মিয়ানমারে নিবন্ধন ও নাগরিকত্ব সংকটের সমাধান চান রোহিঙ্গারা
• চান শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও জীবিকার নিশ্চয়তা
• নিজ ভিটেমাটি ফিরিয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দাবি
• প্রত্যাবাসনে প্রয়োজন জোরালো আন্তর্জাতিক চাপ
মিয়ানমারের মংডুর দক্ষিণ বাহারছড়া গ্রামে থাকতেন মো. আমিন (৪৮)। মাদ্রাসায় পড়াশোনা করা আমিনকে একদিন বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনী। পুরো পরিবারে নেমে আসে নির্যাতন, মানবিক দুর্যোগ। ভয়ে পরিবার নিয়ে নদীপথে বাংলাদেশে চলে আসেন। এরপর থেকে কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় হয়। সেখানে হেড মাঝির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
আমিন বলেন, ছোট্ট ত্রিপলের ছাউনিতে পাঁচটা বছর কেটে গেল। মন পড়ে আছে মংডুতে। অবশ্যই সেখানে ফিরতে চাই। কিন্তু স্বাধীন নাগরিকের সুবিধা কে নিশ্চিত করবে?
আমিনের মতো এমন প্রশ্ন এখন লাখো রোহিঙ্গা নাগরিকের। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।
আজ ২৫ আগস্ট, রোহিঙ্গা ঢলের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। নিজ দেশে ফিরে যেতে না পারার ব্যাকুলতা আজও লাখো রোহিঙ্গার মনে ভারী করে রেখেছে।
আরও পড়ুন >> তড়িঘড়ি করলে মিয়ানমারের ফাঁদে পড়বে বাংলাদেশ
হতাশা ব্যক্ত করে তারা বলছেন, নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য মুহিবুল্লাহ (আততায়ীদের গুলিতে নিহত রোহিঙ্গা নেতা) দেশে-বিদেশে যেভাবে চেষ্টা করেছিলেন, তাতে তাদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল যে একদিন নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবেন, বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবেন। কিন্তু মুহিবুল্লাহ খুন হওয়ার মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্নে ছেদ ঘটেছে।
তবে তারা বলছেন, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসন পরিস্থিতি তৈরি হলে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরতে চান তারা। চলাফেরার স্বাধীনতা, নিবন্ধন ও নাগরিকত্বের সমাধান দিতে হবে। দিতে হবে শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও জীবিকা অর্জনের সুযোগ।
নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য মুহিবুল্লাহ (আততায়ীদের গুলিতে নিহত রোহিঙ্গা নেতা) দেশে-বিদেশে যেভাবে চেষ্টা করেছিলেন, তাতে তাদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল। একদিন নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবেন। বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবেন। কিন্তু মুহিবুল্লাহ খুন হওয়ার মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্নের ছেদ ঘটে
কিন্তু তারা কি ফিরতে পারবেন? দেশি-বিদেশি অনেক চেষ্টার পরও সে নিশ্চয়তার পরিবেশই তৈরি করা যায়নি গত পাঁচ বছরে।
আরও পড়ুন >> রোহিঙ্গা ইস্যুকে অবশ্যই আন্তর্জাতিকভাবে অগ্রাধিকার দিতে হবে
রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন ‘জাতিগত নিধনের ধ্রুপদী' উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করেছিল জাতিসংঘ৷ বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠার মধ্যে অনেকে একে ‘জেনোসাইড' হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে সই করে মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়৷
২০২১ সালের শুরুতে চীনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রক্রিয়ায় আশার আলো দেখা যায়। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে সেটি থমকে যায়৷ ওই সময় বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছিল, ছয় দফায় মোট আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ৪২ হাজারের ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করেছে মিয়ানমার৷ এর মধ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির টালমাটাল অবস্থা এবং করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সেই আলোচনাও আর সামনে এগোয়নি৷
গত পাঁচ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরাতে না পারার হতাশার কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও। তার ভাষায়, মিয়ানমারের নাগরিকদের এখনই নিজ দেশে ফেরত পাঠানো প্রয়োজন। কারণ, তারা নিজ দেশে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে মিয়ানমারের নাগরিকদের এখনই ফেরত পাঠানো প্রয়োজন।
গত ১৫ থেকে ১৯ আগস্ট কক্সবাজারের কুতুপালং ও বালুখালি ক্যাম্পে বসবাস করা রোহিঙ্গা নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট। কুতুপালং-এর একটি ক্যাম্পের হেড মাঝি মো. আমিন বলেন, ‘আমরা ফিরতে চাই। নিজ দেশে ফিরতে পারব— এমন স্বপ্নও বুনতে শুরু করেছিলাম। যার হাত ধরে আমাদের দেশে ফেরার স্বপ্ন শুরু, সেই মুহিবুল্লাকে হত্যা করা হলো নির্মমভাবে। তার পরিবারের ১১ সদস্যকে বিদেশে পাঠানো হলো।’
আরও পড়ুন >> উগ্রবাদে সম্পৃক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রোহিঙ্গারা : পররাষ্ট্রমন্ত্রী
‘আমরা বাংলাদেশে থেকে এখানকার মুসলিম ভাইদের আর কষ্ট দিতে চাই না। কিন্তু মানবিক বিপর্যয় থেকে বাঁচতে এখানে আসা। এখান থেকে মিয়ানমারে ফিরে স্বাধীনতা, অধিকার, রাষ্ট্রীয় সেবা থেকে যদি বঞ্চিত হই তাহলে তো আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এসবের নিশ্চয়তা দিলেই আমরা ফিরে যাব।’
একই ধরনের বক্তব্য দেন আরেক রোহিঙ্গা নেতা মো. আনোয়ার। বলেন, আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ ইউএনএইচসিআরের প্রতি। আমাদের দুর্দিনে শেখ হাসিনা আশ্রয় দিয়েছেন। কক্সবাজারের মানুষ কষ্ট সইছে। আমরা আর এখানে থাকতে চাই না। দেশে ফিরতে চাই। কিন্তু ফেরার সেই পথ মসৃণ না হলে আমাদের সেখানে গিয়ে লাশ হতে হবে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে ‘গো হোম’ অর্থাৎ ‘বাড়ি চলো’ প্রচারণা চালাচ্ছেন রোহিঙ্গা নাগরিকরা। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্যাম্পের অলিগলিতে বিভক্ত হয়ে এমন প্রচারণা চালিয়ে বিশ্ববাসীকে জানান দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা। গত ১৯ জুন সকালে উখিয়া ও টেকনাফে বিশাল সমাবেশও করেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।
ওই সমাবেশে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সমিমুল্লাহ। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সোচ্চার ছিল আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ)। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের ছয় মাস আগে সংগঠনের চেয়ারম্যান (মুহিবুল্লাহ) ‘বাড়ি চলো’ প্রচারণা কর্মসূচি শুরু করেন। সেই এআরএসপিএইচ কার্যালয়েই আততায়ীদের গুলিতে নিহত হন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ।
তিনি বলেন, ‘তার মৃত্যুর পর নানা কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা বিশ্ববাসীকে জানানোর চেষ্টা করেছি, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। আরাকান আমাদের জন্মভূমি। আমরা জন্মভূমিতে ফিরতে চাই।’
আরও পড়ুন >> ‘ফুরিয়ে আসছে’ রোহিঙ্গা তহবিল, উদ্বেগে জাতিসংঘ
এদিকে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সরকারকে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের সরকার অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল। বাংলাদেশ সরকার, মিডিয়া ও নাগরিকদের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার চাপটা বজায় রাখতে হবে। যাতে তা আলোচনার মধ্যে হারিয়ে না যায়৷ দেশি-বিদেশি, দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক— সব ভাবেই আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।’
এদিকে, খুব দ্রুতই রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানোর সম্ভাবনা দেখেন না অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে নানামুখী চেষ্টা চলছে। এটা চালিয়ে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) মিয়ানমারে গণহত্যার বিষয়টি স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা তদন্তের অনুমতি দিয়েছে।
‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে আগে সেখানকার পরিস্থিতি ও অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে। আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা, চাপটা চালু রাখতে হবে। কয় বছর লাগবে, সেটা বলা সম্ভব না। তবে, মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে যে হ্যাঁ, এরা (রোহিঙ্গা) তোমাদের নাগরিক। তাদের ফেরাতে তোমরা বাধ্য।’
যা বলছে ইউএনএইচসিআর
গত ২৩ আগস্ট এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা এবং তাদের সংকট নিরসনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর।
বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের আর্থিক সহায়তা ও সংকট সমাধানে জোর প্রচেষ্টার আহ্বান জানাচ্ছে। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার সর্বশেষ ঘটনাটি এখন একটি প্রলম্বিত সংকটে পরিণত হয়েছে। এই মানবিক সংকটের শুরুতে বাংলাদেশের সরকার, স্থানীয় জনগণ ও মানবিক সংস্থাগুলো দ্রুত শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ায় এবং কক্সবাজারে তাদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করে। যেটি বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থীশিবির।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেতের কাছে রোহিঙ্গারা নিজেদের অধিকার নিশ্চিত করে রাখাইনে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। তবে, রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি উন্নত না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের সেখানে পাঠানো ঠিক হবে না বলে মনে করেন মিশেল
পাঁচ বছর পর অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী ইউএনএইচসিআর-কে বলেছে, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পরিস্থিতি তৈরি হলে তারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাবে। তারা নিজ মাতৃভূমিতে চলাফেরার স্বাধীনতা, নিবন্ধন ও নাগরিকত্ব প্রদান, বিভিন্ন সেবা এবং জীবিকা অর্জনের সুযোগ দাবি করেন।
রোহিঙ্গাদের বর্তমান দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সহায়তার আবেদন জানায় ইউএনএইচসিআর। সংস্থাটি বলছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যেন রোহিঙ্গারা এই নিদারুণ শরণার্থী জীবন চালিয়ে যেতে বাধ্য না হন। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে বিশ্বকে আরও জোরদারভাবে কাজ করতে হবে। যাতে তারা স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসইভাবে নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করতে পারে।
এদিকে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেতের কাছে রোহিঙ্গারা নিজেদের অধিকার নিশ্চিত করে রাখাইনে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। তবে, রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি উন্নত না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের সেখানে পাঠানো ঠিক হবে না বলে মনে করেন মিশেল।
মিশেল ব্যাশেলেত বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে গত ১৪ থেকে ১৭ আগস্ট বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
জেইউ/এমএআর/