বস্তি উদ্ধারের অস্ত্র কি আগুন?
রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে একটি কালশীর তালতলা খিচুড়িপট্টি বস্তি। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর দুপুরে আগুনে পুড়ে যায় বস্তিটির বেশ কয়েকটি ঘর। প্রায় দেড় ঘণ্টার চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। যখন আগুন লাগে, তখন রিকশাচালক স্বামী শরিফুলসহ বাইরে ছিলেন বস্তির বাসিন্দা গার্মেন্টকর্মী মরিয়ম। খবর পেয়ে ফিরে আসলেও ততক্ষণে সবকিছু পুড়ে ছাই। ওই আগুনে এমন হাজারও মরিয়ম-শরিফ দম্পতি হারিয়েছেন তাদের শেষ আশ্রয়টুকু।
শুধু খিচুড়িপট্টি নয়, গত এক বছরে জাদুর শহর ঢাকার বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে ১০৯ বার। ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া তথ্যমতে, বছরটিতে বস্তিতে লাগা আগুনে ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ১৬ লাখ ২৩ হাজার ৭৯৮ টাকা। উদ্ধার হয়েছে ১৬ কোটি ৫৬ লাখ ১৪ হাজার ৩৫৬ টাকার সম্পদ।
বিজ্ঞাপন
বস্তির বাসিন্দাদের অভিযোগের আঙুল স্থানীয় কাউন্সিলর সলিমুল্লাহর দিকে। তারা বলছেন, প্রায়ই তিনি বস্তি ছেড়ে চলে যেতে বলতেন। এর আগেও একবার বুলডোজার দিয়ে বস্তি গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এমনকি বস্তির জমি বেচা-কেনার ঘটনাও ঘটেছে
সর্বশেষ রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক ১২ নম্বর রোডের বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। গতকাল সোমবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাতের আগুনের ওই ঘটনার আগের দিন রোববার (২১ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে রাজধানীর মানিকনগর কুমিল্লাপট্টি বস্তিতে আগুন লাগে। এ দুই ঘটনায় প্রাণহানি না হলেও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয় বলে ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়।
কিছুদিন পরপরই রাজধানীর বস্তিতে কেন আগুন লাগে? এমন প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে। বিশেষ করে গত বছরের নভেম্বরে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পৃথক তিন বস্তিতে আগুন লাগায় সন্দেহের তীর আরও জোরালো হয়।
বস্তি উচ্ছেদ করা কিংবা আগুনের ঘটনায় আমি কেন ইন্ধন দিতে যাব? মানুষের পাশে থাকাই আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে
কাউন্সিলর সলিমুল্লাহর, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
গত ২৩ নভেম্বর রাতে সাততলা বস্তিতে আগুন লাগার ১৬ ঘণ্টার ব্যবধানে আগুন লাগে মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লায়। সেখানকার আগুন নিভতে না নিভতেই ওইদিন রাত আড়াইটার দিকে আগুন লাগে মিরপুরের বাউনিয়াবাদ এলাকার বস্তিতে। পুড়ে যায় শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট। বস্তিবাসীদের অনেকেই মনে করেন, পরিকল্পিতভাবেই লাগানো হয় আগুন।
মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লার আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হন সেখানকার বাসিন্দা আবদুল খালেক। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে সরকারি জমিতে বস্তিটি গড়ে ওঠে। এরপর অনেকবার উচ্ছেদ করে সরকারি জমি উদ্ধার বা দখলের চেষ্টা হয়েছে। আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায়, পুনর্বাসন ছাড়া জমি উদ্ধারের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে সরকার।
বস্তির বাসিন্দাদের অভিযোগের আঙুল স্থানীয় কাউন্সিলর সলিমুল্লাহর দিকে। তারা বলছেন, প্রায়ই তিনি লোকমারফত বস্তি ছেড়ে চলে যেতে বলতেন। এর আগেও একবার বুলডোজার দিয়ে বস্তি গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এমনকি বস্তির জমি বেচা-কেনার ঘটনাও ঘটেছে।
গত এক বছরে জাদুর শহর ঢাকার বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে ১০৯ বার। ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া তথ্যমতে, বছরটিতে বস্তিতে লাগা আগুনে ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ১৬ লাখ ২৩ হাজার ৭৯৮ টাকা। উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ১৬ কোটি ৫৬ লাখ ১৪ হাজার ৩৫৬ টাকার সম্পদ
অবশ্য এ ধরনের অভিযোগ আমলে নেননি সলিমুল্লাহ। তিনি বলেন, বস্তি উচ্ছেদ করা কিংবা আগুনের ঘটনায় আমি কেন ইন্ধন দিতে যাব? মানুষের পাশে থাকাই আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
গত বছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে মনে করেন বাসিন্দারা। জায়গাটির মালিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০১০ সাল থেকে এ জমিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি কমপ্লেক্স গড়ার চেষ্টা করলেও উচ্ছেদের চেষ্টা করেনি।
বস্তিকেন্দ্রিক পলিটিক্যাল ইকোনমি আছে। আগের বাস্তবতা এখন আর নেই। এখন বস্তিতে ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়। বস্তিতে আগুনের ক্ষেত্রে জমির দখল, ওনারশিপ (মালিকানা) নিয়ে দ্বন্দ্ব কাজ করে। সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারার বিষয় তো আছে
পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান, সাধারণ সম্পাদক, বিআইপি
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের ডিসেম্বরেও মহাখালীর সাততলা বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রতিবারই বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগ এবং দুর্বল তারের (ক্যাবল) কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২১ হাজার ৭৩টি। ছোট আগুন হওয়ায় ফায়ার সার্ভিসকে কাজ করতে হয়নি ৬১৭৩টি অগ্নিকাণ্ডে। তবে সবমিলিয়ে আগুনে ক্ষতির পরিমাণ ২৪৬ কোটি ৬৫ লাখ, ৯৫ হাজার ৪৪ টাকা। ফায়ার সার্ভিসের চেষ্টায় ও আগুন নির্বাপণের কারণে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ১৪২৬ কোটি ১৮ লাখ ৪০ হাজার ৯৩৯ টাকার সম্পদ।
বিদায়ী বছরে আগুন লাগার প্রধান কারণ হিসেবে স্থান পেয়েছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ। বৈদ্যুতিক গোলযোগে কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৭ হাজার ৭২৯টি। যা মোট অগ্নিকাণ্ডের ৩৬.৬৮ শতাংশ। এতে ক্ষতি হয়েছে ১০১ কোটি ২৩ লাখ ৯৩ হাজার ১০৮ টাকার মালামাল।
সরকার এখানে সোশ্যাল আবাসন বা জন-আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। তাহলে মানহীন বৈদ্যুতিক, গ্যাসের সংযোগ কিংবা চোরাই সংযোগ বন্ধ হবে। পাশাপাশি সরকারেরও রাজস্ব আয় হবে
পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান, সাধারণ সম্পাদক, বিআইপি
দ্বিতীয় শীর্ষ কারণ চুলার আগুন। চুলার (ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটির চুলা) কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে তিন হাজার ৫৬৪টি। যা মোট অগ্নিকাণ্ডের ১৬.৯১ শতাংশ। এতে ক্ষতি হয়েছে ৩০ কোটি ৯৫ লাখ ৫৬ হাজার ৮৫০ টাকার সম্পদ।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে প্রধান কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ, চুলার আগুন ছাড়াও রয়েছে সিগারেটের আগুন আর সিলিন্ডার বিস্ফোরণ।
গত ২৩ নভেম্বর রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে লাগা আগুনে পুড়ে যায় ৬০টি ঘর। যার অধিকাংশই দোকান। তখন আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেছিলেন, অবৈধ বৈদ্যুতিক লাইনের শর্ট সার্কিট থেকে সাততলা বস্তিতে আগুন লাগে। তাছাড়া সরু পথ ও পানির উৎসের অপ্রতুলতার কারণে আগুন নেভাতেও বেগ পেতে হয়।
রহস্য থেকে যাচ্ছে প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে। একাধিক তদন্ত কমিটি হয়, কিন্তু রহস্যজনক কারণে কোনোটি আলোর মুখ দেখে না। মানুষ এসব কারণে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে
রাশেদ খান মেনন, সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি
এদিকে কড়াইল, কালশী, কালশী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বাউনিয়াবাদের বস্তিসহ রাজধানীর বিভিন্ন বস্তিতে কয়েকদিন পরপর অগ্নিকাণ্ড নিছক দুর্ঘটনা নাকি উদ্দেশ্যমূলক, তা তদন্ত করে প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)।
এ বিষয়ে ন্যাপ মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগুন পিছু ছাড়ছে না অসহায় বস্তিবাসীর। নিঃস্ব হচ্ছেন মানুষ। সব হারিয়ে বস্তিবাসী যখন কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন, তখনই ফের সব পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় আগুন। ক্ষুধার আগুন নেভাতে গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বস্তিতে বারবার সর্বগ্রাসী আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হতে হচ্ছে তাদের। যার দায় কেউ নেয় না।
তিনি বলেন, কয়েকদিন পরপর বস্তিতে এ অগ্নিকাণ্ড নিছক দুর্ঘটনা, নাকি উদ্দেশ্যমূলক; তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। দেশের বেশিরভাগ বস্তি সাধারণত সরকার বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পরিত্যক্ত জমিতে গড়ে ওঠে। অনেক সময় মালিক জমি খালি করার জন্য নিজেই বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেন। এমন ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। তাই সরকারের উচিত তদন্ত করে অগ্নিকাণ্ডের আসল রহস্য বের করা। পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের সহায়তায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সিটি করপোরেশনকে এগিয়ে আসতে হবে।
২০২০ সালে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২১ হাজার ৭৩টি। সবমিলিয়ে আগুনে ক্ষতির পরিমাণ ২৪৬ কোটি ৬৫ লাখ, ৯৫ হাজার ৪৪ টাকা। উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ১৪২৬ কোটি ১৮ লাখ ৪০ হাজার ৯৩৯ টাকার সম্পদ
এ বিষয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘ষড়যন্ত্র কি-না জানি না। তবে আগুন দিয়ে বস্তি উচ্ছেদ বোকামি। রাষ্ট্র বা অন্যকোনো পক্ষ এমন কাজে ইন্ধন দিলে, এতে গণমানুষের আস্থা কমে যাবে। সাধারণ মানুষের জন্যই রাষ্ট্র। তাদের অধিকার হরণ করে রাষ্ট্র ভালো থাকতে পারে না।
মেনন বলেন, ‘বস্তিবাসী রাষ্ট্রেরই মানুষ। অথচ আগুনে বারবার তারাই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। আর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে আগুন দিয়ে সমাধান করতে চাইলে ফলাফল ভালো হয় না, বরং ক্ষোভ বাড়ে। কিন্তু এখন তা-ই হচ্ছে। রহস্য থেকে যাচ্ছে প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে। একাধিক তদন্ত কমিটি হয়, কিন্তু রহস্যজনক কারণে কোনোটি আলোর মুখ দেখে না। মানুষ এসব কারণে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বস্তিকেন্দ্রিক পলিটিক্যাল ইকোনমি আছে। আগের বাস্তবতা এখন আর নেই। এখন বস্তিতে ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়। বস্তিতে আগুনের ক্ষেত্রে জমির দখল, ওনারশিপ (মালিকানা) নিয়ে দ্বন্দ্ব কাজ করে। সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারার বিষয় তো আছেই। বস্তি থেকে আয় করা টাকার ভাগ অনেকেই পান।
‘দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারও নেই’— মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বস্তিতে আগুন লাগলেও আমরা কখনও নির্মোহ তদন্ত পাই না। আগুনের কারণ কী, আগুন কীভাবে লেগেছে, নাকি কেউ লাগিয়েছে— তা আর জানা যায় না। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর উদ্যোগ জরুরি।’
তিনি বলেন, পুনর্বাসন ছাড়া আগুন দিয়ে কিংবা উচ্ছেদের নামে বস্তিবাসীকে সরিয়ে দখলের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকার এখানে সোশ্যাল আবাসন বা জন-আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। তাহলে মানহীন বৈদ্যুতিক, গ্যাসের সংযোগ কিংবা চোরাই সংযোগ বন্ধ হবে। পাশাপাশি সরকারেরও রাজস্ব আয় হবে। সাধারণ মানুষগুলোর জীবনও নিরাপদ হবে। এজন্য দরকার নীতিগত পরিকল্পনা।
জেইউ/এমএইচএস/এমএআর