• করোনার প্রভাবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিশুরা
• দৃষ্টিজনিত ত্রুটিতে আক্রান্ত ২৯.২৫ শতাংশ শিশু
• ভিটামিন ক্যাম্পেইনে ভাটা, শিশুপুষ্টিতে ঘাটতি
• করোনায় ঘরবন্দি থেকে স্থূলতা, এরপর ডায়াবেটিস
• করোনার খারাপ প্রভাব কয়েক দশক ধরে থাকবে

‘অটো পাস’, ‘অটো ব্যাচ’, ‘কোভিড ব্যাচ’— এসব বিশেষণ দিয়ে শিশুদের ছোট করা হচ্ছে। এমনকি বিষয়গুলো শিক্ষকরাও করেন, অভিভাবকরাও বাদ যান না। নেতিবাচক এমন মন্তব্য থেকে অবশ্যই আমাদের দূরে থাকতে হবে। এত বড় একটা মহামারির মধ্যেও শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবন যেভাবে চালাতে পেরেছে, এজন্য তাদের অভিনন্দন জানানো উচিত। তাদের বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, তারা যেন কোনোভাবেই বুলিংয়ের শিকার না হয়...

রিশাদ হাসান (১০), পড়াশোনা করেন ময়মনসিংহ জেলার একটি বেসরকারি স্কুলে। করোনায় দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থেকে অনেকটা মুটিয়ে গেছে সে। দেখা দিয়েছে শারীরিক ও মানসিক নানা জটিলতা। হঠাৎ হাঁটু থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ব্যথা অনুভব হয়, ঠিক মতো হাঁটতেও পারে না। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় রিশাদ। জানা যায়, হরমোন সংক্রান্ত জটিলতায় এমনটি হয়েছে, যা করোনার আগে ছিল না।

ছেলের অসুস্থতা প্রসঙ্গে মা উম্মে কুলসুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার সময়টা আমাদের জন্য খুবই খারাপ ছিল। বাচ্চাসহ পরিবারের সবাই একাধিকবার অসুস্থ হয়েছি। লকডাউনের পুরোটা সময় সবাই একপ্রকার ঘরবন্দি থেকেছি। এর আগে রিশাদকে নিয়ে নিয়মিত বাইরে হাঁটাহাঁটি করতাম, কিন্তু করোনার কারণে তা হয়ে ওঠেনি। সারাদিন বাসায় থেকে মোবাইল আর টেলিভিশনে আবদ্ধ থেকেছে সে।

করোনা চলে গেলেও এর ছাপ থেকে গেছে শিশু রিশাদের আচার-আচরণে। সকালে ঘুম থেকে তুলতে বেশ কষ্ট হয়, জোর করে তুললে অস্বাভাবিক আচরণ করে— বলছেন মা উম্মে কুলসুম / ঢাকা পোস্ট
করোনা চলে গেলেও তার ছাপ থেকে যায় রিশাদের আচার-আচরণ ও জীবন-যাপনে। সকাল সকাল তাকে ঘুম থেকে তুলতে বেশ কষ্ট হয়। উঠতে চায় না। জোর করে তুললে অস্বাভাবিক আচরণ করে। এমনকি শারীরিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। হাঁটতে গেলে পায়ে ব্যথা হয়। পাঁচ মিনিট হেঁটেও স্কুলে যেতে পারে না

‘করোনা চলে গেলেও তার ছাপ থেকে যায় রিশাদের আচার-আচরণ ও জীবন-যাপনে। সকাল সকাল তাকে ঘুম থেকে তুলতে বেশ কষ্ট হয়। উঠতে চায় না। জোর করে তুললে অস্বাভাবিক আচরণ করে। এমনকি শারীরিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। হাঁটতে গেলে পায়ে ব্যথা হয়। পাঁচ মিনিট হেঁটেও স্কুলে যেতে পারে না।’

আরও পড়ুন >> আগ্রহ কমেছে পড়াশোনায়, খারাপ হচ্ছে পরীক্ষার ফল

চিকিৎসক জানান, দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয়তায় এমনটি হয়েছে। হরমোনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে ভিটামিনেরও ঘাটতি দেখা দিয়েছে— যোগ করেন মা উম্মে কুলসুম।

শুধু রিশাদ হাসান নয়, অসংখ্য শিশুর ক্ষেত্রে এমনটি দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার কারণে অনেক শিশুই তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছে। তাদের জন্য শোক, দুঃখ, কষ্ট সামলানো খুবই কঠিন। প্রথমবারের মতো যেসব শিশু এগুলো মোকাবিলা করেছে তাদের জন্য পরিস্থিতিটা বেশ জটিল।

চারদিকে মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, আশেপাশের অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে— এসব বিষয় শিশুদের মনে মনস্তাত্ত্বিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, বলছে গবেষণা / ছবি- সংগৃহীত

শিশুদের নিয়ে বিশ্বব্যাপী কাজ করছে ইউনিসেফ। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার সরকারগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে কোটি কোটি শিশু ও তাদের পরিবারের জন্য, বিশেষ করে যাদের জীবন কোভিড- ১৯ মহামারি ও অন্যান্য দুর্যোগের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে; তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষায় জরুরিভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

করোনায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিশুরা

ইউনিসেফের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে ১০ থেকে ১৯ বছরের প্রতি সাতজন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে একজনেরও বেশি মানসিক ব্যাধি নিয়ে জীবন-যাপন করছে। প্রতি বছর প্রায় ৪৬ হাজার কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করে, যা এই বয়সীদের মৃত্যুর শীর্ষ পাঁচটি কারণের মধ্যে একটি।

জরিপে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ইতিহাস পাওয়া গেছে ৪১ শিশুর (৮ শতাংশ) মধ্যে। ১৭৫ জন (৩৪ দশমিক ২ শতাংশ) ছিল মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকির মধ্যে, যাদের মধ্যে ৪৩ জন (৮ দশমিক ৪ শতাংশ) এমন একজনকে চিনতেন যিনি কোভিড পজিটিভ ছিলেন। ওই ৪৩ জনের মধ্যে ১০ জন (২৩ দশমিক ৩) এমন কাউকে চিনতেন যিনি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন

বাংলাদেশসহ ২১টি দেশের শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ইউনিসেফ ও গ্যালাপ পরিচালিত ওই জরিপে দেখা গেছে, জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে হতাশা বোধ করেন অর্থাৎ কোনো কিছু করতে আগ্রহ দেখান না, তাদের হার ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা ১৪ শতাংশ।

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ইতিহাস ৮ শতাংশের, ঝুঁকিতে ৩৪ শতাংশ

‘করোনায় শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব’ সংক্রান্ত একটি জরিপ চালান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একদল চিকিৎসক। জরিপে চার থেকে ১৭ বছর বয়সী ৫১২ শিশু ও কিশোর-কিশোরীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে ২৫৮ জন (৫০ দশমিক ৪ শতাংশ) ছিল ছেলে এবং ২৫৪ জন (৪৯ দশমিক ৬ শতাংশ) মেয়ে। ৩৬৭ জন (৭১ দশমিক ৭ শতাংশ) চার থেকে ১০ বছর বয়সী এবং ১৪৫ জন (২৮ দশমিক ৩ শতাংশ) ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী।

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের ‘মনের যত্ন’ নিশ্চিত করতে হবে— বলছেন গবেষকরা / ছবি- সংগৃহীত

আরও পড়ুন >> জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে শিশুরা, আক্রান্ত হচ্ছে মাতৃগর্ভেও

জরিপে এসব শিশুর মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ইতিহাস পাওয়া গেছে ৪১ জনের (৮ শতাংশ)। ১৭৫ জন (৩৪ দশমিক ২ শতাংশ) ছিল মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকির মধ্যে, যাদের মধ্যে ৪৩ জন (৮ দশমিক ৪ শতাংশ) এমন একজনকে চিনতেন যিনি কোভিড পজিটিভ ছিলেন। ওই ৪৩ জনের মধ্যে ১০ জন (২৩ দশমিক ৩) এমন কাউকে চিনতেন যিনি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

জরিপে আরও দেখা যায়, ২১ দশমিক ৫ শতাংশ শিশু ও কিশোর-কিশোরী ছিল অত্যন্ত আবেগপ্রবণ। তাদের মধ্যে আচরণগত সমস্যা বিদ্যমান ছিল। এছাড়া মানসিক উপসর্গের ব্যাপকতা ও অমনোযোগিতার লক্ষণ ছিল প্রখর। সমবয়সীদের মধ্যে সম্পর্কের সমস্যা ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ২ শতাংশ, ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ, ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এক্ষেত্রে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের আচরণে অস্বাভাবিকতা অপেক্ষাকৃত বেশি দেখা যায়।

করোনায় আক্রান্ত অসংখ্য রোগী ও মৃত্যু দেখেছে শিশুরা

জরিপে নেতৃত্বদানকারী বিএসএমএমইউ’র মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সিফাত-ই সাইদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাকালীন আমরা যে জরিপ পরিচালনা করেছি, সেখানে ৪১ শিশুর মধ্যে মেন্টাল ডিজঅর্ডারের হিস্ট্রি (মানসিক ব্যাধির ইতিহাস) পেয়েছি। এছাড়া মেন্টাল ডিজঅর্ডারের ঝুঁকিতে ছিল ১৭৫ জন। কোভিড- ১৯ তাদের জন্য বড় ধরনের একটা মেন্টাল স্ট্রেস (মানসিক চাপ) ছিল। এটি যে শুধু বাংলাদেশের জন্য তা কিন্তু নয়, সারাবিশ্বের শিশুদের জন্য।

অটো পাস’, ‘অটো ব্যাচ’, ‘কোভিড ব্যাচ’— এসব বিশেষণ দিয়ে শিশুদের ছোট করা যাবে না। তারা যেন কোনোভাবেই বুলিংয়ের শিকার না হয়— বলছেন বিশেষজ্ঞরা / ছবি- সংগৃহীত

‘চারদিকে মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, আশেপাশের অসংখ্য মানুষ মারা গেছে। অনেকের আত্মীয়-স্বজন ছিল এর মধ্যে। এদিকে, বাইরে যাওয়া বন্ধ, স্কুল-কলেজ বন্ধ, পরীক্ষা বন্ধ, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা ও মেলামেশা বন্ধ; সারাক্ষণ ঘরবন্দি— সবকিছু মিলিয়ে শিশুদের মনে মনস্তাত্ত্বিক কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’

করোনা-পরবর্তীতে শিশুদের মধ্যে আরেক ধরনের পরিবর্তন আমরা দেখছি— উল্লেখ করে বিশিষ্ট এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, কোভিডকালীন দুই-আড়াই বছর তারা অনলাইনে পড়াশোনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এখন যেহেতু স্কুলে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে, তারা এটাতে অভ্যস্ত হতে পারছে না। এখন তারা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারছে না। কারণ, কোভিডকালীন সারারাত জেগে তারা দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। এখন যখন তাদের সকাল বেলায় ঘুম থেকে তোলা হচ্ছে, তারা সেটি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না।

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের ‘মনের যত্ন’ নিশ্চিত করতে হবে

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনায় যাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চাপ গেছে বা মানসিক সমস্যায় ভুগছে, তাদের মনোসামাজিক সহায়তার পাশাপাশি সব শিশুর মনের যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এ লক্ষ্যে আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে বেশকিছু পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়েছে। কোভিডকে মাথায় রেখে পরীক্ষার পদ্ধতি পরিবর্তন করা হয়েছে, শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন আনা হয়েছে। এমনকি সিলেবাসেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এই বিষয়গুলো আমাদের ইতিবাচক হিসেবে দেখতে হবে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় আমাদের অভিভাবক বা এমন অনেকে আছেন, যারা বিষয়গুলো নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন।

আরও পড়ুন >> দেশে ৪৫ শতাংশ নারী অপুষ্টিতে ভুগছেন : আইসিডিডিআরবি

“‘অটো পাস’, ‘অটো ব্যাচ’, ‘কোভিড ব্যাচ’— এসব বিশেষণ দিয়ে তাদের ছোট করা হচ্ছে। এমনকি বিষয়গুলো শিক্ষকরাও করেন, অভিভাবকরাও বাদ যান না। নেতিবাচক এমন মন্তব্য থেকে আমাদের অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। আমি তো মনে করি, এত বড় একটা মহামারির মধ্যেও শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবন যেভাবে চালাতে পেরেছে, এজন্য তাদের অভিনন্দন জানানো উচিত। তাদের বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, তারা যেন কোনোভাবেই বুলিংয়ের শিকার না হয়।”

করোনার প্রভাবে দেশের ২৯ দশমিক ২৫ শতাংশ শিশুর চোখে দৃষ্টিজনিত ত্রুটি দেখ দিয়েছে / ছবি- সংগৃহীত

আনন্দময় শ্রেণিকক্ষ এবং পরিবারের ভীতি দূর করতে হবে

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের মতে, প্রতিটি শিশুর মনের যত্নের জন্য শ্রেণিকক্ষ এবং তাদের ক্লাসগুলো আরও আনন্দময় করে গড়ে তুলতে হবে। আনন্দযুক্ত শিক্ষা ছাড়া কোনো শিক্ষাই তাদের জন্য কার্যকর হবে না। অর্থাৎ ভয় দেখিয়ে, ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে অথবা সিরিয়াস কোনো ধর্মীয় শিক্ষা তাদের ওপর আরোপ করা যাবে না; যা তাদের জন্য ‘হিতে বিপরীত’ হতে পারে।

‘শিশুটি যখন পরিবারের সঙ্গে থাকবে, তখনও তাকে আনন্দঘন পরিবেশে রাখতে হবে। কোনো ধরনের ভয়-ভীতি বা কোনো টার্গেট রেজাল্ট তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে যে আমরা একটি ভয়াবহ দুর্যোগ পার করছি। হয়তো এই মুহূর্তে করোনার সংক্রমণ কমে গেছে, মহামারি কিন্তু এখনও পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়নি।’

মোবাইল-টিভিতে বিনোদন : চোখের সমস্যা বেড়েছে শিশুদের

করোনা মহামারি শিশুদের স্বাভাবিক শৈশব কেড়ে নিয়েছে। শারীরিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধির বেড়াজালে চার কোনা অপার্থিব পৃথিবীর হাতছানি এক নিমেষে ঝেড়ে ফেলা সম্ভব নয়। তবে, লাগাম টানার সময় এখনও আছে। তা না হলে করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে আমাদের শিশুদের স্বাভাবিক শৈশব হারিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন >> আগুন আতঙ্কে ট্রমায় ভুগছে রোহিঙ্গা শিশুরা

উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। করোনাকালে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে। ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশই শিশু। সেই হিসাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ছয় কোটির ওপর শিশু রয়েছে। দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা প্রসারের মাধ্যমে শিশুদের হাতে হাতেও পৌঁছে যাচ্ছে প্রযুক্তির ছোঁয়া।

করোনায় ঘরবন্দি জীবন। শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য বিকাশে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছে / ছবি- সংগৃহীত 

২৯ দশমিক ২৫ শতাংশ শিশুর চোখে দৃষ্টিজনিত ত্রুটি

করোনাকালীন মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও টেলিভিশনে বুঁদ হয়ে থাকায় শিশুদের চোখে কেমন প্রভাব ফেলেছে— সে বিষয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক অফথালমোলজি বিভাগ। বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গবেষণা কার্যক্রমে অন্যতম সদস্য ছিলেন লং টার্ম ফেলো ডা. জামসেদ ফরীদি (জামি)।

গবেষণা প্রসঙ্গে ডা. জামসেদ ফরীদি ঢাকা পোস্টকে জানান, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত হাসপাতালটির শিশু চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগে সর্বমোট ৫০ হাজার ৫১৮ শিশু সেবা নিতে আসে। তাদের মধ্যে ২৭ হাজার ৬২৬ জন (৫৪.৬৯%) ছেলে এবং ২২ হাজার ৮৯২ জন ( ৪৫. ৩১%) কন্যাশিশু। এর মধ্যে ২৭৮ জন (৫২.৪৫%) ছেলে এবং ২৫২ (৪৭.৫৫%) কন্যাসহ মোট ৫৩০ শিশুকে গবেষণা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এসব শিশুর মধ্যে ১৫৫ জনের (২৯.২৫%) চোখে দৃষ্টিজনিত ত্রুটি দেখা যায়।

‘আমাদের দৃষ্টিতে কোভিডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিশুরা। সাধারণত চোখের সমস্যাটা আমরা বড় করে দেখি না। করোনাকালীন যেসব শিশু মোবাইলে অনলাইন ক্লাস এবং মোবাইল-টেলিভিশনকে একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম বানিয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোভিড কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পর চোখের নানা সমস্যা নিয়ে শিশুদের আমাদের কাছে আনা হচ্ছে।’

সবুজে ছেড়ে দিতে হবে শিশুদের

ডা. জামসেদ ফরীদির মতে, যেসব শিশু কোভিডে ঘরবন্দি অবস্থায় মোবাইলে সময় কাটিয়েছে, তাদের অনেকের মধ্যে এখনও সেই আসক্তিটা রয়ে গেছে। অনেক বাবা-মা আমাদের কাছে এসে বলছেন, মোবাইল ছাড়া তাদের শিশুরা খেতে চাচ্ছে না। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও মোবাইলের বায়না ধরছে। যার প্রভাবে শিশুদের চোখের সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করছে। যেসব শিশু আমাদের কাছে আসছে, তাদের বেশির ভাগই চোখে কম দেখতে পাচ্ছে। নিয়মিত চশমা ব্যবহারের প্রয়োজন হচ্ছে তাদের।

আরও পড়ুন >> একজনে শুরু, পুরো ঘরই হাসপাতাল!

করোনার প্রভাবমুক্ত হতে শিশুদের প্রতিদিন ঘণ্টাখানেকের জন্য সবুজ মাঠে ছেড়ে দিতে হবে, বলছেন গবেষকরা / ছবি- সংগৃহীত

‘আশঙ্কাজনক বিষয় হলো, শিশুরা তাদের চোখের সমস্যা বাবা-মায়ের কাছে খুলে বলতে পারছে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাদের অভিভাবকরাও বিষয়টি জানতে পারছে না। যখন শিশুটিকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বইয়ের লেখা যখন স্পষ্ট দেখতে না পারে, তখনই চিকিৎসকের দ্বারস্থ হচ্ছেন অভিভাবকরা।’

২০২০ সালে করোনার কারণে জরুরি সেবা ব্যাহত হওয়ায় প্রায় দুই লাখ ২৮ হাজার অতিরিক্ত শিশুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রায় ৫৩ লাখ শিশু গুরুত্বপূর্ণ টিকা কার্যক্রম থেকে বাদ পড়েছে। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ লাখ বেশি। ২০২০ সালে অতিরিক্ত ৩৮ লাখ ৫০ হাজার শিশু শীর্ণকায় হয়ে বেড়ে উঠেছে বা শারীরিক দুর্বলতায় ভুগেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে

এ ক্ষেত্রে করণীয় কী— জানতে চাইলে ডা. জামসেদ ফরীদি বলেন, যেসব শিশু করোনাকালীন মোবাইলে অনলাইন ক্লাস বা পড়াশোনা করেছে, তাদের প্রত্যেককেই চোখ পরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। মোবাইল থেকে যতটুকু সম্ভব তাদের দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিদিন ঘণ্টাখানেকের জন্য তাদের সবুজ মাঠে ছেড়ে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, চোখের সমস্যা কখনওই ছোট করে দেখা উচিত নয়।

মোবাইল ফোন যেন শিশুদের আসক্তি না হয়

মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনাকালীন ঘরবন্দি শিশুদের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহারের যে অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে সেখান থেকে আসলে ফিরে আসা কঠিন। তাই আমি বলবো, এর উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

‘মোবাইল থেকে ফিরে আসার প্রয়োজন নেই। ইলেকট্রনিক ডিভাইস, কম্পিউটার, মোবাইল— এগুলো এখন শিশুদের শিক্ষাকার্যক্রমে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। শুধু বাংলাদেশেই নয়, এগুলো সারা পৃথিবীতেই গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবে হ্যাঁ, শিশুদের তা যেন আসক্তি তৈরি না করে। এগুলোর যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তা হলে মোবাইল বা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রতি কোনো আসক্তি থাকবে না।’

ভিটামিন ক্যাম্পেইনে ভাটা, শিশুপুষ্টিতে ঘাটতি

করোনার কারণে শিশুদের ভিটামিন ক্যাম্পেইনসহ টিকা কার্যক্রমে অনেকটা ভাটা পড়েছে। ইউনিসেফের তথ্য বলছে, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ৬০ কোটি শিশুর মধ্যে সবচেয়ে প্রান্তিক অবস্থানে থাকা শিশুদের ওপর মহামারিটি অসম প্রভাব ফেলেছে। ২০২০ সালে করোনার কারণে জরুরি সেবা ব্যাহত হওয়ায় প্রায় দুই লাখ ২৮ হাজার অতিরিক্ত শিশুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রায় ৫৩ লাখ শিশু গুরুত্বপূর্ণ টিকা কার্যক্রম থেকে বাদ পড়েছে। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ লাখ বেশি। ২০২০ সালে অতিরিক্ত ৩৮ লাখ ৫০ হাজার শিশু শীর্ণকায় হয়ে বেড়ে উঠেছে বা শারীরিক দুর্বলতায় ভুগেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কম্পিউটার, মোবাইল— এগুলো শিশুদের শিক্ষাকার্যক্রমে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এর যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে কোনো আসক্তি থাকবে না, বলছেন বিশেষজ্ঞরা / ছবি- সংগৃহীত

জরুরি স্বাস্থ্য, টিকাদান, পুষ্টি, সুরক্ষা ও শিক্ষার মতো সেবাগুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া না গেলে কোভিড মহামারির সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব কয়েক দশক বিরাজ করবে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী পুষ্টিতে ঘাটতি : ড. মো. আখতারুজ্জামান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২০ সালে (করোনার সময়) পুষ্টি কার্যক্রম, ভিটামিন ক্যাম্পেইন কার্যক্রম অনেকটা ব্যাহত হয়েছে। ২০২১ সালে সীমিত আকারে কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তবে, চলতি বছর ভালোভাবে কাজ চলছে। যতটুকু গ্যাপ হয়েছে, সেটা খুব বেশি কিছু নয়। শুধু বাংলাদেশ না, সারা বিশ্বব্যাপী কিছুটা ঘাটতি হয়েছে।

‘পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের পুষ্টি ঘাটতি আগেও ছিল। এই মুহূর্তে আমাদের প্রায় ৩০ শতাংশ শিশুর পুষ্টি ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে ৮ থেকে ১০ শতাংশ আছে সিভিয়ার (তীব্র) পুষ্টি ঘাটতি। বাকি সহনীয় মাত্রায় রয়েছে। শিশুদের মারাত্মক সমস্যা হলো খর্বাকৃতি হওয়া। জিনিসটা বাংলাদেশে এখনও রয়ে গেছে। সবমিলিয়ে এগুলো কোভিডের আগেও ছিল, কোভিডের সময় হয়তো কিছুটা বেড়েছে।’

পুষ্টিকর খাবার পায় না শিশুরা

ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, করোনার সময় আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল। এ সময় অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। অনেকের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত তারা রিকভারি (পুনরুদ্ধার) করতে পারেননি। এমন লাখ লাখ পরিবার রয়েছে। তাদের ছেলে-মেয়েদের খাওয়া-দাওয়া অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। সবমিলিয়ে এমন ২০ শতাংশের মতো মানুষ রয়েছে। তাদের শিশুরা স্বাভাবিকভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।

আরও পড়ুন >> দুই সন্তানেই ‘ফুলস্টপ’ দিচ্ছেন ৭৯ শতাংশ মা

করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি কাজ আমাদের এখানে করতে হবে। প্রথমত, আমাদের শিক্ষার সিস্টেমটা ভালো করতে হবে। শিক্ষার হার বাড়াতে হবে। হয়তো রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব না, কিছুটা সময় লাগবে। দ্বিতীয়ত, আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো করতে হবে। বাল্যবিবাহ শিশুদের পুষ্টিহীনতার জন্য অন্যতম দায়ী। দেশে এখনও বাল্যবিবাহ রোধ করা যায়নি। করোনায় বরং আরও বেড়েছে।

করোনার কারণে ভিটামিন ক্যাম্পেইনে ভাটা পড়েছে। দেখা দিয়েছে শিশুপুষ্টিতে ঘাটতি— বলছে গবেষণা / ছবি- সংগৃহীত

‘গ্রাম এলাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ১৪ থেকে ১৫ বছর হলেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ সময়ে তারা তো পুরোপুরি ম্যাচিউরড (পূর্ণবয়স্ক) হয় না। অন্তত ১৮ বছরের আগে শিশুদের মধ্যে গ্রোথ ডেভেলপ (বৃদ্ধি বিকাশ) করে না। ফলে এ সময়ে বাচ্চা নিলে শিশুগুলো কম ওজনের হয়। কারণ, গর্ভাবস্থায় তো মেয়েরা ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া পায় না। সবমিলিয়ে পুষ্টির ঘাটতি মোকাবিলায় বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে।’

করোনায় ভিন্ন কৌশলে ভিটামিন ক্যাম্পেইন

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল নিউট্রিশন সার্ভিসের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মনজুর আল মোর্শেদ চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাকালীনও আমাদের ভিটামিন- এ ক্যাম্পেইন বন্ধ ছিল না। ক্যাম্পেইনটি মূলত ছয় মাস অন্তর বছরে দুবার হয়ে থাকে। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে সেই পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে। কারণ, সময়টা তো আসলে আমাদের পক্ষে ছিল না। যে কারণে যখন যে সিচুয়েশন ফেইস (পরিস্থিতি মোকাবিলা) করেছি, তখন সেই উপায়ে আমরা কার্যক্রম পরিচালনা করেছি।

‘একটা প্রোগ্রাম কখনও ১৪ দিনব্যাপী হয়েছে, কখনও সাত দিনব্যাপী হয়েছে, আবার চার দিনব্যাপীও হয়েছে। যেহেতু করোনার তীব্রতা ছিল, আমাদের সামাজিক দূরত্ব মেনেই ওই সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়েছে।’

স্কুল বন্ধ : শিশুদের স্থূলতা, বাড়ছে ডায়াবেটিস

লকডাউনে ঘরে বসে থেকে ওজন বেড়েছে শিশুদের। একই সঙ্গে বেড়েছে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা। ফলে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে চিন্তিত বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনায় শিশুরা কার্যত ঘরে বসেই সময় কাটিয়েছে৷ অনলাইন ক্লাসের সুযোগ থাকলেও শরীরচর্চা হয়নি৷ দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল পার্ক৷ অন্যদিকে, সবসময় ঘরে থাকায় আগের চেয়ে তারা বাড়তি খাবার খেয়েছে৷ খরচের উপায় না থাকায় তাদের শরীরে জমেছে ক্যালোরি৷ ফলে শিশুরা ক্রমশ মোটা হয়ে যাচ্ছে৷ 

শিশুদের পুষ্টির ঘাটতি মোকাবিলায় বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা / ছবি- সংগৃহীত

চিকিৎসকরা বলছেন, শিশুদের এ পরিবর্তন অনেক অভিভাবক বুঝতে পারছেন না। কিন্তু ওজন বাড়ার মাধ্যমে আদতে বহু রোগ ডেকে আনছে তারা৷ বিশেষত শহরাঞ্চলের শিশু, যারা বদ্ধ ফ্ল্যাটে বাস করে; তাদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

করোনায় ঘরবন্দি থেকে স্থূলতা, এরপর ডায়াবেটিস

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোভিডকালীন শিশুরা ঘরবন্দি ছিল দীর্ঘদিন। এ সময়ে তাদের মুভমেন্ট খুবই কম হয়েছে। তারা বাইরে যেতে পারেনি, খেলাধুলা করতে পারেনি। অনেকটা খাওয়া-দাওয়া আর ঘুম হয়েছিল একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম। ফলে অনেক শিশুর মধ্যে স্থূলতা দেখা দিয়েছে। এমনকি কারও কারও মধ্যে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি পর্যন্ত লক্ষ করা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, কোভিডে যারা গৃহবন্দি হয়েছে তারা কিন্তু এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি। তারা খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে যাচ্ছে না। শুধু যে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এমন, তা কিন্তু নয়। বড়দের ক্ষেত্রেও আমরা বিষয়টি দেখছি। যে কারণে স্থূলতা বাড়ার একটি শঙ্কা রয়েই গেছে।

স্থূলতা বাড়া মানে দ্রুত ডায়াবেটিসে রূপান্তর

ডা. শাহাজাদা সেলিম বলেন, কোভিডকালীন তারা বাইরের বিভিন্ন খাবারে অভ্যস্ত হয়েছে। এখন করোনা চলে গেলেও ওই খাবারের প্রভাবটা রয়ে গেছে। কোভিডের সময় খাবারের হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা  ছিল। এখনও মানুষের মধ্যে সেই অভ্যাসটা আছে। খাবারগুলো কিন্তু সুস্বাস্থ্যকর নয়।

লকডাউনে ঘরে বসে থেকে ওজন বেড়েছে শিশুদের। এমনকি কারও কারও মধ্যে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি পর্যন্ত লক্ষ করা যাচ্ছে / ছবি- সংগৃহীত

 ‘আলটিমেটলি বাংলাদেশের শিশুদের যে স্থূলতা, এর শেষ পরিণতি হলো দ্রুত ডায়াবেটিসে রূপান্তর। পৃথিবীর যেসব দেশে টাইপ টু ডায়াবেটিস কম বয়সে হয়, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এক নম্বরে আছে। পাশের দেশ ভারতে যদি দেখি, টাইপ টু ডায়াবেটিস যাদের হয় তাদের মধ্যে ১৬ শতাংশের বয়সই ১৫ বছরের নিচে। আমাদের দেশে শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিস আক্রান্তের হারও প্রায় একই রকম।’

স্থূলতার অন্যতম কারণ প্রক্রিয়াজাত খাবার

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা মহামারি শুধুমাত্র একটি মরণব্যাধি নিয়ে আসেনি, আরও অনেক আতঙ্ক সঙ্গে নিয়ে এসেছে। করোনার প্রথম দিকে সবকিছুর মতোই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছে। দীর্ঘদিন এ গ্যাপের কারণে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক অবস্থারও ব্যাপক বিপর্যয় ঘটেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো শিশুদের ওজন বৃদ্ধি।

‘আমাদের অভিভাবকরা বাসায় থেকে হোম অফিস করলেও এ সময় তাদের শিশুরা খুব বেশি তত্ত্বাবধানে থাকেনি। ফলে তাদের নিয়মিত খাদ্যাভ্যাসের বাইরে অনেক ক্ষেত্রে জাংক ফুড বা প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খাওয়া হয়েছে। প্রক্রিয়াজাত খাবারে শর্করা, স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকে এবং ফাইবার কম থাকে। এ ধরনের উচ্চ মাত্রার শর্করা ও চর্বি জাতীয় খাবার যেকোনো মানুষের জন্যই মোটা হওয়ার কারণ হতে পারে।’

অন্যদিকে, শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করতে যেয়ে বাচ্চারা খেলতে যেতে পারেনি। আবার শারীরিকভাবে উপস্থিত থেকে ক্লাস না হওয়া বা কোথাও বেড়াতে না যাওয়াতে তাদের সক্রিয় হওয়ার সুযোগও কম ছিল। এসব কারণে শিশুদের স্থূলতা বেড়েছে এবং ভয়ানক স্বাস্থ্য-হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে— যোগ করেন তিনি।

স্থূলতা বাড়া মানে দ্রুত ডায়াবেটিসে রূপান্তর। আর স্থূলতার অন্যতম কারণ প্রক্রিয়াজাত খাবার— বলছে গবেষণা / ছবি- সংগৃহীত

শিশুদের ওপর করোনার প্রভাব, যা বলছে ইউনিসেফ 

ইউনিসেফ বলছে, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক অগ্রগতি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য জরুরি বিনিয়োগের পাশাপাশি ভবিষ্যতে মহামারির ঢেউ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, জীবনের শুরুর দিকের বছরগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যগত প্রয়োজনগুলোর প্রতি তেমন নজর দেওয়া হয় না। যা সারাজীবন একজন ব্যক্তির সার্বিক সুস্থতার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

‘বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নীতিগত দিক থেকে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি মনোযোগ পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। আমাদের এখন এই ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সঙ্গে এই অগ্রগতিকে একীভূত করা প্রয়োজন। প্রতিটি শিশু ও তরুণের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার আছে।’

ইউনিসেফের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বিশ্বব্যাপী প্রতি সাত শিশুর মধ্যে অন্তত একজন লকডাউনের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ১৬০ কোটিরও বেশি শিশুর পড়াশোনা ক্ষতি হয়েছে। প্রাত্যহিক রুটিন, শিক্ষা, চিত্তবিনোদন বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি পারিবারিক আয় ও স্বাস্থ্যজনিত উদ্বেগের কারণে তরুণ জনগোষ্ঠীর অনেকে ভীতি ও রাগ অনুভব করছে। তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।

কোভিড- ১৯ মহামারির সবচেয়ে খারাপ প্রভাব আগামী কয়েক দশক ধরে অনুভূত হবে। এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি— বলছেন গবেষকরা / ছবি- সংগৃহীত

খারাপ প্রভাব আগামী কয়েক দশক ধরে অনুভূত হবে

দক্ষিণ এশিয়ায় ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক জর্জ লারিয়া আদজেই বলেন, সাম্প্রতিক দশকে শিশু অধিকারের অগ্রগতিতে আমাদের অঞ্চলে যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে তা এখন ঝুঁকির মধ্যে। যদি আমরা এখনই পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হই, তবে কোভিড- ১৯ মহামারির সবচেয়ে খারাপ প্রভাব আগামী কয়েক দশক ধরে অনুভূত হবে। তবে, এখনই পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা সুযোগগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে পারি। এটা নিশ্চিত করতে পারি যে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি শিশু কেবল টিকেই থাকবে না বরং সমৃদ্ধি লাভ করবে।

‘একের পর এক নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসলেও দক্ষিণ এশিয়ার মাত্র ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণরূপে টিকা দেওয়া হয়েছে। ফলে পরিবারগুলো এখনও বিপজ্জনকভাবে অরক্ষিত। বিশ্বের সরকারগুলোকে অবশ্যই কোভিড- ১৯ টিকার ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। মহামারিটা সবার জন্য শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত কারও জন্যই শেষ হবে না।’ 

টিআই/এমএআর/