত চলছে। এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস নামক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কলাবাগান থানায় দায়ের হওয়া এক কোটি ১৭ লাখ টাকার মানি লন্ডারিং মামলার অভিযোগপত্র ইতোমধ্যে জমা দেওয়া হয়েছে। বাকি মামলার তদন্ত চলমান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করেছে ই-অরেঞ্জ। এর তদন্ত কর্যক্রমও আমরা গুছিয়ে এনেছি। দ্রুত চার্জশিট দিতে পারব। এজন্য পলাতক সিওও আমান ও কথিত সেই বিথিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
তবে ই-অরেঞ্জের কর্মকর্তা আমান উল্লাহ কারাগারে নাকি আত্মগোপনে তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
প্রতারণার ঘটনায় গুলশান থানায় দায়ের হওয়া প্রথম মামলার তদন্তকারী তৎকালীন কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর (তদন্ত) ও বর্তমানে শাহ আলী থানার ওসি আমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, গ্রাহক মো. তাহেরুল ইসলাম বাদী হয়ে ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ১৬ আগস্ট রাতে অভিযোগ দায়ে করেন, যা পরদিন মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। বাদীর সঙ্গে প্রতারণার শিকার আরও ৩৭ জন ওই সময় উপস্থিত ছিলেন। মামলায় ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের মোট ১১শ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
ওই মামলায় আসামি ছিলেন শেখ সোহেল রানা, তার বোন সোনিয়া মাহজাবিন, সোনিয়ার স্বামী মাসুকুর রহমান, অংশীদার বিথি আক্তার, সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল আলম, কর্মকর্তা আমান উল্লাহ ও কাউসার আহমেদ। এদের মধ্যে সোনিয়া, মাসুকুর ও আমান উল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমার জানা মতে, তারা এখনো কারাগারে আছেন। বর্তমানে সিআইডি এ মামলার তদন্ত করছে।
যদিও সিআইডি আমান উল্লাহকে পলাতক দাবি করেছে। তিনি গ্রেপ্তারের পর কারাগারে নাকি জামিনে বের হয়ে আত্মগোপনে গেছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
অর্থপাচার মামলায় ফাঁসছেন সোহেল রানা
তদন্তাধীন মামলায় অভিযুক্ত শেখ সোহেল রানার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে ই-অরেঞ্জ শপের সিটি ব্যাংকের গুলশান এভিনিউ শাখা থেকে ১৭ বারে নগদ মোট দুই কোটি ৪৭ লাখ ৭৮ হাজার ৫০০ টাকা উত্তোলনের প্রমাণ মিলেছে। অর্থাৎ অবৈধভাবে তিনি সেই টাকা নিজের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের পর উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। বরখাস্ত পরিদর্শক সোহেল রানাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) দেশটির এনসিবিকে চিঠি দিয়েছে।
জেইউ/এমএআর/