গরু বলে মানহীন মহিষের মাংস খাওয়ানো হয় হোটেল-রেস্তোরাঁয়
রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় গরুর নামে ভোক্তাদের খাওয়ানো হচ্ছে ভারত থেকে আনা মহিষের মানহীন ও পচা মাংস। খাবার অযোগ্য এসব মাংস মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কম দামে তা পাওয়ায় ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছেন হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিকরা। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, নিউ মার্কেট, হাজারীবাগ, লালবাগ, নবাবগঞ্জ, জুরাইন, মোহাম্মদপুর, কামরাঙ্গীরচরসহ বিভিন্ন এলাকায় এসব মাংস বিক্রি হচ্ছে। এ নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
>> ভারত থেকে আসে মানহীন মহিষের মাংস
>> তেজগাঁও থেকে ফ্রিজিং ভ্যানে সারাদেশে সরবরাহ
>> প্রতি কেজি মাংস ৪৩০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি
>> সিএনজি-ভ্যানযোগে চলে যায় হোটেল-রেস্তোরাঁয়
>> গরুর বলে খাওয়ানো হয় এসব মানহীন মাংস
>> মহিষের মাংস গরুর বলে চালিয়ে দেওয়া প্রতারণা
>> অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর পশ্চিম জুরাইনের তুলা বাগিচায় আল্লাহর দান গোস্ত বিতান। মালিক মো. নাছির। এখানে প্রতি কেজি মহিষের মাংস ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে পরিচয় গোপন করে দোকান থেকে কেনা হয় এক কেজি মহিষের মাংস। ভারত থেকে আসা মহিষের মাংসের পাশাপাশি গরুর মাংসও বিক্রি করে তারা।
জুরাইন বালুর মাঠ বাজারের মায়ের দোয়া গোস্ত বিতানে গিয়ে দেখা যায়, ঝুড়িতে রাখা হয়েছে মাংস। সেখান থেকে বের হচ্ছে দুর্গন্ধ। পচা এ মাংস কারা নেয়— পরিচয় গোপন করে জানতে চাইলে দোকানের মালিক মো. কাজল জানান, রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিক এগুলো নিয়ে যান। ভারত থেকে আসা প্রতি কেজি মহিষের মাংসের দাম পড়ে ৫৩০ টাকা। সস্তা হওয়ায় এগুলো চলে যায় ভোক্তার প্লেটে।
একই বাজারের আল্লাহর দান গোস্ত বিতানে ড্রামে ভিজিয়ে রাখতে দেখা যায় মহিষের মাংস। সেখান থেকে তুলে নিচের নোংরা জায়গায় রাখা হচ্ছে তা। পরে মাংসগুলো উপরে তুলে পিস পিস করে কাটা হচ্ছে। এ কাটা মাংস প্যাকেটে করে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয়।
দোকানের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে জানান, এগুলো ভারত থেকে আনা মহিষের মাংস। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে পরিচয় গোপন রেখে এ দোকান থেকেও এক কেজি মাংস কেনা হয়।
ভারত থেকে আসা এসব নষ্ট মাংসের ক্রেতা মূলত হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিকরা। দেশি পশুর দাম বেশি হওয়ায় কম টাকা দিয়ে তারা এগুলো কেনেন। এরপর গরুর মাংস বলে চালিয়ে দেন। ৪৩০ থেকে ৫৫০ টাকায় এসব মাংস বিক্রি হয়
কারা এ মাংসের ক্রেতা— জানতে চাইলে বালুর মাঠ বাজারের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভারত থেকে আসা এসব নষ্ট মাংসের ক্রেতা মূলত হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিকরা। দেশি পশুর দাম বেশি হওয়ায় কম টাকা দিয়ে তারা এগুলো কেনেন। এরপর গরুর মাংস বলে চালিয়ে দেন। ৪৩০ থেকে ৫৫০ টাকায় এসব মাংস বিক্রি হয়।
রাজধানীর নিউ মার্কেট মাংসের বাজারের বেশ কয়েকটি দোকানেও এসব মাংস বিক্রি হতে দেখা যায়। এ বাজারের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় গোপন রেখে কথা বলে ঢাকা পোস্ট। তিনি বলেন, সাধারণত জবাই করা গরুর মাংস পিস পিস করে কেটে দোকানে ঝুলিয়ে রাখা হয়। কিন্তু ভারত থেকে আনা এসব মহিষের মাংস ঝুলিয়ে বিক্রি করা হয় না। প্যাকেট খুলে এরপর টুকরো টুকরো করে কেটে বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় সরবরাহ করা হয়।
আরও পড়ুন >> ডিমের দাম আবারও ঊর্ধ্বমুখী
‘মহিষের মাথার মাংস, রানের মাংসের দাম হয় ভিন্ন। প্রতিদিন টন-টন মাংস আসছে, বিক্রি হচ্ছে। গাড়িতে করে এসে প্যাকেটভর্তি মাংস দিয়ে যায়। সকালের মধ্যেই এগুলো শেষ হয়ে যায়। রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল-রোস্তোরাঁর মালিকরা এগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যান। অর্ডারের মাংসও থাকে। যেগুলো সরাসরি নির্দিষ্ট হোটেল-রোস্তোরাঁয় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’
দামের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি ছিল। এখন তা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়েছে।
‘বাংলাদেশের শতকরা ৭০ ভাগ হোটেল-রেস্তোরাঁয় এখন ভারতীয় মহিষের মাংস বিক্রি হচ্ছে। ফ্রিজিং অবস্থায় মাংসগুলো আনা হয়। এগুলো এক সপ্তাহ নাকি ১০ দিন আগের, তা কেউ বলতে পারেন না।’
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গত ২০ সেপ্টেম্বর ভোরে সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশ কয়েকটি মাংসের দোকানে জবাই করা দেশি গরুর বিভিন্ন অংশ এক পাশে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অন্য পাশে কার্টন ও পলিথিনের প্যাকেট থেকে ফ্রিজিং করা মাংস বের করে ছোট সাইজ করা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এখানকার এক ব্যবসায়ী জানান, এসব মাংসে কোনো হাড় বা চর্বি থাকে না। এজন্য হোটেল-রেস্তোরাঁয় এসব মাংসের চাহিদা বেশি। কাবাব ও কালাভুনায় এ মাংস বেশি ব্যবহার হয়।
ভ্যান-সিএনজিযোগে পৌঁছে যায় হোটেল-রেস্তোরাঁয়
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর পশ্চিম জুরাইনের তুলা বাগিচার আল্লাহর দান গোস্ত বিতান থেকে আমদানি করা মহিষের মাংস টুকরো করে পলিথিনে ঢুকানো হয়। এরপর ভ্যান বা সিএনজিযোগে আশেপাশের বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় সরবরাহ করা হয়। সকালেই মাংসগুলো পৌঁছে যায় হোটেল-রেস্তোরাঁয়। দুপুর ও রাতের খাবারে মাংসগুলো পরিবেশন করা হয়।
দামে কম হওয়ায় চাহিদা বেশি
রাজধানীর শনির আখড়ার এক রেস্তোরাঁয় শেফ হিসেবে কাজ করেন মো. শোয়েব (ছদ্মনাম)। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, বাজারে গরু ও মহিষের তাজা মাংসের দাম অনেক বেশি। সে তুলনায় ভারত থেকে আনা মহিষের মাংসের দাম বেশ কম। মাংস কম টাকা দিয়ে কিনতে পারলে লাভ বেশি। এজন্য আমদানি করা মহিষের মাংস কেনা হয়। মানহীন হলেও ভালোভাবে মসলা দিয়ে রান্না করলে বোঝা যায় না এটা গরু নাকি মহিষের।
আরও পড়ুন >> ‘বাসায় মাংস নিতে আমারও ভাবতে হয়’
নিউ মার্কেট এলাকার এক বিরিয়ানির দোকানের শেফও নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমাদের এখানে তেহারিতে মহিষের মাংস ব্যবহার করা হয়। পরে তা গরুর তেহারি বলে বিক্রি হয়। যারা খেতে আসেন, তারা বুঝতে পারেন না। অনেকে তেহারিতে মাংসের পরিমাণটা বেশি চান। ৭০০ টাকা দিয়ে মাংস কিনে তো বেশি দেওয়া সম্ভব নয়। এজন্য ৫০০ টাকায় মহিষের মাংস কেনা হয়।
কোথা থেকে আসে মহিষের মাংস
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর তেজগাঁওয়ে রয়েছে ফ্রিজিং করা ভারতীয় মহিষের মাংসের বেশ কয়েকটি ডিপো। ডিপো থেকে ফ্রিজিং ভ্যানের মাধ্যমে মাংসগুলো চলে যায় জুরাইন, নিউ মার্কেটসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে তাদের এজেন্টদের কাছে।
এক হোটেল মালিকের ছদ্মবেশে সেখানে মাংস কিনতে যাওয়া হয়। কথা হয় দায়িত্বরত এক নিরাপত্তা কর্মীর সঙ্গে। তিনি জানান, এখানে ভারত থেকে আমদানি করা মহিষ ও গরুর মাংস পাওয়া যায়। এরপর গেটের ভেতরে নিয়ে যান তিনি৷ ভেতরে কথা হয় শাবলু নামের এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, এখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাংস সরবরাহ করা হয়। সবখানে আমাদের এজেন্ট আছে। রাজধানীর পশ্চিম জুরাইনের তুলা বাগিচার আল্লাহর দান গোস্ত বিতানের মালিক মো. নাছির আমাদের এজেন্ট।
‘জুরাইনে আছেন মনির, রাসেল ও নাছির। তারা এখান থেকে মাংস নিয়ে যান। খুচরা পর্যায়ে তারা একটু বেশি দামে বিক্রি করেন। কারণ, তাদের তো লাভ করতে হবে। মাংসের আমদানি বন্ধের কারণে বর্তমানে দাম একটু বেশি। তারপরও মানুষ নিচ্ছে। নতুন করে আমদানি না হওয়া পর্যন্ত দাম কমবে না।’
এজেন্টদের কাছে পাওয়া মাংসের মান ভালো নয়— এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘ভারতের মাংসগুলো বড় পিস আকারে আসে। সেগুলো তারা ছোট ছোট পিস করে কাটে। অনেক সময় তারা দুই নম্বরি করে কিছু চর্বি ভালো মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। ফলে মাংসের মান পড়ে যায়। এটা আমাদের দোষ না।’
দেশে যেভাবে আসে মহিষের মাংস
গত ২৪ এপ্রিল নতুন বাণিজ্যনীতি কার্যকর হওয়ার পর ভারত থেকে নতুনভাবে মাংস আমদানি বন্ধ আছে৷ কারণ, আমদানি করতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনুমোদন লাগে। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে মাংস আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তবে, আমদানি বন্ধ থাকলেও আগের করা এলসির মাংস এখনও দেশে আসছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, সর্বশেষ ৩ মাসে আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ ৭৮ হাজার ৪০০ কেজি মাংস। এরমধ্যে জুন মাসে ১৫ লাখ ৪৭ হাজার ৪০০ কেজি, জুলাইয়ে ১ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ কেজি এবং আগস্টে ২ লাখ সাড়ে ১২ হাজার কেজি মাংস দেশটি থেকে আমদানি করা হয়েছে। তবে এর বাইরে অঘোষিত অনেক বেশি মাংস ভিন্ন উপায়ে দেশে এসেছে বলে জানা গেছে।
দেশে বছরে ৭৫ দশমিক ২ টন মাংসের চাহিদার বিপরীতে প্রায় ৯২ দশমিক ৬৫ টন মাংস উৎপাদন হয়৷ অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি। এজন্য বৈধ অথবা অবৈধভাবে মাংস আনার বিপক্ষে খাত-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বিদেশ থেকে মাংস আসলে প্রান্তিক খামারিরা তাদের উৎপাদিত পশুর দাম পাবেন না। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধস নামার পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে
দেশে বর্তমানে বৈধ ও অবৈধভাবে ফ্রিজিং করা ভারতীয় মহিষের মাংস প্রবেশ করছে। এক্ষেত্রে কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশ দেখছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, এখানে বড় সিন্ডিকেট জড়িত। কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহায়তায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে মহিষের মাংস দেশে আনছেন। তবে, আগের এলসি করা কিছু মাংসও এখন বৈধভাবে আসছে। এক্ষেত্রেও অনিয়ম হচ্ছে। প্রতি কন্টেইনারে ঘোষণা দিয়ে যে পরিমাণ মাংস আনার কথা তার চেয়ে বেশি আনা হচ্ছে।
আরও পড়ুন >> অর্ধেক গরুর মাংসও বিক্রি করতে পারছেন না সাজেদুর
সীমান্ত দিয়েও অবৈধভাবে মহিষের মাংস দেশে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশের তিন দিকে ভারত। কোনোভাবেই তা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। ভারতে ২০ কেজির মাংসের প্যাকেটের প্রতি কেজির দাম পড়ে ৩০০ টাকা। সেই মাংস বাংলাদেশে বিক্রি হয় প্রায় দ্বিগুণ দামে অর্থাৎ ৬০০ টাকায়। বেশি লাভের কারণে সীমান্তের অনেকে এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন— বলেন ওই কর্মকর্তা।
দেশের থাকতে বিদেশ থেকে কেন
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৭৫ দশমিক ২ টন মাংসের চাহিদার বিপরীতে প্রায় ৯২ দশমিক ৬৫ টন মাংস উৎপাদন হয়৷ অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি। এজন্য বৈধ অথবা অবৈধভাবে মাংস আনার বিপক্ষে খাত-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বিদেশ থেকে মাংস আসলে প্রান্তিক খামারিরা তাদের উৎপাদিত পশুর দাম পাবেন না। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধস নামার পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে।
প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) পরিচালক মো. আব্দুর রহিম (যুগ্ম সচিব) ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারি হিসেবে দেশে চাহিদার চেয়ে গরু-ছাগল বেশি আছে। সেক্ষেত্রে মাংস আমদানি করা হলে খামারিরা ক্ষতির মুখে পড়বেন। এছাড়া অবৈধভাবে আমদানি করাও অপরাধ। এজন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের আরও বেশি তৎপর হওয়া দরকার।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভারত থেকে মাংস আমদানির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের প্রান্তিক খামারিরা। কারণ, দৈনন্দিন মাংসের যে চাহিদা তা প্রান্তিক খামারিদের পালিত পশু থেকেই আসে। আমাদের মতো বড় খামারিরা কোরবানির সময় পশুর জোগান দেন। ভারত থেকে মাংস আসলে পশুর ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হন প্রান্তিক খামারিরা।
মহিষের মাংস গরুর বলে চালিয়ে দেওয়া প্রতারণা
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মহিষের মাংস গরুর বলে চালিয়ে দেওয়ার মানে হলো ভোক্তাদের সঙ্গে সরাসরি প্রতারণা। আবার সেই মাংস (মহিষ) অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসছে। অর্থাৎ সঠিক পদ্ধতিতে ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে এগুলো আসছে না। সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আরও পড়ুন >> কাটা মুরগিতে আগ্রহ বেড়েছে ক্রেতাদের
এছাড়া এ মাংস রোগাক্রান্ত নাকি সুস্থ পশুর, সেটিও পরীক্ষা করা হচ্ছে না। যদি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়, তাহলে মাংস পচে যাবে। এ মাংস মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচিত হবে। এ সংক্রান্ত আইন (নিরাপদ খাদ্য আইন- ২০১৩) আমাদের আছে, আছে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত। আদালতের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়ার বিধান আছে। ভোক্তাদের নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে কি না, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এগুলো পর্যবেক্ষণ করার কথা। বিভিন্ন হোটেল ও রেস্তোরাঁয় অভিযান পরিচালনার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কঠোর আইন থাকলেও এর প্রয়োগ হচ্ছে না। মানহীন ও পচা মাংস সরবরাহ ও পরিবেশন রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার— বলেন এ আইনজীবী।
‘ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে মাঝেমধ্যে শাস্তি দেওয়া হলেও এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁ আটকানো যাবে না। তাই নিরাপদ খাদ্য আইনের মাধ্যমে আদালতে বিচার করতে হবে।’
আইনে যা আছে
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, ভোক্তাকে প্রতিশ্রুত পণ্য না দিলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এ আইনের ৪৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড, বা অনধিক ৫০ হাজার টাকার অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
অন্যদিকে, মেয়াদোত্তীর্ণ ও পচা খাদ্য খাওয়ার পর স্বাস্থ্যহানি হলে নিরাপদ খাদ্য আইনে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এ আইনের ২৯ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বা তার পক্ষে নিয়োজিত অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুত, সরবরাহ বা বিক্রয় করতে পারবে না। এ বিধান প্রথমবার ভঙ্গ করলে এক থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড বা চার থেকে ছয় লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার এ অপরাধ করলে তিন বছর কারাদণ্ড বা ১২ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
রোগাক্রান্ত বা পচা মাংসের বিষয়ে ৩৪ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বা তার পক্ষে নিয়োজিত অন্য কোনো ব্যক্তি রোগাক্রান্ত বা পচা মৎস্য বা মৎস্যপণ্য অথবা রোগাক্রান্ত বা মৃত পশু-পাখির মাংস, দুগ্ধ বা ডিম দ্বারা কোনো খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ প্রস্তুত, সংরক্ষণ বা বিক্রয় করতে পারবেন না। প্রথমবার এ অপরাধ করলে এক থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন থেকে ছয় লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে তিন বছর কারাদণ্ড বা ১২ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
হোটেল-রেস্তোরাঁ বা ভোজনস্থলের পরিবেশন-সেবার বিষয়ে ৩৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বা তার পক্ষে নিয়োজিত অন্য কোনো ব্যক্তি হোটেল, রেস্তোরাঁ বা ভোজনস্থলে পরিবেশনসেবা প্রদানকারী, প্রবিধানের মাধ্যমে বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনের অধীন নির্ধারিত মানদণ্ডের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দায়িত্বহীনতা, অবহেলা বা অসতর্কতার মাধ্যমে খাদ্যগ্রহীতার স্বাস্থ্যহানি ঘটাতে পারবেন না। প্রথমবার এ বিধান ভঙ্গ করলে এক থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন থেকে ছয় লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে তিন বছর কারাদণ্ড বা ১২ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড পাবেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি।
দায় নিতে চায় না আমদানিকারকরা
বাংলাদেশে ৬৭টি প্রতিষ্ঠান ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে গরু-মহিষের মাংস আমদানি করে থাকে। তবে মানহীন মাংসের বিষয়ে কোনো দায় নিতে চায় না তারা।
দেশে মাংস আমদানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ মিট ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমআইটিএ) সভাপতি শামীম আহম্মেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাপ্লাই চেইনের কারণে কারও কারও মাংস খারাপ হতে পারে। দেশি গরুও যদি আজকে জবাই করে কালকে সাধারণভাবে রেখে মাংস বিক্রি করা হয়, তাহলে সেটাও মানহীন হয়ে যাবে। আমদানি করা মাংসের মান যদি খারাপ হয়, অবশ্যই দেশে এসে খারাপ হবে। যেহেতু এটি ফ্রোজেন প্রোডাক্ট (হিমায়িত পণ্য) কেউ যদি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করে বা খাদ্য নিরাপত্তার যে পদ্ধতি আছে, সেটা যদি মেইনটেন না করে বিক্রি করে, সেটা মানহীন হবেই। তবে আমরা কাউকে বলব না পচা মাংস কিনতে।
বর্তমানে ভারত থেকে মাংস আমদানি বন্ধ থাকলেও অবৈধভাবে নয়, আগের এলসি দিয়েই মাংস আসছে বলেও দাবি করেন তিনি।
ব্যবস্থা গ্রহণে ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ’ চায় কর্তৃপক্ষ
হোটেল বা রেস্তোরাঁয় গরুর নামে মহিষের মাংস বিক্রির বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য দিলে আমি বিষয়টি দেখব। অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব৷
ভারত থেকে আসা মহিষের মাংসগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের— বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, ‘মানের জন্য নমুনা সংগ্রহ করতে হয়। আপনি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে বলুন। এটা টোটালি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের বিষয়। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। কারণ, আমি তো সবকিছু দেখতে পারব না। খাদ্যের মানের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ আছে এবং তাদের ক্ষমতা আমার চেয়ে বেশি।’
বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল কাইউম সরকারের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘ভেজাল, বাসি-পচা ও নকল খাদ্য থেকে জনগণকে মুক্ত রাখতে আমরা কাজ করছি৷ আইন প্রয়োগের জন্য আমরা নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য নিশ্চিত করতে চারজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছেন। আমরা যখন যেখানে এ ধরনের অবৈধ বা নকল খাদ্যদ্রব্য পাই তখনই ব্যবস্থা নিই। হোটেল-রেস্তোরাঁয় মানহীন মহিষের মাংসের বিষয়েও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা এ প্রসঙ্গে বলেন, মহিষের মাংসের অবৈধ আমদানির বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা চেষ্টা করছি, আপনারাও সহযোগিতা করুন। অনুসন্ধানী রিপোর্ট করুন। এতে দেশের মানুষ উপকৃত হবেন।
তবে সীমান্ত দিয়ে মহিষের মাংস দেশে প্রবেশের বিষয়টি অস্বীকার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফায়জুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এ বিষয়টির যথেষ্ট খেয়াল রাখছি। সীমান্ত দিয়ে এখন এগুলো একেবারেই হয় না। আমরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন।
তিনি আরও বলেন, আমরা সীমান্তে গবাদিপশুর চোরাচালানের বিষয়টিতেও অনেক বেশি জোর দিয়েছি। এ কারণে কোরবানির ঈদের সময়েও চোরাচালানের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। এটাকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছি এবং সে অনুযায়ী সফলতাও পাচ্ছি। বর্তমানে আমরা সীমান্ত ব্যবস্থা এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছি, চোরাচালানের বিষয়টি প্রায় সম্পূর্ণভাবে দমন হয়েছে বলে আমরা মনে করছি।
এসএইচআর/এমএআর