বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি, ‘না’-তে মত বেশি
দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির চর্চা ছিল নীরবে। ‘শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করবে না’— এমন শর্তে রাজি হয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে বহুবার ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সুফল মেলেনি। এবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি ‘ওপেন’ করার দায়িত্ব নিল ছাত্রলীগ।
সম্প্রতি ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিক কমিটি ঘোষণা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনটি। এর মধ্যে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট, ব্র্যাক, ড্যাফোডিল, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় রাজধানীতে অবস্থিত। অন্য চারটি ঢাকার বাইরের। সবমিলিয়ে ৩৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে ‘সমন্বিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ’-এর ব্যানারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া।
গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে ‘সমন্বিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ’-এর ব্যানারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। এরপর থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি ঢোকানোর চেষ্টা নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন
এরপর থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি ঢোকানোর চেষ্টা নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। ক্যাম্পাসের ভেতরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হলে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। তাদের প্রশ্ন, ছাত্ররাজনীতির নামে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে হানাহানি হয়, সেটা কি এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রবেশ করবে?
আরও পড়ুন >> শিক্ষাব্যবস্থা হবে আনন্দময়, থাকবে না বইয়ের বাড়তি চাপ
গত কয়েক দিনে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকরা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির সুযোগ না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট উপাচার্যদের ই-মেইল করেছেন। এমন অভিভাবকের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি’।
এদিকে, ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পরই নড়েচড়ে বসেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির চর্চা, কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা, উদ্দেশ্য ও পরিণতির বিষয়ে জানতে ঢাকা পোস্ট কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম এম শাহিদুল হাসান, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মো. আবু হোরায়রা, ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি রেজওয়ান মুক্ত, ছাত্রলীগের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি জাহিদ হোসেন পারভেজ এবং দেশের বাইরে অধ্যয়নরত কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান
ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর থেকে ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ক্যাম্পাস রাজনীতিকে ‘না’ করে ইতোমধ্যে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে ব্র্যাক, নর্থ সাউথ, ইস্ট ওয়েস্ট, আইইউবিএটি, এআইইউবি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়টি নজরে আনলে সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কী নিয়ম-কানুন করল, সেখানে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের (প্রতিষ্ঠান) কী ব্যবস্থা হলো, সেটা প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দলের বিষয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেটা ঠিক করে দেয় না। আমরা কোনো হস্তক্ষেপও করি না।
তবে, এসব প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিষিদ্ধ রাখার বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে এক হাত নিতেও ছাড়েননি মন্ত্রী। বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান কখনও রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে না। কারণ, রাজনীতি করা মানুষের অধিকার। কিন্তু দলীয় রাজনীতি কীভাবে হবে, সেখানে রাজনীতি যারা করবেন সেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের বোঝাপড়া, সৌহার্দ্য থাকা উচিত।
এদিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্তের ভার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘাড়েই চাপিয়ে দিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। সেক্ষেত্রে ছাত্ররাজনীতি করতে দেওয়া, না দেওয়ার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
আরও পড়ুন >> ছাত্রলীগ নিয়ে এত সমালোচনা কেন?
এদিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যকে স্বাগত জানায় বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি। তবে, তারা ছাত্ররাজনীতি না থাকার বিষয়ে অনড়। দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের রাজনীতি সচেতনতা ও সম্পৃক্ততাকে নিরুৎসাহিত করে না। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে কি-না, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম দ্বারা নির্ধারিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে উপাচার্যরা শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিয়ম-কানুন বজায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সহমত ও সন্তুষ্ট। ক্যাম্পাসের বাইরে ইতিবাচক রাজনীতির ধারায় অংশগ্রহণ করার বিষয় একান্তই শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা ঠিক করবেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে যা আছে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ১৯৯২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হলেও গত ৩০ বছরে কোনো ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর দৃশ্যত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে ১৯৯২ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন এবং ২০১০ সালে সংস্কার করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে। যেখানে সরাসরি ‘ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ’ করার কথা উল্লেখ নেই। তবে, জাতীয় ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থে ক্ষতিকর এমন কোনো কাজ না করার বিষয়টি উল্লেখ আছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ৬ (১০) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রস্তাবিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বার্থ ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত হইতে পারে এমন কোনো কার্যকলাপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করিবে না বা সন্ত্রাসী বা জঙ্গি তৎপরতা বা এই জাতীয় কোনো কার্যকলাপে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কোনোভাবেই কোনো পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করিবে না’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ৬ (১০) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রস্তাবিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বার্থ ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত হইতে পারে এমন কোনো কার্যকলাপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করিবে না বা সন্ত্রাসী বা জঙ্গি তৎপরতা বা এই জাতীয় কোনো কার্যকলাপে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কোনোভাবেই কোনো পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করিবে না।’
৩৫ (৭) ধারায় বলা হয়েছে, ‘(৭) কোনো কারণে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা দেখা দিলে কিংবা উহার স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত ও শিক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে, উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষাকার্যক্রম অব্যাহত রাখিবার স্বার্থে চ্যান্সেলর কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশক্রমে প্রয়োজনীয় আদেশ ও নির্দেশ দিতে পারিবেন এবং এতদ্বিষয়ে চ্যান্সেলরের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গণ্য হইবে।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি এবারই কি প্রথম
সম্প্রতি ছাত্রলীগের ঘোষিত কমিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কমিটি নয়। ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি শুরু হয় মূলত ২০০৯ সালে, ছাত্রদলের মাধ্যমে। ২০১১ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল নামে একটি ইউনিট গঠনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্ররাজনীতি শুরু হয়। তখন ৪৯ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি শুরু হয় মূলত ২০০৯ সালে, ছাত্রদলের মাধ্যমে। ২০১১ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল নামে একটি ইউনিট গঠনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্ররাজনীতি শুরু হয়। তখন ৪৯ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়
তাদের দেখাদেখি ২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর প্রথম সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি গঠন করে ছাত্রলীগ। ছাত্রদল ২০১৩ সাল পর্যন্ত নয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি দেয়। ওই বছর (২০১৩ সাল) থেকে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি দেওয়া শুরু করে ছাত্রলীগও। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আপত্তির মুখে কোনো দলই খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। পরে ২০১৮ সালে ৬৪৮ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেয় ছাত্রদল। সর্বশেষ চলতি বছরের ৩০ জুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটে পাঁচ সদস্যের কমিটি করে দলটি।
শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবিতে তাদের সঙ্গেই ছিল ছাত্রনেতারা
২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আরোপ করা ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। ওই সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের তৎপরতাও লক্ষ করা যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিষেধাজ্ঞার কারণে সেসময় তাদের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় টিউশন ফি কমানোর দাবিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেন। এসব আন্দোলন কর্মসূচিতে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন কর্মকাণ্ড চালিয়েছে সত্যি, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো দলের ব্যানারে কর্মকাণ্ড চালাতে দেখা যায়নি তাদের।
বেসরকারিতেও পাবলিকের মতো দাদাগিরি শুরু হবে
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক হিসাবে বলা হয়েছে, ২০২০ সাল থেকে গত আগস্ট মাস পর্যন্ত ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সৃষ্ট সংঘর্ষে ছয়জন নিহত এবং ২২০ জন আহত হয়েছেন। একই সময়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে অন্য রাজনৈতিক দল, তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘাতে তিনজন নিহত এবং ৫২০ জন আহত হয়েছেন।
আরও পড়ুন >> আবরার হত্যাকাণ্ড : কাঠগড়ায় ছাত্ররাজনীতি
এমন দ্বন্দ্ব, সংঘাত, হানাহানি ও সংঘর্ষের আশঙ্কায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চান না সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে, কিছু শিক্ষার্থী সুষ্ঠু রাজনীতির পক্ষে। তাদের চাওয়া, রাজনীতি যেন হয় সংঘাতমুক্ত।
এ বিষয়ে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী রাসেল মাহমুদ বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল ও ক্যাম্পাসে সব সময়ই হানাহানি-সংঘাত লেগে থাকে। ক্যাম্পাসগুলোতে ক্ষমতাসীনদের হাতে অনেক বিরোধী ছাত্রনেতা ও কর্মীর পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীরাও নিয়মিত হামলার শিকার হচ্ছেন। এর বাইরে নিজেদের দুই গ্রুপে মারামারি হচ্ছে, অন্যদের ওপর হামলা হচ্ছে। এমন নেতিবাচক রাজনীতি আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাই না। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তাদের অবস্থান আরও শক্ত করা উচিত।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী রিফাত তানভীর বলেন, ‘সামনে নির্বাচন। দল ভারী করতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি ঢোকানোর চেষ্টা চলছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চালু হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দাদাগিরি তৈরি হবে। যেমন- মহাখালী, ওয়ারলেসসহ আশেপাশের এলাকায় সরকারি তিতুমীর কলেজের নেতাদের দাদাগিরি চলে। সেখানে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় সংঘাতের খবর পাওয়া যায় অনেক সময়। তিতুমীরের পাশেই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। এখানে ছাত্রলীগের কমিটি থাকলে তাদের সঙ্গে আধিপত্য বিস্তারে যে সংঘাত হবে না, এর নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। অন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রেও এমনভাবে আশেপাশের ইউনিট কর্তৃক প্রভাবিত হওয়ার শঙ্কা আছে।
‘যদি এমন হতো, যার ইচ্ছা রাজনীতি করবে, যার ইচ্ছা করবে না; পাবলিকের মতো সংঘাত হবে না। তাহলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি থাকলে সমস্যা ছিল না। এর ইতিবাচক দিক হলো, হঠাৎ করেই ফি বাড়ানোসহ প্রশাসন যা ইচ্ছা তা করতে পারত না। একটা জবাবদিহিতা তৈরি হতো। তবে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটা হবে কি-না, তা অনিশ্চিত।’
স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী কাব্য সাহা বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন সংঘাত-হানাহানি চলে, তেমনটা হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির দরকার নেই। তবে, সুষ্ঠু ধারার রাজনীতিকে আমি সবসময় স্বাগত জানাব। এটা থাকলে ছাত্রসংগঠনগুলো আমাদের অধিকার নিয়ে কথা বলবে।
বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী অবস্থা
কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের নোভা কমিউনিটি কলেজ থেকে এক বছরের বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কোর্স সম্পন্ন করে দেশে ফিরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোতাসিম বিল্লাহ। তার কাছে সেখানকার ছাত্ররাজনীতি নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, আমার সরকারি কমিউনিটি কলেজের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানি, যেখানে শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বেশি লিপ্ত থাকেন। প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যারিয়ার সেন্টার থাকে। প্রফেশনাল অভিজ্ঞতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সরকার সহযোগিতা করে। তরুণ প্রজন্মের সবাই চাকরি করে। স্কুলপর্যায়েই তারা পার্টটাইম চাকরি শুরু করেন। স্নাতক শেষে ফুল টাইম চাকরিতে ঢোকেন।
আরও পড়ুন >> কেন বন্ধ হচ্ছে না ঢাবির ‘গেস্টরুম নির্যাতন’?
‘সেখানে শিক্ষার্থীরা চাকরি ও উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য বেশি সময় ব্যয় করেন। সে কারণে রাজনীতি নিয়ে তারা তেমন আগ্রহী নন। আমাদের দেশের মতো সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘাত হয় না। এছাড়া তারা পড়াশোনায় এত ব্যস্ত থাকে যে রাজনীতির জন্য আমাদের দেশের ছাত্রনেতাদের মতো এত ফ্রি সময় তাদের থাকে না।’
নেদারল্যান্ডের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেস-এ পড়াশোনা করছেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থী হিমেল খান। তিনি বলেন, এখানে কোর্সের পড়াশোনা অনেক। তার ওপর আছে সহশিক্ষা কার্যক্রম। সবমিলিয়ে একদমই সময় পান না শিক্ষার্থীরা, রাজনীতি করবে কখন? তাছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতিও নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী হাসান মেহেদী বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের মতো ‘স্টুডেন্ট গভর্নমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’ (এসজিএ) আছে। তবে, এটা রাজনীতিমুক্ত। প্যানেল ছাড়াই যে কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। শিক্ষার্থীরা সহশিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশ নেয়। বিশেষ করে স্পোর্টস, মিউজিক, ড্রামস, ডান্স, চিয়ার লিডিংসহ অন্যান্য কার্যক্রমে তাদের আগ্রহ বেশি। এক বছরের বেশি সময় ধরে এখানে আছি, কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দেখিনি।
‘বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মতো পড়াশোনা বাদ দিয়ে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ছাত্র সংগঠনকে রিপ্রেজেন্ট করার মতো সময় এখানে কারও নেই। এখানে পড়াশোনা অনেক ব্যয়বহুল। বাপের বা নিজের টাকা খরচ করে রাজনৈতিক সংগঠনের গান ক্যাম্পাসে গাওয়ার মতো সময় নাই কারও। কেউ যদি কোনো দল সাপোর্ট করে, পড়াশোনা শেষে অফিসিয়ালি ওই দলে অংশ নেয় সে; ক্যাম্পাসে নয়।’
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক আসিফ তালুকদার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্রনেতা ছাত্ররাজনীতি থেকে ইস্তফা দিয়ে এখন নেদারল্যান্ডের উইটেনবার্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেস-এ অধ্যয়নরত। তিনি বলেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নেই। থাকলেও পড়াশোনার চাপে রাজনীতি করার সময় পাওয়া যায় না।
‘বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি আর এখানকার (নেদারল্যান্ড) ছাত্ররাজনীতি এক নয়। কিছুটা পার্থক্য অবশ্যই আছে। আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে ছাত্রনেতাদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু অন্য দেশে ছাত্রনেতাদের দেশ স্বাধীন করতে হয়নি। সে কারণে তারা ছাত্ররাজনীতির প্রতি আগ্রহী নয়।’
ছাত্রলীগের কমিটি, সুযোগ অন্যদেরও
ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা সুযোগ করে দিয়েছে অন্যদেরও। এরই মধ্যে কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি প্রস্তুত করেছে ছাত্রদল। সেগুলো হলো- নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি ও স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। খুব দ্রুত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি দেবে তারা।
ছাত্র সংগঠনটির কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে কিছুদিন আগে। সে কারণে বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্মী সম্মেলন কিছুটা পিছিয়েছে। কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সময় পেলে এগুলোতে দ্রুত কমিটি দিতে চান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মো. আবু হোরায়রা।
আরও পড়ুন >> হঠাৎ জয়-লেখকের এত তাড়াহুড়া কেন?
এদিকে, ছাত্র ইউনিয়নের কমিটি আছে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে। খুব দ্রুত তারা নর্থ সাউথ, ব্র্যাক ও ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে কমিটি দেওয়ার চেষ্টা করছে। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনেরও এ বিষয়ে এগিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে।
ছাত্র সংগঠনগুলো যা বলছে
ছাত্রলীগের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি জাহিদ হোসেন পারভেজ বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ছাত্ররাজনীতি নেই। ফলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার বিষয়টি থেকেই যাচ্ছে। ছাত্ররাজনীতি না থাকায় শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতি সেমিস্টারে টিউশন ফি বৃদ্ধি, গ্রেডিং পদ্ধতিতে অসামঞ্জস্যতা থাকছে। মালিকপক্ষ যেকোনো সময় শিক্ষার্থীদের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ করে। শিক্ষার্থীরাও সবকিছু মেনে নিচ্ছে ছাত্ররাজনীতি না থাকার কারণে।
‘গত ১০ বছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ কোনো নেতিবাচক সংবাদের শিরোনামে ছিল না। ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন হলের সিট নিয়ে রাজনীতি, ক্ষমতার রাজনীতির চর্চা করা হয়, এখানে সেই বিষয়গুলো নেই। বর্তমান যুগে যে রাজনীতি চলছে সে জায়গা থেকে বের হয়ে ইতিবাচক ধারার ছাত্ররাজনীতির নজির স্থাপন করতে চাই।’
জাহিদ হোসেন বলেন, রাজনীতির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একের পর এক নোটিশ দিয়ে যাচ্ছে। আমরা কোনো প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি না। কারণ, ক্যাম্পাসগুলোতে এখন সেমিস্টার ফাইনাল চলছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছি। সমঝোতা করার চেষ্টা করছি। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা শেষ হলে আমরা এসব নোটিশের গঠনমূলক জবাব দেব।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ বলেন, যে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি জড়িত, সে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কীভাবে রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়? এটা আমাদের বোধগম্য নয়। ছাত্রদল মনে করে, ছাত্ররাজনীতি থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জবাবদিহিতার মধ্যে থাকে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে রাখছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল-ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। আপনাদের অনেকেই সম্প্রতি হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি সচল হলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রশাসন বিষয়টি হাইলাইট করেই ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে মত দিচ্ছে। একটি ছাত্র সংগঠনের কোনো ইউনিটের নেতৃত্বে যদি দুর্বলতা থাকে, যদি শৃঙ্খলার সমস্যা থাকে, সেটা সাময়িক সমস্যা। এজন্য সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরকারের আজ্ঞাবহ না হয়ে যদি কঠোর হয়, তাহলে কোনো ক্যাম্পাসেই সংঘাতের আশঙ্কা আছে বলে আমরা মনে করি না।’
আরও পড়ুন >> ‘অপরাধীরা’ লেখকের ঘনিষ্ঠ!
ছাত্র ইউনিয়নের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি রেজোয়ান মুক্ত ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিভাবকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আগে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের তাণ্ডব দেখেছে। বিগত ১০ বছর ধরে ছাত্রলীগের তাণ্ডব দেখছে। সে কারণে তারা ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে। আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রগতিশীল রাজনীতির চর্চা চাই।
ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, শিক্ষার্থীদের কথা বলার মাইলফলক হচ্ছে ছাত্র সংগঠনগুলো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অভিন্ন টিউশন ফি বাস্তবায়ন, ইউজিসির চাপিয়ে দেওয়া নীতিমালা না মানার বিরুদ্ধে ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন আছে। ছাত্রসংগঠন থাকলে তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে অধিকার আদায়ের দাবি জানাতে পারে। ছাত্ররাজনীতি না থাকায় গোপনে প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। সেখানে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারলে এটা আরও বৃদ্ধি পাবে। যা ছাত্ররাজনীতির জন্য হুমকি।
বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার জন্য গত তিনদিন টেলিফোনে চেষ্টা করেও [ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
যা বলছেন শিক্ষক-শিক্ষাবিদরা
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক এম এম শাহিদুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রত্যেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ক্লাব বা সংগঠন আছে। তারা বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করে। কাজেই শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতে রাজনৈতিক সংগঠনই লাগবে, এমন নয়।
‘যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্টি বোর্ড সংক্রান্ত সমস্যা আছে, তা দেখার জন্য তো শিক্ষা মন্ত্রণালয় আছে, ইউজিসি আছে। এসব সমস্যার সমাধানের জন্য রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন কোনোভাবেই অত্যাবশ্যকীয় নয়। এগুলো ভালো যুক্তি মনে হচ্ছে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশে কি সত্যিকার অর্থে কোনো ছাত্ররাজনীতি আছে? ছাত্ররাজনীতি তখনই সম্ভব যখন ছাত্ররা স্বেচ্ছায় কোনো একটি আদর্শের ভিত্তিতে ছাত্রদের জন্য রাজনীতি করবে। বাংলাদেশে কোনো ছাত্র সংগঠন কি ছাত্রদের জন্য রাজনীতি করে— প্রশ্ন রাখেন তিনি।
‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অমানবিক জীবন-যাপন করে। থাকার সমস্যা, খাবার সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত তারা। এগুলো নিয়ে ছাত্র সংগঠন বা রাজনীতি করা শিক্ষক নেতারা কি কখনও দাবি তুলেছেন?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক বলেন, দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্রদের জন্য রাজনীতি করে। ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে কথা তোলে। এভাবে দাবি জানানোর মাধ্যমে তারা নেতৃত্ব শেখে। আমাদের দেশে এটা তো শেখেই না, কীভাবে সোজা মেরুদণ্ড বাঁকা করতে হয়, সেটা শেখে। ছাত্রাবস্থায় তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে বলেই রাজনীতির আজ এ দুরবস্থা। দেশজুড়ে এখন তোষামোদির প্যানডেমিক চলছে। এ রাজনীতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গেলে শিক্ষার মান চিরতরে বাংলাদেশ থেকে উঠে যাবে। ফলে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো তারা বিদেশ চলে যাবে এবং আর আসবে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নষ্ট হলে আরও বেশি শিক্ষার্থী দেশ থেকে বাইরে চলে যাবে। দেশের টাকাও বিদেশে চলে যাবে।
‘সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক প্রহরী দরকার। কারও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, কারও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চালুর দাবির পেছনে দেশের বা ছাত্রদের ন্যূনতম স্বার্থ জড়িত নয়।’
শিক্ষাবিদ ও ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান চৌধুরী বলেন, ছাত্রজীবনে আমরা তুখোড় রাজনীতি করেছি। তাই ছাত্ররাজনীতি করা ঠিক নয়, এটা বলতে পারব না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, স্বাধীনতার আগের এবং পরের ছাত্ররাজনীতির মধ্যে তফাত রয়েছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে ছাত্ররাজনীতির অবদান আছে। স্বৈরাচার প্রতিরোধে ছাত্রদের অবদান আছে। তখন ছাত্ররাজনীতি ছিল, এখনকার মতো অপরাজনীতি ছিল না।
‘স্বৈরাচার বিতাড়নে ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন ছিল, ওই সময় ছাত্ররা মাঠে ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের প্রয়োজন ছিল, সেক্ষেত্রে ছাত্রদের অবদান আমরা অস্বীকার করব না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ছাত্ররা, আমরা অবদান রেখেছি। এ তিনটি ক্ষেত্রে অবদান ছাড়া স্বাধীনতার পর ছাত্ররাজনীতিতে বিভক্তি, হানাহানি শুরু হয়। সবাই আত্ম-অন্বেষণে লিপ্ত হয়।’
“বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে বলা আছে, শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে। তাই সংঘাতময় এ ছাত্ররাজনীতিকে যদি আমরা উৎসাহিত করি, তাহলে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। ফলে বিত্তবানরাও ছেলে-মেয়েদের এ দেশে রাখবে না। পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে। অভিভাবকদের কাছে আমরা জানতে চেয়েছি, তারা ছাত্ররাজনীতি চান কি না। তারা ‘চান না’ বলে জানিয়েছেন। এসব অভিভাবকের দেওয়া টাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলে। তারা যদি ছাত্ররাজনীতি না চান, আমরা কোন যুক্তিতে সেটা উৎসাহিত করব?”
অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান চৌধুরী বলেন, সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্ট আইনের অধীন। এ আইনের ১৭ ধারায় বলা আছে, সবার জন্য সমতার বিধান করতে হবে। একই প্রাঙ্গণে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন থাকলে সবার জন্য সমান অধিকার দেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া, অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষুদ্রাকারের, করিডোরগুলোও ছোট। ‘আমার ভাই, তোমার ভাই’ স্লোগান দেওয়ার মতো জায়গা সেখানে নেই। ছাত্ররাজনীতির কারণে এ ক্ষুদ্র জায়গায় সংঘাত হলে জীবনহানির সম্ভাবনা প্রচুর। যে ছাত্ররাজনীতিতে আদর্শবাদ নেই, জীবনহানির শঙ্কা আছে, সেখানে আমাদের অ্যাসোসিয়েশন (বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি) যা বলেছে, তাকেই আমরা সঙ্গত বলে বিবেচনা করছি।
এ শিক্ষাবিদের মতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ শতাংশ শিক্ষা কার্যক্রম আর ৫০ শতাংশ সহশিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে। দুটোর সংমিশ্রণে এত বেশি সময় দিতে হয় যে তাদের রাজনীতি করার অবকাশ থাকে না। সুযোগ দিলেও অনেকে রাজনীতি করতে পারবে না। ক্লাসের পাঠদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতি এমন যে শিক্ষার্থীদের সারাক্ষণই কোনো না কোনোভাবে ব্যস্ত থাকতে হয়। এর ওপর সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এত বেশি, তাদের হাতে সময়ই থাকে না। এসব কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থী রাজনীতি চায় না। তারা না চাইলে আমরা কীভাবে দেব?
মুখ খুলতে নারাজ ইউজিসি
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান, সচিব, একজন সদস্য ও একজন পরিচালকের মুঠোফোনে কল দেওয়া হয়। তবে, কেউই মুখ খুলতে রাজি হননি।
প্রথমে ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামানের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দকে কল করা হলে তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক মো. ওমর ফারুকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
মো. ওমর ফারুকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইউজিসি সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে’। এর বাইরে কিছু বলতে চাননি তিনি। তবে তার পরামর্শ, এ বিষয়ে চেয়ারম্যান ভালো বলতে পারবেন। জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য নয়।’
এএজে/এমএআর/