অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রিতায় আলোর মুখ দেখছে না বঙ্গভ্যাক্স
গেল বছরের মাঝামাঝি প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের থাবায় গোটা বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত, বাংলাদেশি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস গ্রুপ অব কোম্পানিজ লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড তখন এই ভাইরাসের টিকা তৈরির ঘোষণা দিয়ে চমক দেয়। এরপর দেখতে দেখতে প্রায় ৮ মাস কেটে গেছে, কিন্তু সেই টিকা আর আলোর মুখ দেখেনি, কবে দেখবে তাও জানে না কেউ।
এরইমধ্যে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কার করা এবং ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি করা টিকা বাংলাদেশে প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সহস্রাধিক হাসপাতালে একযোগে শুরু হয় গণ-টিকাদানের এই কর্মসূচি। তারও আগে গত ১৭ জানুয়ারি গ্লোব বায়োটেক উদ্ভাবিত টিকা বঙ্গভ্যাক্সের মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানোর জন্য বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলে (বিএমআরসি) আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। আবেদনের এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি বিএমআরসি কর্তৃপক্ষ।
বিজ্ঞাপন
এ প্রসঙ্গে বিএমআরসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এথিক্যাল অনুমোদনের বিষয়টা এখন এথিক্যাল কমিটির কাছে। তারা একটি মিটিং করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে মিটিং কবে হবে সে বিষয়ে তারা আমাকে কিছু জানায়নি। এখানে বিএমআরসি চেয়ারম্যান হিসাবে আমার বা ডিরেক্টরের কোনো রোল (ভূমিকা) নেই।’
এদিকে এথিক্যাল কমিটির সদস্য ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অনুমোদন নিয়ে এথিক্যাল কমিটির মিটিং হবে। মিটিংয়ে অনেক সদস্য আছে, সভাপতি আছে, সেখানেই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। মিটিং এখনও কল করেনি, কল করলে বলতে পারবো, এখন তো কিছু বলা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘এথিক্যাল কমিটির মিটিং কল করেন বিএমআরসির চেয়ারম্যান মোদাচ্ছের আলী। হয়তো এটা উনি আপাতত গোপন রাখতে চাচ্ছেন, সেজন্য কিছু বলছেন না। মূলত মিটিং কল করেন চেয়ারম্যান।’
এদিকে বিএমআরসির এই সময়ক্ষেপণ নিয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) সচিবালয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের কাছে উদ্বেগ জানান আবিষ্কারক দলের প্রধান দুই বিজ্ঞানী কাকন নাগ ও নাজনীন সুলতানা। সেসময় তারা বলেন, আজ প্রায় ৩ সপ্তাহ হতে চলল... আমরা বিএমআরসিতে আবেদন জমা দিয়েছি এথিক্যাল ক্লিয়ারেন্সের জন্য। মডার্নার ক্ষেত্রে অনুমোদন পেতে মাত্র চারদিন লেগেছিল, আমাদের এখানে কিন্তু তিন সপ্তাহ হতে চলল। আমরা এখন পর্যন্ত কোনো রেসপন্স জানি না, কখন আপডেট বা অনুমোদন পাবো। এটা পাওয়ার পরপরই আমরা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করতে পারবো।’
তারা বলেন, এর আগে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যে উচ্চ পর্যায়ের টিম গঠন করেছিলেন সায়েন্টিফিক রিভিউ কমিটি, তারা একাধিকবার আমাদের ডাটা অ্যানালাইসিস (তথ্য বিশ্লেষণ) করেছেন। অডিট করে সবকিছু সন্তোষজনক পাওয়া সাপেক্ষে আমাদের জিএমপি লাইসেন্স দিয়েছেন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য টিকা তৈরির অনুমোদন দিয়ে। তার মানে হচ্ছে ,টেকনোলজিক্যালি ও সায়েন্টিফিক্যালি এটা কার্যকরী এবং নিরাপদ। এইটুকু প্রমাণ আমরা পেয়েছি এবং সেই স্বীকৃতি পেয়েছি সরকারের কাছ থেকে।
করোনা ভাইরাস : টাইমলাইন
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম শনাক্ত হয় নভেল করোনা ভাইরাস। ১১ জানুয়ারি করোনা ভাইরাসে প্রথম মৃত্যুর খবর ঘোষণা করে চীন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। জানুয়ারির ২৪ তারিখ ফরাসি কর্তৃপক্ষ ইউরোপে প্রথম করোনা ভাইরাসে একজন আক্রান্ত হওয়ার খবর দেয়। জানুয়ারির ৩০ তারিখ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করে। উহানে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত নিয়ে আসা হয় ১ ফেব্রুয়ারি। ২ ফেব্রুয়ারি চীনের বাইরে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় ফিলিপাইন্সে। চীনের বাইরে প্রথম মৃত্যুর এক বছর পেরিয়ে বিশ্বে করোনায় মৃতের সংখ্যা এখন ২৪ লাখ ৭৯ হাজারের বেশি।
তবে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন বিএমআরসির সদ্য বিদায়ী ও তৎকালীন পরিচালক ডা. মাহমুদ উজ জাহান। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, সময়ক্ষেপণ বা অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না, এটা আসলে ঠিক নয়। একটা টিকা অনুমোদনের ক্ষেত্রে রেগুলেটরি বডি (নিয়ন্ত্রক সংস্থা) অনেকগুলো কমন (সাধারণ) বিষয় দেখে। এখানে ক্লিয়ারেন্সের (অনুমোদন) একটা বিষয় আছে, এথিক্যাল রিভিউয়ের ক্লিয়ারেন্স অবশ্যই দিতে হবে। এটা ছাড়া তো কেউ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে পারবে না। তারা যদি এথিক্যাল ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট না পায়, কিভাবে তারা অনুমোদন পাবে? আপনি একটা টিকা বানালেই এটার কার্যক্ষমতা ও সেফটি না দেখেই তো অনুমোদন দেওয়া যায় না। সুতরাং তাদের এসব অভিযোগ সত্য নয়।’
ডা. মাহমুদ উজ জাহান বলেন, ‘আমি থাকা পর্যন্ত বঙ্গভ্যাক্সের রিভিউ হয়েছে। রিভিউ শেষে ওদের কাছে কিছু বিষয়ে প্রশ্ন (অনুসন্ধান) পাঠানো হয়েছে। আমি থাকা পর্যন্ত ওরা কোনো জবাব দেয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গভ্যাক্স টিকার তো এখনও ফেইজ-১, ফেইজ-২ ট্রায়ালই হয়নি। এগুলো হওয়ার পর আবার ফেইজ-৩ ট্রায়াল হবে। এরপর মার্কেটিংয়ে যাবে। সবমিলিয়ে আসার পর আবার এটা কাজ করবে কি-না, সেগুলো তো ভাবতে হবে। আমাদের তো কিছু ধাপ আছে, এগুলো ছাড়া তো আমরা কাউকে অনুমোদন দিতে পারি না। সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত ১৭০ থেকে ১৮০টা টিকা ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে। তাদের সবগুলোই কি বাজারে এসেছে? বাংলাদেশের বিষয়টা এরকম। তারা মানুষের শরীরে ট্রায়াল দেবে, তারপর সেটা আসবে, এরপর আবার এটা কার্যকরী হবে কি-না... সবগুলো বিষয়ই তো আমাদের দেখতে হবে। ’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাবিষয়ক মুখপাত্র ও অসংক্রামক রোগ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘বঙ্গভ্যাক্সকে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমেই আসতে হবে। এই পদ্ধতি তো সবার জন্য সব জায়গাতে একই। ওরা এখন মাঝামাঝিতে আছে, বিএমআরসি থেকে ট্রায়ালের ক্লিয়ারেন্স পেলে তারা ট্রায়াল দেবে।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গভ্যাক্স তাদের ফেইজ-থ্রি ট্রায়াল করার কথা। এটা পার হয়ে তারা এখনও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেই যেতে পারেনি। এরপরও আরও অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। সবমিলিয়ে মনে হচ্ছে, তাদের আলোর মুখ দেখতে আরও অনেক সময় লেগে যাবে।’
এদিকে, গ্লোব বায়োটেকের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের প্রধান ড. আসিফ মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের যা কাজ ছিল, সবগুলো শেষ করে সিআরও বাংলাদেশের মাধ্যমে আমরা বিএমআরসিতে হিউম্যান এথিক্যাল ট্রায়ালের জন্য আবেদন জমা দিয়েছিলাম। আমরা আশা করছি সহসাই হয়তো হিউম্যান ট্রায়ালের অ্যাপ্রুভালটা হয়ে যাাবে। সেটা হয়ে গেলে ভলান্টিয়ার রিক্রুট করে সিআরও দ্রুততম সময়ে হিউম্যান ট্রায়ালটা শুরু করবে।’
ট্রায়াল কবে নাগাদ শুরু হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম একটা কাজ করতে গেলে একটু দেরি হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তারপরও বিএমআরসির অনুমোদন পেলেই সেটা বলতে পারবো। সিআরও যেটা বলেছে, সব প্রস্তুতি ওনাদের নেওয়া আছে। এথিক্যাল অ্যাপ্রুভাল হলেই আট থেকে দশ দিনের মধ্যেই ট্রায়ালটা শুরু করা যাবে। তবে এর আগে বিএমআরসির অনুমোদনের পরে ওষুধ প্রশাসনে (ডিজিডিএ) আরেকটু যেতে হবে। সেখানে আশা করছি তেমন কোনো সময় লাগবে না। কারণ ডিজিডিএ কিন্তু আমাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য টিকা তৈরির অনুমোদন দিয়েছে। সেক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি পরোক্ষভাবে তারা আমাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে। কারণ ডোজ তৈরির অনুমোদন যেহেতু তারা আমাদের দিয়েছে, তার মানে তাদের দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। ডিজিডিএ সম্মতি দিলেই আমরা ট্রায়াল শুরু করে দেব।’
ট্রায়ালের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘ট্রায়ালটা পুরোপুরি সিআরও করবে। তারা হয়তো তাদের সব প্রস্তুতিই নিয়ে রেখেছে। ওনাদের পিআই ডা. মাহতাব বলেছেন, আমরা অনুমোদন পেলে আট থেকে দশ দিনের মধ্যেই ট্রায়ালটা শুরু করতে পারবো। সেক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব হলো- ট্রায়ালে যে ডোজগুলো লাগবে, সেগুলো আমাদের তৈরি করে দিতে হবে। সেগুলোর অনুমোদন ডিজিডিএ থেকে নেওয়া আছে আমাদের।’
মানবদেহে বঙ্গভ্যাক্সের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের এই গবেষণায় কাজ করবেন ৫৭ জনের একটি দল; যার প্রধান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিএমআরসি থেকে গত সপ্তাহে আমাদের ১৪/১৫টি বিষয়ে কিছু প্রশ্ন দিয়েছে। এগুলোর উত্তরও আমরা দিয়ে দিয়েছি তিন চার দিনের মাথায়। এখন আমরা তাদের রেসপন্সের জন্য অপেক্ষা করছি।’অনুমোদন পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যেই ট্রায়াল শুরু এবং শতাধিক স্বেচ্ছাসেবকের ওপর এটা প্রয়োগের পরিকল্পনা কথাও জানান তিনি।
অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না, এটা ঠিক নয়। তারা যদি এথিক্যাল ক্লিয়ারেন্স না পায়, কিভাবে অনুমোদন পাবে? একটা টিকা বানালেই এটার কার্যক্ষমতা ও সেফটি না দেখেই তো অনুমোদন দেওয়া যায় না
বিএমআরসির সদ্য বিদায়ী পরিচালক ডা. মাহমুদ উজ জাহান
তিনি বলেন, ‘এর আগে আমরা গত মাসের ১৭ তারিখ এথিক্যাল অ্যাপ্রুভালের জন্য প্রটোকল জমা দিয়েছিলাম। তারা দুটি বিষয় করতে পারে, যদি আমাদের প্রটোকলে সন্তুষ্ট হয়, তাহলে আমাদের অনুমোদন দিতে পারে, আর যদি তাদের আরও কোনো প্রশ্ন থাকে তাহলে আমাদের করতে পারে। বিএমআরসি থেকে আমরা অনুমোদন পেলে এরপর আবার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে যাবো। সেখান থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন নিয়ে আমরা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করবো।’
যেভাবে কাজ শুরু করে গ্লোব বায়োটেক
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এই রোগটির জন্য ভ্যাকসিন উন্নয়নের কাজ করতে শুরু করে গ্লোব বায়োটেক। তখন আন্তর্জাতিকভাবে যেসব জেনোম সিকোয়েন্স ছিল, সেগুলো বিশ্লেষণ করে একটি বিশেষ ধরনের মিউটেশনের খোঁজ পান গ্লোব বায়োটেকের বিজ্ঞানীরা। এই মিউটেশনটি হলো D614G । তখন এই মিউটেশনের সংখ্যা খুবই কম ছিল বলে জানিয়েছিলেন গ্লোব বায়োটেকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. কাকন নাগ।
এর আগে ২ জুলাই প্রতিষ্ঠানটি দেশে প্রথম ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ঘোষণা দেয়। সেদিন তারা জানায়, ৮ মার্চ তারা এই টিকা আবিষ্কারের কাজ শুরু করেন। ৫ অক্টোবর গ্লোব জানায়, তারা সফলভাবে প্রাণীদেহে ট্রায়াল সম্পন্ন করেছেন।
টিআই/এনএফ