ছাত্ররাজনীতিতে ‘কমিটি’, ‘পদ’— এ শব্দগুলো পদপ্রত্যাশী ও তাদের অনুসারীদের কাছে উৎসবের উপলক্ষ। একেকটা ইউনিটের কমিটি মানেই কেক কাটা, মিষ্টি বিতরণ; মিছিলে মিছিলে নিজেদের সরব উপস্থাপন। কিন্তু শোকের মাস আগস্টে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আওয়ামী লীগ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো কমিটি দেওয়া থেকে বিরত থাকে। বিরত থাকে সব ধরনের উৎসব আয়োজন থেকেও।  

ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় সাত মাস হলো। কিন্তু এখনও সংগঠনের অনেকগুলো ইউনিটের কমিটি দেওয়া বাকি। ধীরেসুস্থে দেওয়া অনেক কমিটিতে যেখানে পদ-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে, সেখানে আগস্ট মাস (শোকের মাস) শুরুর আগে রোববার (৩১ জুলাই) রাতে একদিনে জেলা, জেলা সমমান ও উপজেলা মিলে ১১টি ইউনিটের কোথাও পূর্ণাঙ্গ, কোথাও আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।

ধীরেসুস্থে দেওয়া অনেক কমিটিতে যেখানে পদ-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে, সেখানে আগস্ট মাস (শোকের মাস) শুরুর আগে রোববার (৩১ জুলাই) রাতে একদিনে জেলা, জেলা সমমান ও উপজেলা মিলে ১১টি ইউনিটের কোথাও পূর্ণাঙ্গ, কোথাও আংশিক কমিটি ঘোষণা করেছে সংগঠনটি

আরও পড়ুন >> ‘অপরাধীরা’ লেখকের ঘনিষ্ঠ!

একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ইউনিটে শীর্ষ পদে আসতে না পারা পদপ্রত্যাশীসহ প্রায় ২০০ জনকে উপ-সম্পাদক, সহ-সম্পাদক ও সদস্য হিসেবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্বাহী সংসদের বর্ধিত কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ঘোষণা দেওয়া ইউনিটগুলো হলো- ঝিনাইদহ জেলা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নরসিংদী জেলা, লক্ষ্মীপুর জেলা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম জেলা উত্তর, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঝিনাইদহ সদর ও চকরিয়া উপজেলা।

এসব কমিটি গঠনে তারা যে তাড়াহুড়া করেছেন, তার প্রমাণ মিলেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। সেখানে বাংলাদেশের বানান ‘বাংলাদশ’ লেখা হয়েছে। লক্ষ্মীপুর জেলা, নরসিংদী জেলা, ঝিনাইদহ জেলা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি প্রকাশ করে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ ভুল লক্ষ্য করা গেছে।

তারা যে তাড়াহুড়া করেছেন, তার প্রমাণ মিলেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। সেখানে বাংলাদেশের বানান ‘বাংলাদশ’ লেখা হয়েছে। লক্ষ্মীপুর জেলা, নরসিংদী জেলা, ঝিনাইদহ জেলা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি প্রকাশ করে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ ভুল লক্ষ্য করা গেছে।

জয়-লেখকের কীসের এত তাড়াহুড়া—  ঢাকা পোস্ট এ নিয়ে কথা বলেছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে। তাদের অনেকেরই অভিযোগ, টাকার বিনিময়ে কমিটি দিয়েছেন তারা (জয়-লেখক)। শোকের মাসে যাতে কেউ প্রতিবাদ করতে না পারে সেজন্য তাড়াহুড়া করে কমিটিগুলো দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এসব কমিটিতে পদ-বাণিজ্যের অভিযোগ এনেছেন খোদ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই।

আরও পড়ুন >> সম্মেলন পেছানোর চেষ্টায় জয়-লেখক

বানান ভুলের বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনি বলেন, ‘টাইপিং মিস্টেক হয়েছে। এটা আমাদের ইচ্ছাকৃত ভুল নয়।’

এদিকে দুই সদস্যের কমিটি গঠনের তিন বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। কমিটি ঘোষণার পর পদ-বাণিজ্য ও অছাত্রদের রাখার অভিযোগের পর কমিটির সদস্য সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। রোববার মধ্যরাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের সই করা ১২ পাতার ৩৭৬ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা ছাত্রলীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে আপলোড করা হয়েছে। তবে ওই ৩৭৬ সদস্যের বাইরে দুটি পাতায় আরও ৫৪ জনের তালিকা পাওয়া গেছে। যদিও পরের ৫৪ জনের বিষয়ে কেউ কিছু নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।

জয়-লেখকের কীসের এত তাড়াহুড়া—  ঢাকা পোস্ট এ নিয়ে কথা বলেছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে। তাদের অনেকেরই অভিযোগ, টাকার বিনিময়ে কমিটি দিয়েছেন তারা (জয়-লেখক)। শোকের মাসে যাতে কেউ প্রতিবাদ করতে না পারে সেজন্য তাড়াহুড়া করে কমিটিগুলো দেওয়া হয়েছে

ছাত্রলীগের ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গ কমিটি সংক্রান্ত কোনো বিজ্ঞপ্তি পাওয়া যায়নি। এছাড়া অন্যান্য কমিটি সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ভেরিফায়েড পেজে প্রকাশ করা হলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটির পূর্ণাঙ্গ তালিকা সেখানে স্থান পায়নি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়, সহ-সভাপতি পদ কতজন পেয়েছেন আর কমিটি কত সদস্য বিশিষ্ট। তিনি বলেন, ‘আমি খোঁজ নিয়ে জানাব।’ এই বলে কল কেটে দেন তিনি। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনি।

আরও পড়ুন >> পদ বাণিজ্যের অভিযোগ প্রমাণ দিতে পারলে পদত্যাগ করব : জয়

এদিকে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা, বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় বর্ধিত কমিটিতে অছাত্র, বিবাহিতবিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্তদের পদায়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ খোদ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতেও দেখা যায় তাদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে গণিত বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী ও অমর একুশে হল ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন দীপুর বিরুদ্ধে। বর্তমানে তার ছাত্রত্ব নেই বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ এবং একই উপজেলার বাসিন্দা হওয়ায় তাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে উপ-বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে। ছাত্রত্ব না থাকায় এর আগে তিনি হল ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে আসতে পারেননি বলেও ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়, সহ-সভাপতি পদ কতজন পেয়েছেন আর কমিটি কত সদস্য বিশিষ্ট। তিনি বলেন, ‘আমি খোঁজ নিয়ে জানাব।’ এই বলে কল কেটে দেন। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনি

এছাড়া ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেয়েছেন বিবাহিত ও এক সন্তানের জনক আশিকুর রহমান অণু। এ নিয়ে ফেসবুকে স্ত্রী-সন্তানের ছবিসহ পোস্ট করে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে।

কমিটি নিয়ে ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হল ছাত্রলীগের সভাপতি শিলা আক্তারকে। তিনি লিখেছেন, ‘টাকাই (টাকায়) বেচে দিলেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি। ত্যাগ-পরিশ্রমের কোনো মূল্য নেই।’

কমিটি নিয়ে ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হল ছাত্রলীগের সভাপতি শিলা আক্তারকে। তিনি লিখেছেন, ‘টাকাই (টাকায়) বেচে দিলেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি। ত্যাগ-পরিশ্রমের কোনো মূল্য নেই’

আরও পড়ুন >> চায়ের কাপে অভিভাবকদের মন জিতেছে ছাত্রলীগ

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, শোকের মাসের আগ মুহূর্তে বা শোকের মাসের শুরুর দিনে কমিটি গঠন করা এবং বর্ধিত কমিটির চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে উৎসব করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আগস্ট মাস শুরুর মুহূর্তে কমিটি দেওয়ার মানে হচ্ছে, তাদের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে যেসব অনিয়ম হয়েছে সেগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য শোকের মাসকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা। তারা মনে করেছেন, কমিটি গঠনে যতই অনিয়ম হোক শোকের মাসে কেউ এর প্রতিবাদ করবে না।

‘আমরা অতীতেও দেখেছি সারা বছর তাদের (জয়-লেখক) কোনো খবর থাকে না। ঠিক সম্মেলনের আগে তাড়াহুড়া করে ৮-১০টা করে কমিটি দিয়ে দেয়। এবারও তারা সেটা করেছে। গঠনতন্ত্র না মেনে নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো তারা ছাত্রলীগকে চালাচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক।’

আরেক সহ-সভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছাত্রলীগের কমিটি গঠনতন্ত্র মেনেই করতে হয়। কিন্তু বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক সেটা মানছেন না। ৩১ জুলাই রাতে হুটহাট করে যেসব কমিটি দেওয়া হয়েছে সেগুলো সম্পূর্ণ অবৈধ। আমরা যারা গঠনতন্ত্র চর্চা করি, আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি যে গঠনতন্ত্রই হচ্ছে ছাত্রলীগের পরিচালনার চালিকাশক্তি। শোকের মাস আগস্ট-এর প্রাক্কালে কমিটি গঠনের মাধ্যমে আনন্দ-উৎসবের যে বিষয়টি এসেছে তা খুবই দুঃখজনক। এটা আমাদের নৈতিকতার সঙ্গে যায় না।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তাদের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

এইচআর/এমএআর/