এক দশক ধরে খুলছে না তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির জট / ঢাকা পোস্ট

প্রায় এক দশক ধরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি আটকে আছে একই বৃত্তে। তিস্তার এ জট খোলার বিষয়ে বারবার আশ্বস্ত করেছে ভারত। কিন্তু সেই আশ্বাস পর্যন্তই, যে বৃত্তে আটকে আছে বহুল প্রত্যাশিত চুক্তি সেটি কোনোভাবেই ভাঙছে না। এ অবস্থায় আগামী সপ্তাহে ভারত সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরেও তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

কয়েকদিন আগে ভারতে অনুষ্ঠিত হয়েছে দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠক। সেখানে তিস্তার জট খোলা নিয়ে আশ্বাস দিয়েছে ভারত। নয়াদিল্লি ঢাকাকে বার্তা দিয়েছে, তিস্তার সুরাহার বিষয়ে তাদেরও উদ্বেগ রয়েছে। তবে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাগে না আনা পর্যন্ত তিস্তার বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আশার কথা হচ্ছে, নয়াদিল্লির তরফ থেকে তিস্তা নিয়ে মমতার সঙ্গে আলোচনায় বসার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

আশার কথা হচ্ছে, নয়াদিল্লির তরফ থেকে তিস্তা নিয়ে মমতার সঙ্গে আলোচনায় বসার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

যৌথ নদী কমিশনের সচিব ও মন্ত্রী পর্যায়ের দুটি বৈঠকে ঢাকার পক্ষে অংশ নেন সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. মালিক ফিদা আব্দুল্লাহ খান। সম্প্রতি তার সঙ্গে আলাপ হয় ঢাকা পোস্টের। তিস্তা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি জানান, দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা একটা ইস্যু হচ্ছে তিস্তা। তিস্তার কথা মন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ে জোরালোভাবে তোলা হয়েছে। আমরা বলেছি, এটার ফ্রেমওয়ার্ক, এগ্রিমেন্ট, ইন্টেরিয়র ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট ফর ওয়াটার শেয়ারিং-এর ড্রাফট তৈরি আছে; টেকনিক্যাল পর্যায়ে আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত।

নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নয়াদিল্লি সফরের কথা রয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার / ফাইল ছবি

আরও পড়ুন >> শেখ হাসিনার ভারত সফরে গুরুত্ব পাবে পানি বণ্টন

এ বিষয়ে তারা (ভারত) বলেছে, এখানে তাদেরও একটা কনসার্ন (উদ্বেগ) আছে। যেহেতু জোরালো একটা আপত্তি আছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর, এজন্য তারা (ভারত) এখন পর্যন্ত নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। তবে তারা এটাও বলেছে, ‘আমরা কনসার্ন’।

মালিক ফিদা আব্দুল্লাহ খান বলেন, পানির কূটনীতিতে আমাদের যে পয়েন্টগুলো, সেগুলো আমরা তুলে ধরেছি। তিস্তানির্ভর অঞ্চলে যেসব লোক আছেন তাদের যে আর্থসামাজিক বা জীবনযাত্রা, এগুলোর সবকিছু জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তারা শুধু একটুকু বলেছে, আমরা কনসার্ন। তিস্তা নিয়ে মন্ত্রী পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবে তারা।

‘আমরা যতই বলি না কেন, দুই দেশের মধ্যে একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। যদি তারা ঐকমত্যে না আসে, আপনি তো কিছুই করতে পারবেন না। জোর করে হয় না। উদাহরণ হিসেবে গঙ্গা চুক্তির কথা বলা যেতে পারে। গঙ্গা চুক্তি যখন হয়েছিল তখন জ্যোতি বসু ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। যদিও বসুর নিজস্ব আগ্রহ ছিল, যে কারণে আমরা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থন পাই। চুক্তিটাও স্বাক্ষর হয়। এখন তিস্তার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থন পাচ্ছি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পাচ্ছি না।’

জেআরসি বৈঠক শেষে গত বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তিস্তা প্রসঙ্গে বলা হয়, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি দ্রুত সই করতে ভারতের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ। জবাবে দিল্লির তরফে বরাবরের মতো সর্বাত্মক চেষ্টার আশ্বাস পেয়েছে ঢাকা।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে বাস্তবায়িত হচ্ছে না তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি / ছবি- সংগৃহীত  

জেআরসি’র মন্ত্রী পর্যায়ে ঢাকার পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়া পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক গত শুক্রবার (২৬ আগস্ট) ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরে তিস্তা নিয়ে আলোচনার বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান, তিস্তা ইস্যু নিষ্পত্তির জন্য ভারতকে চাপ দিয়েছি। তারা সুরাহার আশ্বাস দিয়েছে।

আরও পড়ুন >> তিস্তা নয়, কুশিয়ারার পানি দিতে পারে ভারত

এদিকে, আগামী মাসের (সেপ্টেম্বর) প্রথম সপ্তাহে নয়াদিল্লি সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সফরেও তিস্তার জট খোলা নিয়ে কোনো সুসংবাদ থাকছে না বলে ইঙ্গিত দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে  ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিস্তা সবসময় আমাদের অগ্রাধিকারে থাকে। আমরা সবসময় ভারত সরকারকে এটা নিয়ে চাপ দেই। প্রধানমন্ত্রীর সফরেও তিস্তার প্রসঙ্গটি উঠবে। তবে, এটা নিয়ে কোনো সুসংবাদ থাকছে না বলে মনে হয়।

প্রধানমন্ত্রীর সফরে তিস্তার জট খোলা নিয়ে কোনো সুসংবাদ না থাকলেও ভারত থেকে সিলেটে প্রবাহিত কুশিয়ারা নদীর পানি উত্তোলন ও বণ্টন বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের বার্তা রয়েছে— বলেন ওই কর্মকর্তা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তিস্তা চুক্তি আদৌ হবে কি না— সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ, তিস্তা নিয়ে নয়াদিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গ এক ধরনের রাজনীতি করছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ আন্তরিক নয়। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বিকল্প উপায় খোঁজা উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

সম্প্রতি যৌথ নদী কমিশনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিনিধিরা / ছবি- সংগৃহীত
প্রধানমন্ত্রীর সফরে তিস্তার জট খোলা নিয়ে কোনো সুসংবাদ না থাকলেও ভারত থেকে সিলেটে প্রবাহিত কুশিয়ারা নদীর পানি উত্তোলন ও বণ্টন বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের বার্তা রয়েছে

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিস্তা চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর বড় একটা কারণ হলো, ৩০টার মতো হাইড্রোইলেকট্রিক ড্যাম তৈরি করা হয়েছে সিকিমে। সেখানে এমনিতেই শীতের মৌসুমে পানি থাকে না। তারা তো ৩০টা ড্যাম ভেঙ্গে ফেলবে না।

‘তিস্তা নিয়ে দিল্লি আর কলকাতা রাজনীতি করছে। কলকাতা বলছে দিল্লি, দিল্লি বলছে কলকাতা— এটা পুরো রাজনীতির খেলা। তাদের কেউ-ই সমস্যার সমাধান করবে না।’

কূটনীতির এ বিশ্লেষক বলেন, এটা নিয়ে আমাদের স্পষ্টভাবে বলা বা নেগোসিয়েশন করা উচিত। বাংলাদেশ যদি ওই ধরনের ড্যাম নির্মাণ করে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করে, তাহলে যে খরচ হবে সেখানে ভারত জড়িত হতে চাচ্ছে কি না? আমাদের প্রকৌশলীরাও ভালো করে জানেন যে ৩০টার মতো ড্যাম তৈরি হচ্ছে সিকিমে। এ আলোচনায় সিকিমকে রাখতে হবে। সিকিম যদি আলোচনায় না আসে তাহলে কেমন করে সমাধান হবে? আমার মনে হয় বিষয়টি নিয় খোলামেলা আলোচনা করা উচিত।

আরও পড়ুন >> তিস্তা চুক্তি ১১ বছর ধরে আটকে আছে, এটা লজ্জার : মোমেন

‘তাছাড়া আমরা যেটা করতে পারি, বৃষ্টির মৌসুমে বেশি পরিমাণ পানি ধরে রাখা। কেননা, বলা হয় ২০ মিলিয়নের মতো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা শীতের মৌসুমে পানিটা পাবে এবং খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে পারবে। আমার মনে হয় নতুন করে চিন্তা করতে হবে। কারণ, বছরের পর বছর আশ্বাসে থেকে আমরা লাভবান হচ্ছি না।’

ড. মালিক ফিদা আব্দুল্লাহ খান ও অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ / ঢাকা পোস্ট

তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পন্ন  হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে চুক্তিটি স্বাক্ষরের বিষয়ে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করা হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে আটকে যায় এটি। সেই মমতা এখনও বাধা হয়ে আছেন। তাকে বাগে আনতে পারেনি বর্তমান মোদি সরকার।

দ্বিতীয়বার তিস্তার জট খোলার সম্ভাবনা দেখা দেয় ২০১৭ সালের এপ্রিলে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে রাষ্ট্রীয় সফর ঘিরে। ওই বছরের ৭ থেকে ১০ এপ্রিল ৩৫টি বিষয়ে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয় দুই দেশের মধ্যে। তবে, সেখানে ছিল না তিস্তার প্রসঙ্গ।

২০১৮ সালের মার্চে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ভারত সফরেও তিস্তা চুক্তির বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সেসময় আবদুল হামিদকে নরেন্দ্র মোদি জানান, এ বিষয়ে মমতাকে রাজি করানোর চেষ্টা চলছে। একই বছরের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পশ্চিমবঙ্গ সফর ঘিরেও তিস্তার প্রসঙ্গ সামনে আসে। যদিও ওই সফরের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তারপরও মোদির সঙ্গে তার এক ঘণ্টার একান্ত বৈঠক এবং পরে মমতার সঙ্গে আধা ঘণ্টার আলাপনে তিস্তা নিয়ে নাটকীয় কোনো ঘোষণা আসেনি।

তিস্তার ভারতীয় অংশে ৩০টার মতো হাইড্রোইলেকট্রিক ড্যাম তৈরি করা হয়েছে / ছবি- সংগৃহীত 

এরপরও দিল্লির প্রধান থেকে শুরু করে দেশটির বিভিন্ন নেতার সঙ্গে বৈঠক-সাক্ষাৎ, টেলিফোন কিংবা রাষ্ট্রীয় সফরে তোলা হচ্ছে তিস্তা ইস্যু। শুধু তা-ই নয়, দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত দূতকে পেলেও তোলা হচ্ছে তিস্তার বিষয়টি। কিন্তু তিস্তা নিয়ে কোনো সুখবর আসছে না নয়াদিল্লি থেকে।

আরও পড়ুন >> তিস্তার পাড়ে চীনের সুকিয়ান সিটি দেখতে চায় উত্তরের মানুষ

ভারতীয় গণমাধ্যম জানায়, আগামী ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের সময় দুই দেশের মধ্যে যৌথ পানিবণ্টন এবং পানি ব্যবস্থাপনার বৃহত্তর ইস্যুতে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত ও বাংলাদেশ।

টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে যা সীমান্তের উভয় পাশের মানুষের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ।  আসন্ন এই সফরে (ত্রিপুরা থেকে প্রবাহিত) মুহুরি ও ফেনী (ত্রিপুরায়)-কুশিয়ারার (বাংলাদেশ) মতো বড় নদীগুলোর বিষয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে কাজ করছে দেশ দুটি। এছাড়া ২০২৬ সালে গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়নের বিষয়েও কাজ করছে প্রতিবেশী দেশ দুটি।

শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই চর পড়ে মরুভূমিতে পরিণত হয় বাংলাদেশ অংশের তিস্তা নদী / ছবি- সংগৃহীত  

দুই দেশের মধ্যে একটি পানি চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে উভয় সরকারই অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, অববাহিকা ব্যবস্থাপনা, পলিমাটি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী ও তার পানির গতিপ্রবাহ ঠিক রাখা, নদীর তীর রক্ষণাবেক্ষণ এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো এই অঞ্চলের সাধারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় যৌথ ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিচ্ছে।

এনআই/এমএআর/