অনুমতি না পাওয়া এজেন্সির সঙ্গে লেনদেন
না বুঝে ফাঁদে পা দিচ্ছেন মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুরা
তিন বছর বন্ধ থাকার পর গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার অনুমোদন দেয় মালয়েশিয়া। তবে বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানোর আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি। কিন্তু কর্মী পাঠানোর নামে কিছু অসাধু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ গত ৬ জুলাই জানান, মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অংশের খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। সরকার এখন পর্যন্ত ১৪টি এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দিয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি এজেন্সির মাধ্যমে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ২ হাজার ২০০ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যারা বিএমইটির নিবন্ধিত। আর কতগুলো এজেন্সিকে অনুমতি দেওয়া হবে তা এখনও চূড়ান্ত নয়।
বিজ্ঞাপন
এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এখনও মেডিকেল ফি নির্ধারণ করা হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে লেনদেন। ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর আশায় মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুকরা লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে এজেন্সিগুলোর হাতে টাকা তুলে দিচ্ছেন।
এখনও কর্মী প্রেরণের অনুমতি না পেলেও কিছু এজেন্সি ইতোমধ্যে সরকার নির্ধারিত খরচের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আগ্রহী কর্মীদের কাছ থেকে। আড়াই লাখ থেকে শুরু করে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়ার তথ্য রয়েছে একজন কর্মীর কাছ থেকে। এছাড়া নিয়ম ভেঙে সিন্ডিকেটের কয়েকটি এজেন্সি ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ রেখে চালাচ্ছেন স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজও
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধান বলছে, এখনও কর্মী প্রেরণের অনুমতি না পেলেও কিছু এজেন্সি ইতোমধ্যে সরকার নির্ধারিত খরচের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আগ্রহী কর্মীদের কাছ থেকে। আড়াই লাখ থেকে শুরু করে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়ার তথ্য রয়েছে একজন কর্মীর কাছ থেকে। এছাড়া নিয়ম ভেঙে সিন্ডিকেটের কয়েকটি এজেন্সি ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ রেখে চালাচ্ছেন স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজও।
মো. আরিফ (ছদ্মনাম) হবিগঞ্জের বাসিন্দা। মালয়েশিয়া যাবেন বলে কয়েকটি এজেন্সির সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। প্রত্যেকটি এজেন্সিই তার কাছে সরকার নির্ধারিত টাকার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি টাকা দাবি করেছে।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, করোনার কারণে তিন বছর চেষ্টা করেও বিদেশে যেতে পারিনি। আমার এক মামা থাকে মালয়েশিয়ায়। তিনি জানালেন, সরকার ৮০ হাজার টাকায় লোক নেবে। এরপর কয়েকটি এজেন্সিতে কথা বলেছি, সবাই বলে ৮০ হাজারে তারা পারবে না। পরে পরিচিত একজনের মাধ্যমে এক এমপির এজেন্সিতে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকায় রাজি হয়েছি। চুক্তি অনুযায়ী এক লাখ টাকা জমা দিয়েছি। বাকিটা ভিসা আসার পর দিতে হবে।
আরও দেখুন >> বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগে দুর্নীতি, ৮ মালয়েশীয় কর্মকর্তা গ্রেপ্তার
চাঁদপুরের হারুন মিয়া মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য এরই মধ্যে মেডিকেলও করিয়ে ফেলেছেন একটি এজেন্সির মাধ্যমে। ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সি তার কাছ থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সাত হাজার টাকা নিয়েছে। হারুন জানান, এজেন্সিটি এখনও তাকে মালয়েশিয়া যেতে কত খরচ হবে তা স্পষ্ট করে বলেনি। তবে তাকে ধারণা দেওয়া হয়েছে, দুই লাখের বেশি লাগতে পারে। পরবর্তীতে তাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সরকার কর্মীদের মালয়েশিয়া যেতে বাংলাদেশ অংশের ব্যয় নির্ধারণ করেছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কোন প্রক্রিয়ায় কর্মীরা সেখানে যাবেন সেটার রূপরেখা বা গাইডলাইন জানানো হয়েছে। এছাড়া ৬৮টি মেডিকেল সেন্টারের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে এখনও মেডিকেলের খরচ নির্ধারণ করা হয়নি। চলতি সপ্তাহে না হলেও পরবর্তী সপ্তাহে অনেক বিষয় চূড়ান্ত হবে।
মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্তকর্তা বলেন, আমরা তো চাই কর্মী আজই যাওয়া শুরু হোক। বৈধ এজেন্সিগুলোর সবাই যেন কর্মী পাঠাতে পারে, সেজন্য দেড় হাজারের বেশি বৈধ এজেন্সির তালিকা মালয়েশিয়াকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মালয়েশিয়া অংশ থেকে কাউকে যদি বেছে নেওয়া হয় আমাদের সেই অর্থে কিছু করার থাকে না। মালয়েশিয়া থেকে সিন্ডিকেট হচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা তো সিন্ডিকেট সিন্ডিকেট করে প্রায় চার বছর কাটিয়ে দিলাম। আমাদের কর্মীদের যাওয়াটা জরুরি। বন্ধ থাকাটা কোনো সমাধান নয়। তবে আমাদের দিক থেকে কোনো অনৈতিক কিছু হলে সেটা আমরা দেখব, ব্যবস্থাও নেব।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের অবশ্যই বিএমইটির ডেটাবেজে তালিকাভুক্ত হতে হবে। অর্থাৎ সরকারের ডাটাবেজে নিবন্ধিত কর্মী না হলে মালয়েশিয়ায় কর্মী হয়ে যাওয়া যাবে না। কিন্তু যেসব এজেন্সি কর্মীদের মালয়েশিয়া পাঠাবে বলে অর্থ নিয়েছে এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েছে, এদের অনেকেই নিবন্ধিত নয়।
আরও দেখুন >> আরও ২৫০ রিক্রুটিং এজেন্সির অনুমোদন দেবে মালয়েশিয়া
এমনই একজন লক্ষীপুরের বাসিন্দা মীর জামাল। জামাল জানান, একটি এজেন্সির সঙ্গে মালয়েশিয়া যাওয়ার বিষয়ে তার কথাবার্তা চলছে। জামালের পাসপোর্টে দেখা যায়, মাত্র মাস দুয়েক আগে তিনি পাসপোর্ট করিয়েছেন। তিনি বিএমইটির নিবন্ধিত কর্মী নন এবং তিনি জানেনও না সংস্থাটির নিবন্ধন না পেলে মালয়েশিয়া যাওয়া সম্ভব হবে না।
অনুমতি না পাওয়া অনেক এজেন্সিতে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু অনেক কর্মী লেনদেন করছেন। শেষ পর্যন্ত যদি ওইসব এজেন্সি অনুমোদন না পায় তাহলে লেনদেন করা কর্মীদের কী হবে- জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে বার বার বলা হয়েছে, আগেভাগে কেউ লেনদেন করবেন না। তারা তো মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে লেনদেন করেনি। তাছাড়া কেউ তো মন্ত্রণালয়ে অভিযোগও করেনি।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, কর্মী পাঠাতে স্বাস্থ্য পরীক্ষার খরচ কত হবে সেটা কিন্তু এখনও জানায়নি মন্ত্রণালয়। কিছু কিছু এজেন্সি নিজেরাই স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাচ্ছে। তারা যে সিলেকশন করে মেডিকেল করছে, এ কর্মীটা কীভাবে যাবে। যদি মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত থাকে, মন্ত্রণালয় ডেটাবেজ থেকে কর্মী প্রদান করবে, এটা যদি নিশ্চিত হয়ে থাকে এখন যারা মেডিকেল করাচ্ছে বা লোক রিক্রুট করাচ্ছে, ওই লোকের ভাগ্যে কী ঘটবে?
শামীম নোমান বলেন, জনস্বার্থে শিগগিরই মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট প্রতিবেদন দেওয়া উচিত। যাতে যারা মালয়েশিয়ায় যেতে চান, তারা বিভ্রান্ত না হন, ক্ষতিগ্রস্ত না হন। সরকার নির্ধারিত খরচের বাইরে অধিক অর্থ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আমার কথা হচ্ছে, এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট একটা গাইডলাইন দেওয়া উচিত। কারা কারা কর্মী পাঠাবে, মেডিকেল খরচ কত হবে, এছাড়া অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয় থাকবে। এতে যারা বিদেশে যাবেন এবং পাঠাবেন, সবার কাছে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এখনও মেডিকেল ফি নির্ধারণ করা হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে লেনদেন। ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর আশায় মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুকরা লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে এজেন্সিগুলোর হাতে টাকা তুলে দিচ্ছেন
গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার সঙ্গে হওয়া সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী কর্মীর বেশিরভাগ খরচই নিয়োগকর্তা বহন করবেন। তবে বাংলাদেশে কর্মীর কিছু খরচ নিজেকেই বহন করতে হবে।
সমঝোতা স্মারকের আওতায় বাংলাদেশি কর্মীদের মালয়েশিয়া প্রান্তের সব খরচ নিয়োগকর্তাই বহন করবেন। এসব খরচের মধ্যে রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি নিয়োগ, মালয়েশিয়ায় আনয়ন, আবাসন, কর্মে নিয়োগ ও কর্মীর নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর খরচ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
আরও দেখুন >> মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের নিবন্ধন শুরু
এছাড়া নিয়োগকর্তা নিজ খরচে মালয়েশিয়ান রিক্রুটিং এজেন্ট নিযুক্ত করতে পারবেন। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর বাংলাদেশি কর্মীর ইমিগ্রেশন ফি, ভিসা ফি, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ইন্স্যুরেন্স, করোনা পরীক্ষা, কোয়ারেন্টিন সংক্রান্ত খরচসহ সব ব্যয় মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা বা প্রতিষ্ঠান বহন করবেন। নিয়োগকর্তা কর্মীর মানসম্মত আবাসন, বিমা, চিকিৎসাও নিশ্চিত করবেন।
কর্মীদের নির্ধারিত খরচ প্রকাশের ছয় দিন পর গত ১২ জুন থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী হিসেবে গমনেচ্ছুদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিএমইটি। সংস্থাটি জানায়, জেলা কর্মসংস্থান অফিস কিংবা অনলাইনে ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপের মাধ্যমে এই নিবন্ধন করা যাচ্ছে।
এরপর গত ২৬ জুলাই বিএমইটি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যেভাবে বাংলাদেশি কর্মীরা যাবে তার একটি রূপরেখা প্রকাশ করে। এই রূপরেখা অনুযায়ী মালয়েশিয়া যাওয়ার ক্ষেত্রে কর্মীদের ১৩টি ধাপ অনুসরণ করতে হবে।
অভিবাসন ও উদ্বাস্তু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, শ্রমবাজার খোলা জরুরি। তবে সেটা যদি আগের শর্তে বা আগের মতো অবস্থা হয়, তবে সেটা তো ভালো ফল বয়ে আনবে না। গতবারও বাজার বন্ধ হয়েছে সিন্ডিকেটের কারণে। আর সেটা মালয়েশিয়া অংশ থেকে হয়েছে। এর সমাধান না করে বাজার খোলা হলে খুব একটা লাভ হবে না। আর শূন্য অভিবাসন ব্যয় তো অলীক কল্পনা। এটা হওয়ার মতো কোনো কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি না। যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, সরকার নির্ধারিত খরচের বহুগুণ বেশি টাকা দিয়েই কর্মীদের মালয়েশিয়া যেতে হবে।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে। বিএমইটির তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ৭৫ হাজার ৯২৭ জন, ২০১৯ সালে ৫৪৫ জন, ২০২০ সালে ১২৫ জন এবং চলতি বছর মাত্র ১৪ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় কর্মী হিসেবে গেছেন। এখন পর্যন্ত দেশটিতে ১০ লাখ ৫৭ হাজার ২১৩ জন বাংলাদেশি কর্মী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে এখন পর্যন্ত অনুমোদন পাওয়া রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো হলো- নিউ এজ ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স পাথ ফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল , গ্রীনল্যান্ড ওভারসীজ, মেসার্স আমিয়াল ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স আল বোখারী ইন্টারন্যাশনাল, ইম্পেরিয়াল রিসোর্স লিমিটেড, মেসার্স সাউথ পয়েন্ট ওভারসিস লিমিটেড, মেসার্স আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল, বিনিময় ইন্টারন্যাশনাল, আকাশ ভ্রমণ, আরভিং এন্টারপ্রাইজ, কেথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, বি এস ট্রাভেলস ও ব্রাদার্স ইন্টারন্যাশনাল।
এনআই/এনএফ/ওএফ