মোহাম্মদ সাঈদ। ২০২০ সালের ৬ নভেম্বর ঢাকা থেকে দুবাই যাওয়ার উদ্দেশে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান। তবে তার ট্রাভেলে ঝামেলা আছে বলে পাসপোর্টে ‘অফলোড’ সিল দিয়ে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠায় ইমিগ্রেশন পুলিশ। সেবার তিনি নিজেই ভিসা করে দুবাই যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ৪ ডিসেম্বর আবারও টিকিট কেটে বিমানবন্দরে যান সাঈদ। ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে যেতেই ফোন দেন একজন দালালকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে দুবাই যাওয়ার অনুমতি দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ।

সাঈদের মতো প্রতিদিন শত শত বাংলাদেশি ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার সময় তাদের ‘অফলোড’ সিল দেওয়া হচ্ছে। তবে দালালের সঙ্গে ‘কনট্রাক্ট’ করে সেই অফলোড তুলে সহজেই বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন তারা।

ভুক্তভোগী সাঈদসহ প্রায় ২০ জন প্রবাসী ঢাকা পোস্টকে জানান, এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের (বিমানবন্দর বন্দোবস্ত) কারণেই এটা সম্ভব হচ্ছে। এ কন্ট্রাক্ট হয় ট্রাভেল এজেন্সি, দালাল ও বিমানবন্দরে কর্মরত পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ইমিগ্রেশন অফিসারদের মধ্যে। সাঈদসহ মোট পাঁচজনের বক্তব্যের রেকর্ড, ভিডিও এবং একজনের পাসপোর্টের কপি ঢাকা পোস্টের কাছে এসেছে।

‘অফলোড’ সিল দেওয়ার পরও এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের (বিমানবন্দর বন্দোবস্ত) কারণেই অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। এ কন্ট্রাক্ট হয় ট্রাভেল এজেন্সি, দালাল ও বিমানবন্দরে কর্মরত পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ইমিগ্রেশন অফিসারদের মধ্যে। এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে বিদেশে পাড়ি দেওয়া সাঈদসহ মোট পাঁচজনের বক্তব্যের রেকর্ড, ভিডিও এবং একজনের পাসপোর্টের কপি ঢাকা পোস্টের কাছে এসেছে

এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের অভিজ্ঞতার বিষয়ে জানতে চাইলে সাঈদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথমবার সাত হাজার দিরহাম (বাংলাদেশি মুদ্রায় এক লাখ ৬৮ হাজার টাকা) খরচ করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে দুবাই যাওয়ার চেষ্টা করি। আমি যার মাধ্যমে যাওয়ার চেষ্টা করি তিনি সম্ভবত এয়ারপোর্টে কন্ট্রাক্ট করেননি। ওই ফ্লাইটে সবাইকে যেতে দিলেও, আমাকে বোর্ডিং পাসই দেওয়া হয়নি। তিন/চারবার যোগাযোগের পর আমাকে চেক-ইন কাউন্টার থেকে বলা হয়, ‘আপনি ওপরে যোগাযোগ করেন। আপনার ট্রাভেলে সমস্যা আছে।’

স্বপ্নের শহর দুবাই। প্রবাসীদের আকাঙ্ক্ষা থাকে এ শহরে কাজ করার | ছবি- ঢাকা পোস্ট

বিমান ছাড়ার কিছুক্ষণ আগে একজন পুলিশ কর্মকর্তা আসেন আমার কাছে। আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, কী সমস্যা? আমি তাকে আমার সমস্যার কথা বললে ওই পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে বোর্ডিং পাস নিয়ে দেন। ইমিগ্রেশনের সময় আমার পাসপোর্ট, টিকিট ও সব কাগজপত্র নিয়ে যান একজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা।

এক লাখ ৬৫ হাজার টাকায় সংশ্লিষ্ট এক দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সবকিছু সম্পন্ন করে এমিরেটসের ফ্লাইটে উঠতে বিমানবন্দরে যাই। দ্বিতীয়বার আমাকে তেমন কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। শুধু যখন ইমিগ্রেশনে গেছি, তখন আমাকে বলা হলো, ‘আপনার তো অফলোড করা আছে।’ এ কথা বলার পর আমি ওই দালালকে কল দেই। দালাল সম্ভবত ভেতরের কোনো অফিসারের সঙ্গে কথা বলেন। তখন ভেতর থেকে একজন অফিসার এসে বলেন, ‘ওর অফলোড কেটে দাও, ওকে যেতে দাও।’ এরপর আমাকে যেতে দেয়

‘অফলোড’ সিল পাওয়ার পরও দুবাই যাওয়া সাঈদ

সাঈদ বলেন, বিমান ছাড়ার ১০-১৫ মিনিট পর আমার হাতে পাসপোর্টটি ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়, আপনার ট্রাভেলে সমস্যা আছে, আপনি এখন আরব-আমিরাত যেতে পারবেন না। এরপর আমার পাসপোর্টের ৪৪ নম্বর পেজে কিছু একটা লিখে দেওয়া হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, আমাকে ‘অফলোড’ করা হয়েছে। ২-৩ দিন আমি পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) অফিসে যাই, বিমানবন্দরের বিভিন্ন দপ্তরে যাই। কিন্তু সবাই বলে, আমার দুবাই যাওয়া সম্ভব নয়।

অফলোড সিল পাওয়ার পর দুবাই যাওয়া জালাল, সেখানে কথা হয় ঢাকা পোস্টের সঙ্গে

“এরপর আমি ভারত হয়ে ইউএই যাওয়ার চেষ্টা করি। তবে সবাই বলেছে, আমি যেতে পারব না। তখন একজনের সঙ্গে পরামর্শ করে আমি ‘হাই লেভেল কন্ট্রাক্ট’ (উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ) করি। ডিসেম্বরের ৫ তারিখ আমার ভিজিট ভিসার শেষদিন ছিল। ডিসেম্বরের ৪ তারিখে আমি এক লাখ ৬৫ হাজার টাকায় সংশ্লিষ্ট এক দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সবকিছু সম্পন্ন করে এমিরেটসের ফ্লাইটে উঠতে বিমানবন্দরে যাই।”

দ্বিতীয়বার আমাকে তেমন কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। শুধু যখন ইমিগ্রেশনে গেছি, তখন আমাকে বলা হলো, ‘আপনার তো অফলোড করা আছে।’ এ কথা বলার পর আমি ওই দালালকে কল দেই। দালাল সম্ভবত ভেতরের কোনো অফিসারের সঙ্গে কথা বলেন। তখন ভেতর থেকে একজন অফিসার এসে বলেন, ‘ওর অফলোড কেটে দাও, ওকে যেতে দাও।’ এতটুকুই বলেছে, এরপর আমাকে যেতে দিয়েছে— ঢাকা পোস্টকে বলেন সাঈদ। সাঈদের পাসপোর্টের কপিটি ঢাকা পোস্টের কাছে সংরক্ষিত আছে।

বাংলাদেশ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) অধিকাংশ শহরেই ভিজিট অথবা টুরিস্ট ভিসায় যান বাংলাদেশিরা। তিন মাসের ভিসায় গিয়ে অনেকেই কাজ খুঁজে নেন। কেউ আবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। দেশ থেকে ইউএই যাওয়ার সময় ট্রাভেল এজেন্সিকে এক লাখ ২০ হাজার থেকে দেড়লাখ টাকা দেন ইচ্ছুক ব্যক্তিরা। সেই টাকার মধ্যে ভিসা প্রোসেসিং, টিকিটের মূল্য থাকে; থাকে চাকরির নিশ্চয়তা আর এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের টাকা

সরেজমিন দুবাই ঘুরে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) অধিকাংশ শহরেই ভিজিট অথবা টুরিস্ট ভিসায় যান বাংলাদেশিরা। তিন মাসের ভিসায় গিয়ে অনেকেই কাজ খুঁজে নেন। কেউ আবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। দেশ থেকে ইউএই যাওয়ার সময় ট্রাভেল এজেন্সিকে এক লাখ ২০ হাজার থেকে দেড়লাখ টাকা দেন ইচ্ছুক ব্যক্তিরা। সেই টাকার মধ্যে ভিসা প্রোসেসিং, টিকিটের মূল্য থাকে; থাকে চাকরির নিশ্চয়তা আর এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের টাকা।

অফলোড সিল থাকার পরও দুবাই যেতে দেওয়া হয় সাঈদকে

কয়েক বছর ধরেই ট্রাভেল এজেন্সিগুলো ‘এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের’ নামে ইউএই যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিচ্ছে। এ বিষয়ে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর বক্তব্য, ‘ওই ৩০ হাজার টাকা ইমিগ্রেশন পুলিশকে দিচ্ছেন তারা।’

৩০ হাজার টাকা দেওয়ার পর বুঝলাম কন্ট্রাক্ট কী জিনিস

চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে দুবাই যাওয়া জালাল নামের অপর এক প্রবাসী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রথমে আমাকে এয়ারপোর্টে আটকে দেওয়া হয়। এয়ারপোর্টে যেসব কাগজপত্র লাগে সব ডকুমেন্টই ছিল আমার কাছে, তারপরও যেতে দেওয়া হয়নি। এরপর যার কাছ থেকে টিকিট নিয়েছি, তাকে ফোন দিয়ে বলি আমাকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তখন তারা বলে, ওখানে নাকি কন্ট্রাক্ট সিস্টেম আছে।’

ভাই, রিপোর্ট করে লাভ নাই। এটা নিয়মিত ব্যাপার। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের কোনো দাম নাই, আমাদের কোনো দাম নাই। প্রথমবার অফলোড খাওয়ার পর দ্বিতীয়বার আবার যাই। আগেরবার কন্ট্রাক্ট করি নাই। এবার কন্ট্রাক্ট করে দেড়লাখ টাকা দিয়ে দুবাই আসি। অনেক কষ্ট, অনেক তাচ্ছিল্যের পর এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট করে এখানে আসা। এ কন্ট্রাক্টের টাকা টপ-টু-বটম সবখানেই যায়

ভুক্তভোগী জিয়াউল হক

তিনি বলেন, ‘আমি জানতাম না কন্ট্রাক্ট কী? আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছি, সেটা আবার (কন্ট্রাক্ট) কী? উনি আমাকে বললেন, এয়ারপোর্টে ৩০ হাজার টাকা দিতে হবে এক্সট্রা (অতিরিক্ত)। ওটা যদি দাও তাহলে তুমি যেতে পারবে। তখন আমি তাকে ৩০ হাজার টাকা দেই। আমাকে যেতে দেওয়া হয়।’

জালালের পাসপোর্ট, তাকেও অফলোড সিল দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি এখন দুবাই কর্মরত

ইমিগ্রেশনে প্রথমবার অনেক প্রশ্ন, কন্ট্রাক্টের পর শুধু নাম জিজ্ঞাসা

বোরহান (ছদ্মনাম) নামে এক প্রবাসী ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রাম থেকে দুবাইয়ের ফ্লাইটে চড়ার আগে বিমানবন্দরে আমাকে আটকে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। নানা প্রশ্ন আর উত্তরের পর দুবাই যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে পাসপোর্টে ‘অফলোড’ লিখে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

বোরহান বলেন, ‘বিমানবন্দরে যেতেই ইমিগ্রেশন অফিসার প্রশ্ন করলেন, দুবাই কেন যাচ্ছি, সেখানে কী করব, আমার বাবা কী করেন, বড় ভাই কোথায় থাকেন, থাকব নাকি চলে আসব? আমি উত্তর দেওয়ার পর আমাকে ‘অফলোড’ সিল দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। এরপরই আমাকে ট্রাভেল এজেন্সি বলল, ইমিগ্রেশন পুলিশকে ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে কন্ট্রাক্ট করতে হবে। আমি ট্রাভেল এজেন্সিকে আরও ৪৫ হাজার টাকা দেই।’

ভিজিট ভিসায় যারা ইউএই আসছেন, তাদের মধ্যে কেউ ভিসার মেয়াদ শেষে আর দেশে ফেরেন না। অনেকে কাজ না পেয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। তাই বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনে কড়াকড়ি আরোপ করে এবং যাত্রীদের কাগজপত্র ভালোভাবে দেখে বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দেওয়া উচিত

‘২০২০ সালের ১ জানুয়ারি আমি চট্টগ্রামের একই বিমানবন্দর থেকে অফলোড সিল দেওয়া পাসপোর্ট নিয়ে আবার ইমিগ্রেশন পুলিশের সামনে হাজির হই। এবার পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি বোরহান? আমি উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ, আমি বোরহান।’ আর কিছু জিজ্ঞাসা করেনি পুলিশ। আমাকে যেতে দেওয়া হয়।’

হযরত শহজালাল বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টার

ইমিগ্রেশন পুলিশের নামে আনসার চাইল ৮৫ হাজার টাকা

চট্টগ্রামের শাহ আমানত দিয়ে দুবাই যাওয়া জাহাঙ্গীর (ছদ্মনাম) ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এখানে দুই বছর আগে এসেছি। সম্প্রতি আমার স্ত্রী ও মেয়ে চট্টগ্রাম থেকে দুবাই আসে। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশ প্রথমে তাদের আটকে দেয়। আমার ভাই আমাকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে ফোন করে জানায়, বিমানবন্দরের ভেতরে কর্মরত একজন আনসার তাদের পাঠানোর জন্য ৮৫ হাজার টাকা চেয়েছে। আমি আমার ভাইকে বলি, টাকা দিয়ে দিতে। আমার ভাই আনসারকে টাকা দেওয়ার কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয়বার ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ালে তাদের আসতে দেওয়া হয়।

কন্ট্রাক্টের টাকা টপ-টু-বটম সবাই খায়, তাই বন্ধ হয় না

‘অফলোড সিল’ পাওয়ার পরও দুবাই যাওয়া জিয়াউল হক নামের অপর এক প্রবাসী ভুক্তভোগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভাই, রিপোর্ট করে লাভ নাই। এটা নিয়মিত ব্যাপার। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের কোনো দাম নাই, আমাদের কোনো দাম নাই। প্রথমবার অফলোড খাওয়ার পর দ্বিতীয়বার আবার যাই। আগেরবার কন্ট্রাক্ট করি নাই। এবার কন্ট্রাক্ট করে দেড়লাখ টাকা দিয়ে দুবাই আসি। অনেক কষ্ট, অনেক তাচ্ছিল্যের পর এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট করে এখানে আসা। এ কন্ট্রাক্টের টাকা টপ-টু-বটম সবখানেই যায়।’

এ ধরনের ঘটনার সুযোগ ও সম্ভাবনা অত্যন্ত সীমিত। তারপরও, যদি কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে তা গুরুত্বসহকারে আমলে নিয়ে তদন্তে প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা সদস্যদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠিন ব্যবস্থা নেবে ইমিগ্রেশন পুলিশ

মো. সোহেল রানা, এআইজি, মিডিয়া অ্যান্ড পিআর

দুবাইয়ের ওয়েটার বারে কর্মরত এক বাংলাদেশি প্রবাসী নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুবাইয়ের ড্যান্স বার ও বডি ম্যাসাজের জন্য যেসব মেয়েদের পাঠানো হয় তারা সবাই ইমিগ্রেশন পার হয়ে আসেন। এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের কারণে তাদের আটকায় না পুলিশ। অবাধ বিচরণের অবৈধ এ সুযোগ দেওয়ায় বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

বিদেশে পাড়ি দিতে বিমানবন্দরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অপেক্ষা 

এ বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং দুবাইয়ে অবস্থিত কনসাল জেনারেলের দপ্তরের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তারা জানান, ভিজিট ভিসায় যারা ইউএই আসছেন, তাদের মধ্যে কেউ ভিসার মেয়াদ শেষে আর দেশে ফেরেন না। অনেকে কাজ না পেয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। তাই বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনে কড়াকড়ি আরোপ করে এবং যাত্রীদের কাগজপত্র ভালোভাবে দেখে বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দেওয়া উচিত।

ইমিগ্রেশনে আমাদের কন্ট্রাক্ট আছে : ট্রাভেল এজেন্সি

ফার্মগেটের ‘ট্রাভেলস অ্যান্ড হলিডে’ নামের একটি এজেন্সির কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। ওই কর্মকর্তা ইমিগ্রেশন পুলিশকে টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এক লাখ ৬০ হাজার টাকার কন্ট্রাক্ট। এর মধ্যে টুরিস্ট ভিসা, টিকিট ও এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট রয়েছে।’

এরপরও যদি বিমানবন্দর থেকে যাত্রীকে ফেরত দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে কী করা— জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘শতভাগ কনফার্ম, কোনো যাত্রী ফেরত আসবেন না। পুলিশের সঙ্গে আমাদের সেভাবেই কন্ট্রাক্ট।’

বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের সঙ্গে সরেজমিন অভিজ্ঞতা

গত ১১ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দুবাই যাওয়ার সময় ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের চোখেও ইমিগ্রেশনের নানা অসঙ্গতি ধরা পড়ে। সাধারণত একজন যাত্রী চেক-ইন কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাস নিয়ে ইমিগ্রেশনে যান। বর্তমানে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যাওয়ার আগে যাত্রীকে যেতে হয় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) সদস্যদের স্থাপিত অস্থায়ী কাউন্টারে। সেখানে পাসপোর্ট, করোনা টেস্ট রিপোর্টের প্রিন্টেড কপি ও এম্বারকেশন ফরম জমা দিতে হয়। এ ডেস্কে যাত্রীর কোভিড সার্টিফিকেট যাচাই করেন এসবি সদস্যরা। সবকিছু ঠিক থাকলে ফরমের ‘নেগেটিভ’ লেখার পাশে ‘ওকে’ লিখে দেন তারা। পরে সার্টিফিকেটের সঙ্গে এম্বারকেশন ফরম সংযুক্ত করা হয়।

দুবাই শহরের ডেরা এলাকা, এখানেই অধিকাংশ বাংলাদেশি প্রবাসীর দেখা মেলে | ছবি- ঢাকা পোস্ট

যারা মধ্যপ্রাচ্যে প্রথমবারের মতো যাচ্ছেন তাদের পাসপোর্টগুলো এখানে আটকে রাখা হয়। এরপর তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। প্রতিবেদক প্রথমবারের মতো ইউএই যাওয়ার কথা শুনেই তার পাসপোর্ট জমা নিলেন এসবি কর্মকর্তা। তবে পাসপোর্টে আগের ভিসাগুলো দেখে তা ফেরত দেওয়া হয়। তবে একই কাউন্টারে প্রথমবারের মতো দুবাই যাওয়া অর্ধশতাধিক যাত্রীর পাসপোর্ট আটকে রেখে পরবর্তীতে তাদের আলাদা করে অন্য একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে তিনজনের সঙ্গে ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের দেখা হয় ফ্লাইটের ভেতর।

তারা জানান, সংশ্লিষ্ট দালাল তাদের এয়ারপোর্টের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করিয়ে দিয়েছিলেন। এ কারণে খুব সহজেই তারা ইমিগ্রেশন শেষে বিমানে চড়েছেন। যারা কন্ট্রাক্ট করেননি তাদের পাসপোর্টে ‘অফলোড সিল’ মেরে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

ইমিগ্রেশন পুলিশের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণে সিআইডি

ঘটনাটি ২০১৯ সালের। বিয়ে করার কথা বলে সিলেটের এক তরুণীকে (২২) যুক্তরাজ্যে পাচারের চেষ্টা করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক জাইন দীন (৪৫)। ভুক্তভোগী তরুণীকে পাচারের জন্য ব্যবহার করা হয় রুবিনা নামের ব্রিটিশ পাসপোর্ট। ইমিগ্রেশন পুলিশের কয়েকজন অসাধু সদস্যের সহযোগিতায় ভুয়া পাসপোর্টে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পার করতে পারলেও লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে গিয়ে ধরা পড়েন ওই তরুণী। পাসপোর্ট আটক রেখে বিমানবন্দর থেকেই তাকে দেশে ফেরত পাঠায় লন্ডন পুলিশ।

সিআইডি’র তদন্তে উঠে আসে, ওই তরুণীর পাসপোর্ট বাংলাদেশে এন্ট্রি করানো এবং তার ছয়দিন পর ওই ভুয়া পাসপোর্টের আড়ালে ভুক্তভোগী তরুণীকে বিদেশে পাঠানোর পেছনে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের একাধিক কর্মকর্তার জড়িত থাকার তথ্য। কারণ, ইমিগ্রেশনের সহায়তা ছাড়া এ কাজ করা অসম্ভব। এখানে মোটা অঙ্কের টাকাও লেনদেন হয়েছে বলে ধারণা সিআইডি’র। তবে বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন।

দিনের আলোতে দুবাই শহর | ছবি- ঢাকা পোস্ট

ইমিগ্রেশন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে পুলিশ সদরদপ্তর যা বলছে

এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে পুলিশ সদরদপ্তরের কাছে জানতে চাওয়া হয়, পাসপোর্টে ‘অফলোড সিল’ দেওয়ার এক মাস পর দালালের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে সেই পাসপোর্টে আবার বিদেশ যাওয়া যায় কিনা?

পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি, মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. সোহেল রানা বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনার সুযোগ ও সম্ভাবনা অত্যন্ত সীমিত। তারপরও, যদি কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে তা গুরুত্বসহকারে আমলে নিয়ে তদন্তে প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা সদস্যদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠিন ব্যবস্থা নেবে ইমিগ্রেশন পুলিশ।’

এআর/এমএআর