অল্প মজুরিতে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে প্লাস্টিকের কারখানাগুলোতে কাজ করছে অন্তত ২০ হাজার শিশুশ্রমিক / সংগৃহীত

সুনামগঞ্জের ছনবাড়ী এলাকায় স্থানীয় একটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত ফয়সাল (১১)। সম্প্রতি স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেট শহরসহ ১৩টি উপজেলা ও পাঁচটি পৌরসভা প্লাবিত হয়। ভেসে যায় ফয়সালদের গরু-ছাগল, বাড়ি-ঘর। বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই মায়ের হাত ধরে ঢাকায় এসে ইসলামপুরে প্লাস্টিক কারখানায় কাজ নেয় সে।

গত ১২ আগস্ট সকালে রাজধানীর পুরান ঢাকার ইসলামবাগে গিয়ে দেখা যায়, প্লাস্টিকের কারখানায় কাজে ব্যস্ত ফয়সাল। স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর প্লাস্টিকের গুঁড়া উড়ছে বাতাসে, হাত-মুখসহ পুরো শরীর মেখে একাকার প্লাস্টিক দানায়। কারখানায় কাজ করা অবস্থায় কথা হয় শিশু ফয়সালের সঙ্গে। সে বলে, ‘মন চাইত বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হমু। কিন্তু এখন তিন বেলা খাইতে পারাটাই অনেক কিছু। বাধ্য হয়ে কারখানায় কাজ নিছি। মার হাত ধইরা ঢাকায় আইছি। স্কুলে আর পড়াশোনা হইব না ভাবতেই মনটা খারাপ হয়। বন্যায় বই-খাতা, ব্যাগসহ সবকিছুই ভাইসা গেছে।’

মন চাইত বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হমু। কিন্তু এখন তিন বেলা খাইতে পারাটাই অনেক কিছু। বাধ্য হয়ে কারখানায় কাজ নিছি। মার হাত ধইরা আইছি। স্কুলে আর পড়াশুনা হইব না ভাবতেই মনটা খারাপ হয়

ফয়সাল জানায়, কারখানায় হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়। আগে অভ্যাস না থাকায় তার কষ্ট হয়। সপ্তাহ শেষে ২৪০০ টাকা হাতে দেয় মহাজন। কারখানার ওপরে খুপরি ঘরে থাকতে হয় তাদের।

স্কুল ব্যাগ আর দুরন্ত শৈশব হারিয়ে শিশুশ্রমের পথ বেছে নিতে হচ্ছে ফয়সালের মতো হাজারো শিশুকে। অভাবে পড়ে পরিবারের দায়িত্ব নিতে, কখনও কখনও পরিবারের চাপে বহু শিশুর গন্তব্য এখন ঝুঁকিপূর্ণ প্লাস্টিক কারখানায়।

শুধু ইসলামবাগেই রয়েছে অন্তত পাঁচ হাজার ছোট-বড় প্লাস্টিকের কারখানা। সেখানে ঝুঁকিতে কাজ করছে শিশুরা / ঢাকা পোস্ট

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু ইসলামবাগেই রয়েছে অন্তত পাঁচ হাজার ছোট-বড় কারখানা। লালবাগ, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, আমলিগোলা, মোহাম্মদপুর ও কেরানীগঞ্জের একাংশ মিলিয়ে ৩০ হাজারের বেশি কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিকের পাশাপাশি অল্প মজুরিতে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে অন্তত ২০ হাজার শিশুশ্রমিক।

শুধু ইসলামবাগেই রয়েছে অন্তত পাঁচ হাজার ছোট-বড় কারখানা। লালবাগ, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, আমলিগোলা, মোহাম্মদপুর ও কেরানীগঞ্জের একাংশ মিলিয়ে ৩০ হাজারের বেশি কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিকের পাশাপাশি অল্প মজুরিতে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে অন্তত ২০ হাজার শিশুশ্রমিক

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এবং ২০১৩-এর সংশোধন অনুযায়ী, কর্মরত শিশু বলতে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের বোঝায়, যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। এ শ্রম অনুমোদনযোগ্য।

আরও পড়ুন >> ‘অটো পাস’ ‘কোভিড ব্যাচ’ বলে শিশুর ক্ষতি করছেন না তো?

তবে, ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী কোনো শিশু যদি কোনো ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, সেটা শিশুশ্রম হবে। আর ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, তবে তা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ, শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয় এমন ৩৮টি শ্রম খাত নির্ধারণ করে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শিশুদের সেখানে নিয়োগ নিষিদ্ধ করে সরকার। এর মধ্যে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে অ্যালুমিনিয়াম, তামাক/বিড়ি, সাবান, প্লাস্টিক, কাচ, স্টোন ক্রাশিং, স্পিনিং সিল্ক, ট্যানারি, শিপ ব্রেকিং ও তাঁত শিল্প। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আরও ছয়টি খাত এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অথচ ঝুঁকিপূর্ণ এসব খাতের মধ্যে প্লাস্টিক ও পরিবহন খাতে বিশেষ করে লেগুনায় শ্রমিক হিসেবে বেশি কাজ করছে শিশুরা।

ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতি সামলে উঠতে না উঠতেই দেশ ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। এতে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। অনেকের স্থান হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম খাতে / ঢাকা পোস্ট

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) কর্তৃক যৌথভাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কোভিড- ১৯ মহামারি বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ শিশুকে শিশুশ্রমের ঝুঁকিতে ফেলেছে। উপযুক্ত নিরসন কৌশল ছাড়া, উচ্চ দারিদ্র্য এবং ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা ও ভঙ্গুরতার কারণে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ নতুন করে ৮.৯ মিলিয়ন (৮৯ লাখ) শিশু শিশুশ্রমে নিয়োজিত হতে পারে।

ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশও। ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতি সামলে উঠতে না উঠতেই দেশ ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। এতে অনেক পরিবার যেমন নিঃস্ব হয়েছে, তেমনি অনেক শিশুর স্থান হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম খাতে

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-এর শুরুতে বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছর বা তার বেশি বয়সী ১০ শিশুর মধ্যে একজন শিশুশ্রমে জড়িত ছিল, যার আনুমানিক সংখ্যা ১৬০ মিলিয়ন (১৬ কোটি)। এর মধ্যে ৬৩ মিলিয়ন (৬ কোটি ৩০ লাখ) কন্যাশিশু এবং ৯৭ মিলিয়ন (৯ কোটি ৭০ লাখ) ছেলেশিশু। গত দুই দশকে শিশুশ্রম কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও সম্প্রতি শিশুশ্রম নিরসনের বৈশ্বিক অগ্রগতি ২০১৬ সাল থেকে থমকে গেছে।

আরও পড়ুন >> আগুন আতঙ্কে ট্রমায় ভুগছে রোহিঙ্গা শিশুরা

ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশও। ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতি সামলে উঠতে না উঠতেই দেশ ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। এতে অনেক পরিবার যেমন নিঃস্ব হয়েছে, তেমনি অনেক শিশুর স্থান হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম খাতে।

রাজধানীর ইসলামবাগে কথা হয় প্লাস্টিক কারখানার শ্রমিক নূর হোসেনের (৩৩) সঙ্গে। তিনি বলেন, বয়স যখন ১৩ বছর তখন থেকেই ইসলামবাগের কারখানায় আমার হাতেখড়ি। চারটি কারখানা ঘুরে এখন সাব্বির প্লাস্টিক কারখানায় কাজ করছি। ৬২ জন এখানে কাজ করে। ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী সাত/আটজন শ্রমিক এখানে আছে। শুধু আমাদের কারখানা নয়; পুরো ইসলামবাগ, লালবাগ ও কামরাঙ্গীরচরজুড়ে হাজার হাজার কারখানায় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে শিশুরা।

শুধু প্লাস্টিক কারখানা ও ইট ভাঙাই নয়, রাজধানীতে অবৈধভাবে চলা লেগুনায় হেলপার হিসেবে বেশি দেখা যায় শিশুদের / ঢাকা পোস্ট

৩০ বছর ধরে ইসলামবাগে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্য রিসাইকেল (পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা) করে নতুন প্লাস্টিক পণ্য তৈরির কারখানায় কাজ করছেন শরিয়তপুরের সিরাজুল ইসলাম (৫০)। তিনি বলেন, এখানে হরেক রকমের পণ্য তৈরি হয়। বাতাসে নিশ্বাস নেওয়া যায় না। প্লাস্টিকের গুঁড়ায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়। এর মধ্যেই জীবিকার তাগিদে কাজ করে যাচ্ছে কয়েক হাজার শিশু।

‘হ্যান্ড গ্লাবস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল চশমা, আর মাস্ক ছাড়া এখানে কাজ করা কঠিন। অধিকাংশ কারখানায় এসব ছাড়াই শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে কাজ করছে শিশুরা। কারখানার মালিকরা অল্প খরচায় শ্রমিক পাওয়ায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশুদের কাজের সুযোগ দিচ্ছে।’

আরও পড়ুন >> জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে শিশুরা, আক্রান্ত হচ্ছে মাতৃগর্ভেও

দুই বছর ধরে প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ করছে বরিশালের শিশু রিফাত। বাবার মৃত্যুর পর অভাবের সংসারে পড়াশোনার ইতি ঘটে তৃতীয় শ্রেণিতে থাকতেই। বড় দুই ভাই বিয়ে করে নিজেদের মতো সংসার পেতেছে। মায়ের দেখভালের জন্য বরিশাল থেকে ঢাকায় আসা রিফাতের।

দিনে মাত্র ২৫০ টাকার বিনিময়ে লেগুনার স্টিয়ারিং হাতে শিশু হযরত আলী / ঢাকা পোস্ট

ঢাকা পোস্টকে সে বলে, ‘নিজে যখন খেতে পারছিলাম না, তখন চারদিক অন্ধকার দেখেছি। প্রথমে এলাকায় দিনমজুরের কাজ করেছি,  পরে বাসের গ্যারেজে। দুই বছর আগে মায়ের সঙ্গে ঢাকায় আসা। মা মেসে রান্না করে, আমি কারখানায়। স্কুলে পড়াশোনা করতে না পারায় খারাপ লাগে।’

পাশের আরেকটি কারখানায় দেড় বছর ধরে কাজ করছে সিলেটের আম্বরখানা ও বন্দরবাজার এলাকার আলী হোসেন ও সুমন। দুজনের বয়স ১৩ বছরের কম। সুমন জানায়, খুব খারাপ লাগে, অনেক কষ্টের পরিশ্রম। বাতাসে কেমিক্যাল থাকে, মেশিন যখন চলে তো চলতেই থাকে। শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিস্তার মেলে না। প্লাস্টিকের কণা মেশানো বাতাস নিতে নিতে এখন শ্বাসকষ্টে ভুগছি। অনেক চেষ্টা করেছি, এখানে কাজের ফাঁকে স্কুলে ভর্তি হতে। অন্তত এসএসসি পাসটা করি। কিন্তু সুযোগ মেলেনি।

কুড়িগ্রামের চিলমারি এলাকার আলী হোসেন (১৫)। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করায় সংসারের ঘানি টানতে ক্লাস সেভেনেই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে তিন বছর আগে ঢাকায় আসতে হয় তাকে। চাচার সঙ্গে সদরঘাট এলাকায় ইট ভাঙার কাজ শুরু করে।

আলী হোসেন বলে, ‘ভাই মোর কপালত আর পড়াশুনে নাই। মুই অনেক দূর পড়বার চাসনু। কিন্তু হলো না। খাতিই তো পাম না। পড়মো কি কন? কেউ মোক ট্যাকা-পসে, খাওন দিলেই পড়নু হয়।’

আরও পড়ুন >> শিশুর বয়স কমানোর সিদ্ধান্ত হবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন

শুধু প্লাস্টিক কারখানা ও ইট ভাঙাই নয়, রাজধানীতে অবৈধভাবে চলা লেগুনায় হেলপার হিসেবে বেশি দেখা যায় শিশুদের। সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর ফার্মগেট আগারগাঁও ৬০ ফিট মোড়, ৬০ ফিটের শেষ অংশে মিরপুর- ২ ইউটার্ন অংশের ব্যস্ত সড়কের পুরোটাই লেগুনার দখলে। ফার্মগেট থেকে মিরপুর- ২ পর্যন্ত চলাচল করে এসব লেগুনা।

অল্প বয়সে পকেটে টাকা ঢোকে। এ কারণে শিশুরা লেগুনার টিপ মারায় বেশি মনোযোগী / ঢাকা পোস্ট

রাজধানীর ৬০ ফিট মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, একটি লেগুনার পেছনের পাদানিতে ঝুলছে আনুমানিক ১০ বছরের এক শিশু। স্টপেজে থামতেই কথা হয় তার সঙ্গে। নাম রবিন। নয় মাস ধরে লেগুনায় হেলপার হিসেবে কাজ করছে সে। বাড়ি শেরপুর হলেও মায়ের সঙ্গে ঢাকায় বেড়ে ওঠা। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ার সুযোগ হয়েছে তার।

আরও পড়ুন >> দুই সন্তানেই ‘ফুলস্টপ’ দিচ্ছেন ৭৯ শতাংশ মা

ঢাকা পোস্টকে রবিন বলে, ‘মা কইছে পড়ালেহা কইরা আর কি করবি? লাভ নাই, এর চেয়ে কাম কর, রোজগার কর। বাধ্য হয়া লেগুনার পেছনে ঘুরতাছি। দিনের শুরু সেই সকাল ৬টায়, রাত ১১টা পর্যন্ত লেগুনায় কেটে যায়। পড়ার আর সময় কই!’

২৫০ টাকায় লেগুনার স্টিয়ারিং হাতে শিশু হযরত আলী

মাত্র ১২ বছর বয়স, থাকার কথা স্কুলে, খেলার মাঠে। অথচ জীবিকার টানে দিনে মাত্র ২৫০ টাকার বিনিময়ে লেগুনায় কাজ করছে হযরত আলী। এক বছর আগে লেগুনায় হেলপার হিসেবে যোগ দেয়। তিন মাস আগে লেগুনার স্টিয়ারিং হাতে আসে তার। ড্রাইভার না থাকলে নিজেই লেগুনা নিয়ে যাত্রী পরিবহনে নেমে পড়ে সে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মুখে তার দৃঢ়তার ছাপ। হযরত আলী ঢাকা পোস্টকে জানায়, চার ভাই আর এক বোন। ঢাকাতেই জন্ম। এক ক্লাসও পড়া হয়নি। মা মোর্শেদা বেগম বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। পরিবারের ঘানি টানতে তাকে লেগুনা নিয়ে রাস্তায় নামতে হয়।

লেগুনায় চার বছর ধরে কাজ করছে হবিগঞ্জের সৌরভ, বয়স ১৭। সে জানায়, লেগুনার লাইনে ফার্মগেট, তেজগাঁও, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকার অন্তত তিন হাজার ছেলেপুলে কাজ করে। যাদের অনেকের বয়স আমার মতো ১৭ বছরের নিচে। ‘লাইনডা খুব খারাপ ভাই। অল্প বয়সে টাকা চেনা খারাপ। এই বয়সে নিজেই উপার্জন করতেছি। এখন মনে হয় ১৫, ২০ বছর ধইরা পইড়া কী করব? এর চেয়ে এখনই কামে লাইগা যাই। অল্প বয়সে পকেটে টাকা ঢুকলে পড়াশোনায় আর মন বসে না। এই শিশুরা এখন লেগুনার টিপ মারায় বেশি মনোযোগী। একেকটা যাত্রী ওঠানো মানে ওরা বোঝে টাকা। যাত্রী ওঠালেই তো টাকা!’

সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসেবে যদি অর্থনৈতিক, চাকরি ও কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা না যায় তাহলে শিশুশ্রম আরও বাড়বে— বলছেন গবেষকরা / সংগৃহীত

মাত্র দুদিন আগে মোটর মেকানিকের কাজ নিয়েছে কিশোরগঞ্জের ইয়াসিন (১০)। ইয়াসিন ঢাকা পোস্টকে বলে, ‘বাপের বয়স হইছে। আগের মতো কামে যাইতে পারে না। মা বাসায় কাজ করে। দুইডা বোন, ওদেরও বিয়ে হয়ে গেছে। শেওড়াপাড়ার তাকওয়া ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে এইটে পড়তেছি। খরচাপাতি কেউ দেয় না। দুদিন ধরে কামে আসছি। মজুরির ঠিক নাই।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ শিশুশ্রম বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। হিসাব অনুযায়ী, ২০০৩ সালে ৩২ লাখ শিশু শিশুশ্রমে জড়িত ছিল, যা ২০১৩ সালে কমে আসে ১৭ লাখে। এর মধ্যে ১২ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িয়ে পড়ে।

জাতিসংঘ ২০২১ সালকে ‘আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম নিরসন বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। আইএলও ১৯৯২ সালে প্রথম শিশুশ্রমের জন্য প্রতিরোধ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী ২০০২ সালের ১২ জুন থেকে আইএলও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতি বছর ‘শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে দিনটি পালন করে আসছে।

‘শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবসে বাংলাদেশের আইএলও কান্ট্রি অফিসের পরিচালক তুওমো পুটিয়াইনেন এক বিবৃতি বলেন, বাংলাদেশকে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াইকে এজেন্ডার শীর্ষে রাখতে হবে। কেবল শিশু শ্রমিক ও ঝুঁকির মুখে থাকা শিশুদের জন্যই নয়, পিতা-মাতা এবং জ্যেষ্ঠ ভাই-বোনদের জন্য উপযুক্ত কাজের সুযোগ প্রদান করার লক্ষ্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষা, দক্ষতা বিকাশ এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে গুরুত্ব দিতে হবে।

আরও পড়ুন >> ওদের শৈশব কাটে ভয়-আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তায়

তিনি আরও জানান, শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুরা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকে। এটি শিশুদের পড়াশোনা ব্যাহত করে, তাদের অধিকার ও ভবিষ্যতের সুযোগগুলো সীমিত করে দেয় এবং তাদের দারিদ্র্য ও শিশুশ্রমের দুষ্টচক্রে পড়ার দিকে ধাবিত করে।

সরকার আইন করে, পরিকল্পনাও নেয় কিন্তু বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়ে। এভাবে চলতে থাকলে শিশুশ্রম অবসায়নের যে লক্ষ্য তা বাস্তবায়ন হবে না— বলছেন বিশ্লেষকরা / সংগৃহীত

প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বাজেটে নেই প্রতিফলন

বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠীর সাত কোটিই শিশু। করোনা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার শিশুরা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের ২২তম বাজেট। কিন্তু পরপর গত তিন বছর শিশু বাজেট ঘোষণা করেনি সরকার। শিশুদের করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য কী করণীয় তা-ও পরিষ্কার করা হয়নি। যদিও প্রতিশ্রুতি ছিল, ২০২০ সালের মধ্যে শিশুদের জন্য বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করা। কিন্তু গত দুই বছরের ন্যায় এবারও শিশুকেন্দ্রিক কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য তুলে ধরা হয়নি বাজেটে।

মহামারির মধ্যে (২০২০ সালের মার্চ) স্কুল বন্ধ থাকা এবং দরিদ্রতা বৃদ্ধি অনেক শিশুকে শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইউনিসেফ বলছে, এই পরিস্থিতিতে পরিবারগুলোকে বেঁচে থাকার লড়াই করতে হচ্ছে। এজন্য তারা সব পন্থাই অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের এখন শিশুদের প্রয়োজনগুলোর ওপর বেশি বেশি নজর দিতে হবে। ক্ষতিকারক শিশুশ্রমের মূলে যে সব সামাজিক সমস্যা রয়েছে তা নিরসনে জোর দিতে হবে।

ইউনিসেফ জানায়, ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুকে কাজে নিয়োগ দেওয়া এবং ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেওয়া আইনত দণ্ডনীয়। শিশুদের কাজ না পাঠিয়ে স্কুলে পাঠান, যেন তারা বড় হয়ে নিজের এবং পরিবারের সমৃদ্ধি ও আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিডের প্রভাবে শিশুশ্রমিক আরও বেড়েছে। সম্প্রতি সিলেটসহ বেশ কয়েকটি জেলায় ভয়াবহ বন্যার কারণে আরও কয়েক হাজার শিশুর ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে ঢোকার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। শিশুশ্রম রোধে আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। এটা এখনই রোধ করা না গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হুমকির মুখে পড়বে।

হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি)-এর গবেষক ও উন্নয়নকর্মী ড. মতিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এভাবে চলতে থাকলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করা কঠিন হবে। শিশুশ্রমের মাত্রা কমছে না বরং কোভিড- ১৯ ও চলমান বৈশ্বিক যুদ্ধাবস্থায় জীবনযাত্রার ব্যয় অসমভাবে বেড়েছে। এর মধ্যে দেশে বন্যার প্রভাবে লাখও মানুষ নিঃস্ব হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসেবে যদি অর্থনৈতিক, চাকরি ও কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা না যায় তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শিশুরা আরও বেশি ঝুঁকে পড়বে শিশুশ্রমে। শিশুশ্রম আরও বাড়বে।

প্লাস্টিকের কণা দিনের পর দিন চামড়ায় পড়লে চর্মরোগসহ স্কিন ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি হয়— বলছেন চিকিৎসকরা / ঢাকা পোস্ট

শিশুশ্রম অবসায়নে সরকারের নিজের করা নীতি বাস্তবায়নে সদিচ্ছার অভাব আছে— উল্লেখ করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহিন আনাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বিষয়ে খুবই ভালো পলিসি আছে সরকারের। কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের মনিটরিং ও কার্যক্রম থাকা দরকার সেটা নেই। উল্টো এখন শিশুশ্রমের অবস্থা দিনদিন ঊর্ধ্বমুখী। সরকার আইন করে, পরিকল্পনাও নেয় কিন্তু বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়ে। করণীয় সম্পর্কে আমরা বারবার বলছি কিন্তু কাজে আসছে না। ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুশ্রম অবসায়নের যে লক্ষ্য, এভাবে চললে তার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক সফি উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্লাস্টিক কারখানায় শিশুদের কাজ সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে প্লাস্টিকের ধুলা তৈরি হয়। এগুলো যদি শ্বাসনালিতে যায়, তাহলে শ্বাসকষ্ট হবে। শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্রংকাইটিস হতে পারে, ফুসফুসে গেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি হয়। প্লাস্টিকের কণা দিনের পর দিন চামড়ায় পড়লে চর্মরোগসহ স্কিন ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি হয়।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নারী ও শিশুশ্রম শাখার সহকারী সচিব বেগম মোরশেদা হাই ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে সব ধরনের শিশুশ্রম থেকে মুক্ত করতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুকে নিয়োগ করা যাবে না মর্মে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, যে সব শিল্পে এখনও শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত করা হচ্ছে, সে সব শিল্পমালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়িত ‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রম নিরসন’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে (২০০১-২০০৪ সাল) ১০ হাজার জন, দ্বিতীয় পর্যায়ে (২০০৫-২০০৯ সাল) ৩০ হাজার, তৃতীয় পর্যায়ে (২০১০-২০১৭ সাল) ৫০ হাজার শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

২০১৮ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহার এবং তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে— বলছে সরকার / ঢাকা পোস্ট

বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন (চতুর্থ পর্যায়) প্রকল্পের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. মনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ে ২০১৮ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহার এবং তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন কারখানা থেকে পাঁচ হাজার ৮৮ শিশুকে শিশুশ্রম হতে প্রত্যাহার করা হয়েছে। শিশুশ্রম নিরসনে ৪৮৬টি মামলা দায়ের হয়েছে, নিষ্পত্তি হয়েছে ১১৪টি। জনসচেতনতায় শিশুশ্রমের ওপর নির্মিত টিভি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে।

২০১৮ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহার এবং তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন কারখানা থেকে পাঁচ হাজার ৮৮ শিশুকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। শিশুশ্রম নিরসনে ৪৮৬টি মামলা দায়ের হয়েছে, নিষ্পত্তি হয়েছে ১১৪টি

জেলাপর্যায়ে শিশুশ্রম পরিস্থিতির তথ্য সংগ্রহ, শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে ‘জেলা শিশুশ্রম পরিবীক্ষণ কমিটি’ ও ‘উপজেলা পরিবীক্ষণ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে ছয়টি সেক্টর (ট্যানারি, রপ্তানিমুখী চামড়াজাত দ্রব্য ও পাদুকা শিল্প, জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ, সিল্ক, সিরামিক ও কাঁচ)-কে শিশুশ্রমমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। আরও দুটি সেক্টর (ফার্মাসিউটিক্যালস ও হিমাগার)-কে শিশুশ্রমমুক্ত ঘোষণা করার লক্ষ্যে কার্যক্রম চলছে।

শিশুশ্রম বন্ধে আইএলও ও ইউনিসেফের পাঁচ সুপারিশ

১. সর্বজনীন শিশুসুবিধাসহ সবার জন্য পর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা।

২. মানসম্মত শিক্ষার পেছনে ব্যয় বাড়ানো এবং কোভিড- ১৯ এর আগে থেকেই স্কুলের বাইরে থাকা শিশুসহ সব শিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে আনা।

৩. প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য যথোপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা, যাতে পারিবারিক উপার্জনে শিশুদের অবলম্বন করতে না হয়।

৪. শিশুশ্রমকে প্রভাবিত করে এমন ক্ষতিকারক লৈঙ্গিক রীতিনীতি ও বৈষম্যের অবসান ঘটানো।

৫. শিশুসুরক্ষা ব্যবস্থা, কৃষিজ উন্নয়ন, পল্লী জনসেবা, অবকাঠামো এবং জীবন-জীবিকার পেছনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি।

জেইউ/এমএআর/