রোগী মারা যাওয়া পর্যন্ত কমিশন ঢোকে তাদের পকেটে
রোগী গুরুতর অসুস্থ। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) নিতে হবে এখনই। কিন্তু আইসিইউ খালি নেই। আইসিইউর জন্য দেওয়া হয় সিরিয়াল। দিনের পর দিন যায়, সপ্তাহও পার হয়ে যায়, মেলে না আইসিইউ। এ পর্যায়ে চিত্রনাট্যে হাজির হন তারা; বলেন, ‘ব্যবস্থা’ আছে। এই ‘তারা’ হলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের কর্মচারী আর বহিরাগত দালাল।
‘দ্রুত নিতে হবে, না হয় রোগী মারা যাবে’— এমন ভয় দেখিয়ে তারা রোগী ভাগিয়ে নেন বেসরকারি হাসপাতালে। ওই রোগী যতক্ষণ সেই হাসপাতালে থাকবে ততক্ষণ তাদের পকেটে ঢুকতে থাকবে কমিশনের টাকা। রোগী সুস্থ হোক বা মারা যাক, ছাড়পত্র নেওয়ার আগ পর্যন্ত চলতে থাকে এ প্রক্রিয়া। ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
বিজ্ঞাপন
‘দ্রুত নিতে হবে, না হয় রোগী মারা যাবে’— এমন ভয়ভীতি দেখিয়ে তারা রোগী ভাগিয়ে নেন বেসরকারি হাসপাতালে। ওই রোগী যতক্ষণ সেই হাসপাতালে থাকবে ততক্ষণ তাদের পকেটে ঢুকতে থাকবে কমিশনের টাকা। রোগী সুস্থ হোক বা মারা যাক, ছাড়পত্র নেওয়ার আগ পর্যন্ত চলতে থাকে এ প্রক্রিয়া। ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন তথ্য
সর্বশেষ ভরসা হিসেবে সারা দেশ থেকে মুমূর্ষু রোগীদের নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এদের মধ্যে অধিকাংশেরই আইসিইউ সাপোর্টের দরকার হয়। কিন্তু হাসপাতালে নেই পর্যাপ্ত আইসিইউ শয্যা। এ কারণে দরকার হলেও প্রায়ই আইসিইউ শয্যা পান না রোগীরা।
বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলে ৮৬টি আইসিইউ এবং ৩০টি হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) রয়েছে। এর মধ্যে নন-কোভিড আইসিইউ ৩২টি, কোভিড আইসিইউ ১০টি, নবজাতকের জন্য এনআইসিইউ ৩৮টি এবং পেডিয়াট্রিক (শিশু) আইসিইউ আছে ছয়টি।
এ সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। হাসপাতালের একটি অসাধু চক্র এ সংকট কাজে লাগিয়ে মোটা অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে রোগীদের পাঠিয়ে দেয় বেসরকারি হাসপাতালে। চক্রে জড়িত আছে বহিরাগত কিছু দালাল, সরকারি-বেসরকারি আম্বুলেন্সচালক, ঢামেকের কর্মচারী, আনসার সদস্য, ওয়ার্ড বয় ও ট্রলিম্যান।
আরও পড়ুন >> ঢামেকে ‘টাকা আছে সিট আছে, টাকা নাই বেরিয়ে যান’
জানা গেছে, মুমূর্ষু রোগী হাসপাতালে আসার পর তার স্বজনদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানোর প্রথম উদ্যোগটা নেন ঢামেকের বিভিন্ন ওয়ার্ডের কর্মচারীরা। এছাড়া বহিরাগত দালালরা ২৪ ঘণ্টা শিফটিং ভিত্তিতে ডিউটি করে রোগী স্থানান্তরের কাজটি করেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায়ই আইসিইউ সংকট দেখা যায়। বর্তমানে সেখানে ৮৬টি আইসিইউ এবং ৩০টি হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) রয়েছে। এর মধ্যে নন-কোভিড আইসিইউ ৩২টি, কোভিড আইসিইউ ১০টি, নবজাতকদের জন্য এনআইসিইউ ৩৮টি এবং পেডিয়াট্রিক আইসিইউ আছে ছয়টি। এ সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম
ঢামেকে আসা অধিকাংশ রোগী নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। চক্রের সদস্যরা এসব রোগীকে টার্গেট করেন। প্রথমে তারা রোগী সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহ করেন। রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হলে ‘ঢামেকে আইসিইউ শয্যা পেতে মাসখানেক সময় লেগে যাবে’— এমন তথ্য দিয়ে তাদের বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। অ্যাম্বুলেন্সেরও ব্যবস্থা করেন তারা। রোগীপ্রতি অ্যাম্বুলেন্সচালক বিশেষ কমিশন পান। যতদিন রোগী ওই হাসপাতালে থাকবে দৈনিক অন্তত দুই হাজার করে টাকা পকেটে ঢুকবে তার।
অন্যদিকে, যে দালাল রোগী পাঠাবেন, হাসপাতাল বিলের ৪০ শতাংশ পাবেন তিনি। ঢামেকের কোনো কর্মচারী যদি রোগী পাঠান, প্রাথমিকভাবে তাকে হাসপাতাল থেকে দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়। অনেক সময় রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে আট থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত পকেটে ঢোকে তার।
কমিশনের এ ব্যবসায় দালালরা ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। রোগী পাঠানোর সময় তারা স্বজনের মোবাইল নম্বর রেখে দেন। নিয়মিত তারা রোগীর খোঁজখবর নেন। কত দিন হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে, কবে ছাড়া পাবেন, ছাড়া পেয়েছেন কি না— এসব তথ্য নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তারা তাদের প্রাপ্য অর্থ বুঝে নেন।
যে দালাল রোগী পাঠাবেন, হাসপাতাল বিলের ৪০ শতাংশ পাবেন তিনি। ঢামেকের কোনো কর্মচারী যদি রোগী পাঠান, প্রাথমিকভাবে তাকে হাসপাতাল থেকে দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়। অনেক সময় রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে আট থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত পকেটে ঢোকে তার
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দালালরা রোস্টার ভিত্তিতে ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করেন ঢামেকে। তাদের তৎপরতা বেশি দেখা যায় ঢামেকের ২১১ (সদ্য ভূমিষ্ঠ নবজাতক), ২১২ (গাইনি বিভাগ) ও ৯৮ (অধিকাংশ দুর্ঘটনার রোগী) নম্বর ওয়ার্ডে।
যাদের পকেটে ঢুকতে থাকে টাকা
দীর্ঘ তিন মাসের অনুসন্ধানে অসাধু এ চক্রের (দালাল ও ঢামেক কর্মচারী) সদস্যদের অনেকের নাম-পরিচয় জানতে পেরেছে ঢাকা পোস্ট। বিভিন্ন সময় ঢামেক কর্তৃপক্ষও তাদের নিয়ে তদন্ত করেছে। যাদের নাম জানা গেছে তারা হলেন- ঢামেকের হান্নান গ্রুপের কাওসার, দুলাল ওরফে ‘ভেজাইল্লা দুলাল’, রুবেল, মজনু, কবির, সাইমন, শামীম, নাসির, উজ্জ্বল, সবুজ, অপু, ভাগ্নে শরীফ ও রব।
আরও পড়ুন >> বদলে যাচ্ছে ঢামেকের বহির্বিভাগ
এছাড়া ট্যাক্সি কাশেম গ্রুপের ট্যাক্সি কাশেমের ভাই হুজুর মনির, ট্যাক্সি কাশেমের ভায়রা বিল্লাল, ১০০ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়ার্ড বয় সেলিম, খাইরুল ইসলাম, মোমিন গ্রুপের রুবেল, সজল, বিপ্লব, কবির, ২১১নং ওয়ার্ডের আনসার সদস্য স্বপন; হেদায়েতুল্লাহ সরকার গ্রুপের রিপন, বাবু (সুইপার), বিপ্লব, পিচ্চি খলিল ও শরিফ, ২১১নং ওয়ার্ডের সরকারি স্টাফ মনির ও রাজিব; ওয়াহিদ মুরাদ গ্রুপের মনছুর (২১২নং ওয়ার্ডের সরকারি স্টাফ) ও সোহাগ; শুভ গ্রুপের সাবিদ, শাওন ও মাহি।
সরকারি ড্রাইভার জলিল, খোকন, কাজল, বাবু, ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের ব্রাদার মিশর, হান্নান, এইচ এম মহিউদ্দিন, রায়হান হোসেন রনি, এনামুল হক, ‘গামছা শাহ আলম’, রমজান, সৌরভ, শিহাব, খলিল, জান্নাত, ‘পেট মোটা খলিল’, হানিফ, আলামিন, বিল্লাল, কামাল, পলাশ (সরকারি স্টাফ), কালাম মিয়াজী, রহমত মিয়াজী (সরকারি স্টাফ), আক্তার (ট্রলিম্যান), রমজান (চতুর্থ তলা আইসিইউ), ‘দেড়শ ইমন’, ‘চুইল্লা কাশেম’, ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডের সেলিম, রনি, রুবেল, শাওন, হামিদুর রহমান (সরকারি স্টাফ, বর্তমানে বাগানে ডিউটি), রানা, শিপন (ওটি), রাজিব (সরকারি স্টাফ), সর্দার স্বপন (২১২নং ওয়ার্ড) ও সর্দার মিন্টু, ২০২ নম্বর ওয়ার্ডের খোকন মিয়া (সরকারি স্টাফ), ২০৪ নম্বর ওয়ার্ডের তুহিন, ইমরান, আফসানা, পারভীন, আজিম, জুয়েল, সুমনা আক্তার আসমা, ২০৭ নম্বর ওয়ার্ডের সোহেল ও ২০০ নম্বর ওয়ার্ডের ফরহাদ।
আরও পড়ুন >> সব রোগী থেকেই অর্থ নেন ঢামেক সার্জন পীযূষ!
অসাধু এ চক্রের অধিকাংশের বিরুদ্ধে ঢামেক পরিচালকসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিভিন্ন সময়ে নানা অভিযোগ জমা হয়েছে। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র ঢাকা পোস্টের হাতে আছে।
এ প্রসঙ্গে ঢামেক হাসপাতালের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ঢামেকের অধিকাংশ কর্মচারী দীর্ঘদিন একই ওয়ার্ডে আছেন। এ কারণে তারা আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ পান। দালালদের সঙ্গেও তাদের একটা সখ্য গড়ে ওঠে। ঢামেক থেকে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার ঘটনা এখন ওপেন সিক্রেট। চিহ্নিত দালালদের সঙ্গে হাসপাতালের স্টাফ, সরকারি-বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সচালকদের যোগসাজশে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে।
মহিউদ্দিন নামে একজন রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যান বাংলাদেশ ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে। ধানমন্ডি ২৭-এর ‘হসপিটাল ২৭ প্লাস’-এ রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার কাজ করেন সৌরভ। নিজেকে তিনি ওই হাসপাতালের এমডির ছোট ভাই হিসেবে পরিচয় দেন। জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল থেকে বর্তমানে এ হাসপাতালে বেশি রোগী যাচ্ছে
র্যাব কয়েকবার অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন দালালকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড দিয়েছে। জেল থেকে বেরিয়ে এসে আবারও একই কাজ করছে তারা। তবে, এ চক্রের মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়— জানান ওই কর্মকর্তা।
ঢামেক কর্মচারীদের ‘কিনে রেখেছে’ যেসব হাসপাতাল
ঢামেক থেকে সাধারণত যেসব বেসরকারি হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া হয় সেগুলোর মধ্যে অনেক হাসপাতালের নাম জানতে পেরেছে ঢাকা পোস্ট।
আরও পড়ুন >> ঢামেকে ৩০ দালালকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড
এর মধ্যে আছে ধানমন্ডি উইমেন্স চিলড্রেন হাসপাতাল, চাঁনখারপুলের রয়েল কেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা জেনারেল হাসপাতাল, মোহাম্মদপুরের ইস্টার্ন কেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা হেলথ কেয়ার হাসপাতাল, ধোলাইপাড় ডেল্টা হাসপাতাল, ধানমন্ডি জেনারেল অ্যান্ড কিডনি হাসপাতাল, রেমেডি কেয়ার হাসপাতাল, আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল (শ্যামলী), ধানমন্ডি নিউ লাইফ হাসপাতাল, আইসিইউ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, পান্থপথের ইউনিহেলথ হাসপাতাল, রিলায়েন্স হাসপাতাল (গ্রিন রোড), মাদার কেয়ার (ধানমন্ডি ২৭), হসপিটাল ২৭ প্লাস, ঢাকা ট্রমা সেন্টার (শ্যামলী), রাশমনো স্পেশালিস্ট হাসপাতাল (মগবাজার ওয়ারলেস গেট), প্রশান্তি হাসপাতাল (রাজারবাগ), কিওর স্পেশালিস্ট হাসপাতাল, বিওসি হাসপাতাল (পান্থপথ), মদিনা হাসপাতাল (যাত্রাবাড়ী), ফ্রেন্ডশিপ স্পেশালিস্ট হাসপাতাল (মাতুয়াইল), প্রো অ্যাকটিভ হাসপাতাল (সাইনবোর্ড), রেনেসাঁ হাসপাতাল (ধানমন্ডি জিগাতলা) ও বিএনকে হাসপাতাল (শান্তিবাগ)।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রেমেডি কেয়ার হাসপাতালে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার কাজ করেন আনিস রহমান। এ কাজের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি। গভীর রাতে তিনি এ কাজ করেন। এজন্য তিনি নিজেই ঢাকা মেডিকেলে যান এবং দালালদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। তার রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার প্রমাণ আছে ঢাকা পোস্টের কাছে।
একইভাবে মহিউদ্দিন নামে একজন রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যান বাংলাদেশ ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে। ধানমন্ডি ২৭-এর ‘হসপিটাল ২৭ প্লাস’-এ রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার কাজ করেন সৌরভ। নিজেকে তিনি ওই হাসপাতালের এমডির ছোট ভাই হিসেবে পরিচয় দেন। জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল থেকে বর্তমানে এ হাসপাতালে বেশি রোগী যাচ্ছে।
এছাড়া হেদায়েতুল্লাহ সরকার ও মোমিন রোগী পাঠান ডেল্টা, ইউনিহেলথ ও বিওসি হাসপাতালে।
রোগীর স্বজন সেজে ‘হসপিটাল ২৭ প্লাসে’ ফোন
‘সদ্য নবজাতকের অবস্থা ভালো নয়, এনআইসিইউ লাগবে’— এ কথা বলে ঢামেকে থাকা রোগীর স্বজন সেজে ফোন দেওয়া হয় ধানমন্ডির ‘হসপিটাল ২৭ প্লাস’-এর অন্যতম পরিচালক (এমডির ছোটভাই দাবিদার) মো. সৌরভকে। তাকে ফোনে বলা হয়, ‘২১১নং ওয়ার্ডের একজন সরকারি স্টাফ আপনার মোবাইল নম্বর দিয়েছেন। আমার রোগীর অবস্থা খারাপ, নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তার জন্ম হয়েছে।’
অপর প্রান্ত থেকে সৌরভ বলেন, ‘আমাদের এনআইসিইউ ফাঁকা আছে। প্রতিদিনের ভাড়া চার হাজার টাকা। ৫০০ টাকা ডিসকাউন্ট দিয়ে সাড়ে তিন হাজার রাখা হবে। তবে ডাক্তার খরচ, কিছু ইনভেস্টিগেশন আছে, এগুলো মিলে প্রতিদিন সাড়ে সাত হাজার টাকা খরচ পড়বে। তিনি বাচ্চার মায়ের নাম জানতে চান। সেটাও তাকে বলা হয়। তিনি বলেন, ‘আপনি বললে আমরা অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগী আনার ব্যবস্থা করতে পারি।’
এই ফোনালাপে পরিষ্কার হয় এভাবে ঢাকা মেডিকেল থেকে রোগী ভাগিয়ে নেয় ‘হসপিটাল ২৭ প্লাস’। এক্ষেত্রে এখন প্রধান ভূমিকা রাখেন দালাল মো. সৌরভ।
তিনদিন পর সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আবারও ফোন দেওয়া হয় সৌরভকে। এ সময় সৌরভ তার কথা বদলে ফেলেন। প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন, ‘আমার আইএলটিএসে ফাইভ পয়েন্ট ফাইভ আসছে, দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি।’
ঢাকা মেডিকেল থেকে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সৌরভ দাবি করেন, ‘বর্তমানে আমাদের এখানে ঢাকা মেডিকেল থেকে কোনো রোগী আসে না। আমরা আর গরিব রোগীদের ভর্তি করি না। ঢাকা মেডিকেলেও যাই না।’
‘অনেক আগে থেকেই ঢাকা মেডিকেল থেকে রোগী আনা বাদ দিয়েছি। যেহেতু আমরা ব্যবসা করি, বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের এখানে রোগী আসে। দেশের সব বড় বড় হাসপাতালেই বিভিন্ন মাধ্যমে রোগী আসে’- বলেন সৌরভ।
ঢাকা মেডিকেলের সরকারি স্টাফ, অ্যাম্বুলেন্সচালক ও আনসারদের কমিশন দেওয়ার মাধ্যমে আপনাদের ওখানে রোগী যায়- এমন অভিযোগ আছে। এ ব্যাপারে কী বলবেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা এসব ব্যবসা আর করি না।’
চারদিনের বিল ৪৯ হাজার টাকা
ঢামেক হাসপাতালের এনআইসিইউর সামনে কথা হয় সুমাইয়া বেগম নামে ভুক্তভোগী এক রোগীর স্বজনের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘আমার ভাইয়ের মেয়ে রাজধানীর একটি হাসপাতালে জন্ম নিয়েছে। নবজাতকের শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেওয়ায় তাকে এনআইসিইউতে রাখার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। রাতে প্রথমে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে এনআইসিইউ ফাঁকা ছিল না। এরপর ঢামেকে আনা হয়।’
‘দায়িত্বরত চিকিৎসক জানান, এনআইসিইউ ফাঁকা নেই। সিরিয়াল দেন। এনআইসিইউ না পাওয়া পর্যন্ত ওয়ার্ডে থাকতে হবে। তিনদিনেও এনআইসিইউ না পাওয়ায় ওয়ার্ডের এক স্টাফ ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে পাঠান। সেখানে চারদিনে ৪৯ হাজার টাকা বিল দিতে হয়েছে আমাদের।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, ঢামেক হাসপাতালে সদ্য নবজাতক শিশুদের জন্য ৩৮টি এনআইসিইউ আছে। যা রোগীর সংখ্যার তুলনায় অনেক কম। এ সুযোগে এখানে দায়িত্বরত স্টাফ ও আনসারদের মাধ্যমে দালালরা অন্যত্র রোগী পাঠিয়ে দেন। ‘কম টাকায় ভালো চিকিৎসা পাবেন’ বলে রোগীর স্বজনদের ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে কাজটি করেন তারা। তাদের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সচালকরাও জড়িত।
অ্যাম্বুলেন্সচালকদের মাধ্যমে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. বাবুল দেওয়ান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা মেডিকেল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে অনেকে বেসরকারি হাসপাতালে রোগী নিয়ে যান। যেহেতু আমি একটি সংগঠনে আছি সেহেতু আমি কারও নাম বলতে পারছি না। আপনি নিজে তদন্ত করে দেখুন, অনেকের নাম জানতে পারবেন।
আইসিইউ না পাওয়ায় দালাল চক্রের মাধ্যমে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হকের কাছে। তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
তবে, ঢামেকে আইসিইউর চাহিদা বেশি জানিয়ে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি (ঢামেক) একটি টারশিয়ারি লেভেল হসপিটাল। এখানে ২৬০০ রোগী থাকার কথা। বর্তমানে এখানে ৩৫০০ থেকে ৪০০০ রোগী ভর্তি আছে। প্রতিদিন সারা দেশ ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে এসে এখানে তিন থেকে চারশ রোগী ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে অনেকের আইসিইউর প্রয়োজন হয়।
‘হাসপাতালে নন-কোভিড আইসিইউ আছে মাত্র ৩২টি। রোগীর সংখ্যার তুলনায় এটি খুবই অপ্রতুল। আমরা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। বিভিন্নভাবে আমরা আইসিইউর সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আশা করছি, এ বছরই ১০০ শয্যার আইসিইউর ব্যবস্থা করতে পারব।’
নাজমুল হক বলেন, প্রতিনিয়ত এখানে আইসিইউর জন্য গুরুতর অসুস্থ রোগী আসে। ধরুন, আমাদের এখানে আইসিইউতে নেওয়ার জন্য পাঁচজন রোগী আছেন। কিন্তু শয্যা খালি আছে একটি। সেক্ষেত্রে আমরা ক্রস ম্যাচ করি। কোনো কোনোদিন একটি বা দুটি, আবার দেখা যায় এক সপ্তাহেও কোনো শয্যা ফাঁকা হয় না।
‘আমাদের হাসপাতালে যারা ভর্তি হন, তাদেরই অগ্রাধিকার দিই। যদি কখনো আইসিইউতে যাওয়ার মতো রোগী না থাকে সেক্ষেত্রে আমরা বাইরের রোগী ভর্তি করি। এখন আইসিইউ সেবা নিশ্চিতে শয্যা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই’- বলেন ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক।
এসএএ/এআর/