স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ ওষুধ উৎপাদনে সক্ষম ছিল। বাকি ৮০ শতাংশ ছিল আমদানিনির্ভর। বর্তমানে ওষুধের মোট চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। পাশাপাশি নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে পৃথিবীর ১৫৭টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে বাংলাদেশ।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রপ্তানি করা হয় ৬৪৬ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার টাকার। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে এসে ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৫৭৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকায়। বিষয়টিকে ‘ওষুধ রপ্তানিতে বাংলাদেশের বাজিমাত’ হিসেবে উল্লেখ করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।

২০২০-২১ অর্থবছরে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ওষুধ রপ্তানি করে ৩৫১ কোটি ৮৩ লাখ ২৭ হাজার ৩৪২ টাকার। ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ২০০ কোটি ৬৯ লাখ ২৬ হাজার ৭৪ টাকা, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ১৭৩ কোটি ৮০ লাখ ৮৫ হাজার ৮৪ টাকা, বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস ৭৭ কোটি ৭২ লাখ ৪১ হাজার ৭৫১ টাকা এবং রেনেটা ফার্মাসিউটিক্যালস রপ্তানি করে ১০৬ কোটি ৮৭ লাখ ২১ হাজার ৯১৬ টাকার ওষুধ

২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করে ৮২.৮২ মিলিয়ন ইউএস ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭৩৭ কোটি ৬৫ লাখ ৫৮ হাজার ৭৫৫ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ৮২.৮২ মিলিয়ন ইউএস ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮০০ কোটি ৩০ হাজার ২৭৫ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ১০৩.৬৪ মিলিয়ন ইউএস ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯২৩ কোটি নয় লাখ ৪১ হাজার ১৯০ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ১২৯.৯৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় এক হাজার ১৫৭ কোটি সাত লাখ ৪০ হাজার ৭৩৭ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করে এক হাজার ৪৬১ কোটি ৭২ লাখ ২২ হাজার ৭৭৮ টাকার।

ওষুধ রপ্তানিতে কার কেমন অবস্থান

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ২৯৭ কোটি ৮৮ লাখ ৫৬ হাজার ৯০২ টাকার ওষুধ রপ্তানি করে। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস রপ্তানি করে ১৭৪ কোটি ১৫ লাখ ১০ হাজার ৬১০ টাকার ওষুধ, নিপ্রো জেএমআই ফার্মা লিমিটেড ১৩১ কোটি ১০ লাখ ৮৪ হাজার ২০৭ টাকা, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ১২২ কোটি ৩০ লাখ ৬৩ হাজার ৫৫৮ টাকা এবং একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড ১১৭ কোটি ৬৩ লাখ ৩৮ হাজার ৪১৮ টাকার ওষুধ রপ্তানি করে। সবমিলিয়ে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত দেশ থেকে মোট ওষুধ রপ্তানি হয় এক হাজার ৪৬১ কোটি ৭২ লাখ ২২ হাজার ৭৭৮ টাকার।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রপ্তানি করা হয় ৬৪৬ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার টাকার। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে এসে ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৫৭৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকায়। বিষয়টিকে ‘ওষুধ রপ্তানিতে বাংলাদেশের বাজিমাত’ হিসেবে উল্লেখ করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা

সর্বশেষ গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ওষুধ রপ্তানি করে ৩৫১ কোটি ৮৩ লাখ ২৭ হাজার ৩৪২ টাকার। ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ২০০ কোটি ৬৯ লাখ ২৬ হাজার ৭৪ টাকা, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ১৭৩ কোটি ৮০ লাখ ৮৫ হাজার ৮৪ টাকা, বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস ৭৭ কোটি ৭২ লাখ ৪১ হাজার ৭৫১ টাকা এবং রেনেটা ফার্মাসিউটিক্যালস রপ্তানি করে ১০৬ কোটি ৮৭ লাখ ২১ হাজার ৯১৬ টাকার ওষুধ। সবমিলিয়ে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত দেশ থেকে মোট ওষুধ রপ্তানি হয় এক হাজার ৮০১ কোটি ৫৭ লাখ ৭৩ হাজার ৭৫৭ টাকার।

২০২০-২১ অর্থবছরে এসে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৫৭৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকায় / ফাইল ছবি

অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর ১৫৭টি দেশে ওষুধ রপ্তানি হয়। এর মধ্যে মালয়েশিয়া, চীন, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তানসহ এশিয়া অঞ্চলের মোট ৪৩টি দেশে এবং জার্মানি, ইতালি, রাশিয়া, ফ্রান্সসহ ইউরোপের ৩৮টি দেশে এবং উত্তর আমেরিকার ২৬টি দেশ, দক্ষিণ আমেরিকার ছয়টি, আফ্রিকার ৩৯টি এবং অস্ট্রেলিয়ার পাঁচটি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হয়।

দামে কম, মানেও ভালো

হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান ঢাকা পোস্ট বলেন, এ শিল্পের অগ্রগতি এখন গর্ব করার মতো। বাংলাদেশ শুধু নিজেদের ওষুধ নিজেরাই উৎপাদন করে না বরং বিশ্বের শতাধিক দেশে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি ওষুধ রপ্তানি করে। অথচ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমরা ৭০ শতাংশ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করতাম। এখন দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মানসম্মত ওষুধ রপ্তানি করছে।

২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর ১৫৭টি দেশে ওষুধ রপ্তানি হয়। এর মধ্যে মালয়েশিয়া, চীন, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তানসহ এশিয়া অঞ্চলের মোট ৪৩টি দেশে এবং জার্মানি, ইতালি, রাশিয়া, ফ্রান্সসহ ইউরোপের ৩৮টি দেশে এবং উত্তর আমেরিকার ২৬টি দেশ, দক্ষিণ আমেরিকার ছয়টি, আফ্রিকার ৩৯টি এবং অস্ট্রেলিয়ার পাঁচটি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হয়

বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি ওষুধের চাহিদা কেমন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশি ওষুধের চাহিদা একেক দেশে একেক রকম। আমাদের সবচেয়ে বেশি ওষুধ রপ্তানি হয় আমেরিকায়। সেখানে ওষুধের দামও বেশি, আবার মার্কেটও বড়। সেক্ষেত্রে আমাদের আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রটোকল মেনে ওষুধ উৎপাদন করতে হয়। বিশাল অঙ্কের ওষুধ শ্রীলঙ্কায়ও রপ্তানি হয়। দেশটিতে এখন অর্থনৈতিক দুঃসময় যাচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার আমাদের বলেছে ১০ কোটি টাকার ওষুধ বিনামূল্যে দিতে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব তহবিল থেকে আরও ১০ কোটি টাকার ওষুধসহ সর্বমোট ২০ কোটি টাকার ওষুধ শ্রীলঙ্কাকে আমরা বিনামূল্যে দিয়েছি। দেশটিতে আমাদের ওষুধের ভালো মার্কেট রয়েছে।

২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর ১৫৭টি দেশে ওষুধ রপ্তানি হয়। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় এশিয়া অঞ্চলের ৪৩টি দেশে / ফাইল ছবি

‘বিদেশি ২০/২৫টি প্রতিষ্ঠানে আমরা ওষুধ রপ্তানি করি। পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারেও আমাদের ওষুধের ভালো মার্কেট রয়েছে। ভিয়েতনামেও বড় অঙ্কের ওষুধ রপ্তানি হয়। ওষুধ রপ্তানিতে বিশ্বে আমাদের অবস্থান বেশ ভালো। সরকার মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ২০০ একর জায়গা দিয়েছে ওষুধ শিল্পনগরী তৈরির জন্য। সেটা যদি বাস্তবায়িত হয় বাংলাদেশের ওষুধ খাত আরও এগিয়ে যাবে।’

বাংলাদেশ থেকে কেন তারা এত পরিমাণে ওষুধ নেয়, আমাদের ওষুধের মান ভালো নাকি দামে কম— এমন প্রশ্নের জবাবে শফিউজ্জামান বলেন, বাংলাদেশি ওষুধের মান ভালো, আবার অন্যান্য দেশের তুলনায় দামও কম। যে কারণে আমাদের ওষুধের চাহিদা বেড়ে চলেছে। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর সিইও ছিলেন বিদেশি। সেক্ষেত্রে তাদের দুটি গাড়ি দিতে হতো, থাকার জন্য বাড়ি দিতে হতো। এছাড়া আরও চাহিদা ছিল তাদের। এরপর পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। একটা পর্যায়ে সব কোম্পানিতে সিইও হিসেবে বাংলাদেশিরা চলে আসেন। ফলে খরচটা অনেক কমে যায়। সবচেয়ে বড় যে বিষয় সেটি হলো আমাদের দেশে লেবার কস্ট (শ্রমিকের মজুরি) খুবই কম। এ কারণে আমরা স্বল্প মূল্যে ওষুধ রপ্তানি করতে পারছি।

‘শুধু মূল্য নয়, মানের বিষয়টিও তারা (ওষুধ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো) খুবই গুরুত্বে সঙ্গে বিবেচনা করে। তারা মানসম্পন্ন ওষুধ চায়। বিভিন্ন সময় তারা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ভিজিট করে, মেশিন দেখে, উৎপাদন প্রক্রিয়া দেখে। সব মান যাচাই করে তারা অর্ডার দেয়। মানসম্পন্ন না হলে তো তারা অর্ডার দিত না। পাশের দেশ ভারত আমাদের প্রতিযোগী। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আমরা তাদের চেয়ে বেশ এগিয়ে আছি।’

আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় এখনও পিছিয়ে বাংলাদেশ

ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের মহাব্যবস্থাপক (জেনারেল ম্যানেজার, সেলস) আশরাফ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস ওষুধ রপ্তানি করেছে ১২২ কোটি ৩০ লাখ ৬৩ হাজার ৫৫৮ টাকার। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০ কোটি ৬৯ লাখ ২৬ হাজার ৭৪ টাকায়। আশা করছি চলতি বছর আমাদের রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়বে।

হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালসের এমডি ও বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান / ফাইল ছবি

কোন কোন দেশে বেশি রপ্তানি হয়— উত্তরে তিনি বলেন, এক এক দেশে এক এক ধরনের ওষুধের চাহিদা থাকে। আফ্রিকার বাজারগুলোতে আমাদের অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধগুলো বেশি চলে। শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামে ডায়াবেটিস ও কার্ডিওভাসকুলারের ওষুধগুলো ভালো চলে। এ দেশগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক কম চলে। আমাদের সর্বোচ্চ ওষুধ রপ্তানি হয় আফগানিস্তানে। এর বাইরে মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কার মার্কেটগুলোতে আমাদের ওষুধের চাহিদা বেশি।

ওষুধের মানের বিষয়ে আশরাফ উদ্দিন বলেন, আমরা শতভাগ মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরির চেষ্টা করি। কারণ, ওষুধ রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রক্রিয়া মেনে চলতে হয়। শুধু আমরা নই, আমাদের দেশের সব প্রতিষ্ঠানই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে ওষুধ তৈরি করছে এবং রপ্তানিও করছে। যে কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ওষুধের ওপর মানুষের একটা আস্থা তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, বাংলাদেশের ওষুধ মানসম্মত। শুধু মানসম্মতই নয়, অন্যান্য দেশের তুলনায় দামও বেশ পরিমিত।

মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) শিল্পপার্কের নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে / ফাইল ছবি

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি ওষুধের আধিপত্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখনও ওইভাবে আধিপত্যের জায়গাটা আমরা তৈরি করতে পারিনি। আমরা যদি আফগানিস্তান বা ভিয়েতনামের কথা বলি, দেশগুলোতে ভারত ও চীনের তৈরি ওষুধের আধিপত্য বেশি। তবে, মিয়ানমারে আমাদের একচেটিয়া আধিপত্য বলতে পারেন।

‘আমি বলব, ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ একটি উদীয়মান তারকা। আমরা আমাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে এ অবস্থানে উঠে এসেছি। ভারতে বেশ কয়েকটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ এখনও সে পর্যায়ে যেতে পারেনি। আন্তর্জাতিক বাজারে ওরা বড় একটি জায়গা দখল করে আছে। তবে দিনদিন আমরাও ভালো করছি। আশা করি, খুব শিগগিরই আমরা বিশ্ববাজারে আধিপত্য বিস্তার করতে পারব।’

২০৩৩ সালের চ্যালেঞ্জ : কমতে পারে রপ্তানি, বাড়তে পারে দাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ ও ফার্মেসি অনুষদের অধ্যাপক ড. এম এ মজিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। গত দুই বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর করোনার ওষুধ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে। এ সময় অন্যান্য ওষুধ রপ্তানি কম হয়েছে। এখন সেটা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের বিকাশ ভালো এবং রপ্তানিও ভালোর দিকে। ইতোমধ্যে সারাবিশ্বে আমাদের একটা ভালো অবস্থান তৈরি হয়েছে।

সামনে কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখছেন কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন আমরা যে প্রপার্টি রাইটস (মেধাস্বত্ব ছাড়) সুবিধাটা পাচ্ছি, সেটা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে। এরপর থাকবে কি না, সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। আরেকটি বিষয় হলো, ২০২৬ সালে আমরা যদি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করি, তখন আমাদের এ সুবিধা থাকবে কি না? এখন তো প্রপার্টি রাইটস শিথিলের কারণে পেটেন্টেড ওষুধ তৈরিতে আমাদের কোনো রয়্যালটি বা ফি দিতে হয় না। যে কারণে আমাদের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববাজারের তুলনায় অনেক কম দামে ওষুধ উৎপাদন করে। এতে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষসহ স্বল্প ব্যয়ের দেশের মানুষ কম দামে ওষুধ ক্রয় করতে পারছেন।’

‘প্রপার্টি রাইটস সুবিধাটি যদি ২০৩৩ সালের পর বাতিল হয়, তখন এ শিল্পে কী প্রভাব পড়বে সে বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের বিস্তর আলোচনা করতে হবে এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থাসহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে আগেই দেনদরবার করতে হবে।’

ওষুধ শিল্পের বিকাশে দক্ষ জনবল ও গবেষণার বিকল্প নেই। গবেষণার জন্য রিসার্চ ইনস্টিটিউট গঠনে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা / প্রতীকী ছবি

এম এ মজিদ বলেন, প্রতিনিয়ত আমাদের রপ্তানি বাড়ছে, এটি সামনের দিনে আরও বাড়বে। কিন্তু সমস্যাটা হলো অন্য জায়গায়। সেটা হলো- ওষুধ পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল (এপিআই), যা এখনও আমদানিনির্ভর। এই দিকটায় আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছি। যদিও সরকার মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় এপিআই পার্ক স্থাপনে জায়গা দিয়েছে। কিন্তু সেই জায়গায় এখনও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা গড়ে ওঠেনি। গবেষণার জন্য কোনো রিসার্চ ইনস্টিটিউটও তৈরি হয়নি। এদিকে আমাদের হাতে সময়ও বেশি নেই। আমরা যদি এখনই সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে, জনবল ও গবেষণার ঘাটতি দূর করতে পারি, তাহলে হয়তো ২০৩৩ সালের পর আমাদের জন্য যে চ্যালেঞ্জগুলো আসবে, সেগুলো মোকাবিলা করতে পারব। তা না হলে আমাদের রপ্তানি হয়তো কমে যাবে, দেশে ওষুধের দামও বেড়ে যাবে।

দেশে শিগগিরই ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক আইয়ুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ওষুধ শিল্প এখন একটি মানসম্মত পর্যায়ে চলে এসেছে। ওষুধের মানও অনেক উন্নত হয়েছে। এখন আমাদের রপ্তানির দিকে নজর দিতে হবে। এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে আরও ১০ বছর বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদনে কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব সুবিধা পাচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে কীভাবে ওষুধ শিল্পের আরও বিকাশ করা যায় সে বিষয়ে সরকারের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে।

‘দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো গৌরবের সঙ্গে ১৫৭টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। সরকারের সহযোগিতা এ শিল্পের বিকাশে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। সরকার ওষুধ শিল্পপার্ক স্থাপন করে দিচ্ছে। খুব শিগগিরই সেখানে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন হবে। ফলে এ শিল্পের বিকাশ আরও সহজ হবে।’

ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের মহাব্যবস্থাপক (জেনারেল ম্যানেজার, সেলস) আশরাফ উদ্দিন আহমেদ / ফাইল ছবি

আইয়ুব হোসেনের মতে, ওষুধ শিল্পের রপ্তানি বাড়াতে বিদেশ থেকে আনা কাঁচামালের ওপর ডিউটি ফি কমাতে হবে। আমরা চাইলেই একটি দেশে ওষুধ রপ্তানি করতে পারি না। ওই দেশে নির্দিষ্ট ওষুধ ও প্রতিষ্ঠানের নাম নিবন্ধনের পরই আমরা রপ্তানি করতে পারি। তাই এসব সমস্যা সমাধানে আমাদের, পাশাপাশি সরকারকে আরও কাজ করতে হবে।

বৃহৎ বাজার ধরতে চায় বাংলাদেশ

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশীয় ৪৬ প্রতিষ্ঠানের ৩০০ ধরনের ওষুধ ও মেডিকেল পণ্য বিশ্ববাজারে রপ্তানি হচ্ছে। বিশ্ববাজারে এখন ওষুধের বার্ষিক ব্যয় ৯৫ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার। আগামী ১০ বছরের এলডিসি সুবিধা কাজে লাগিয়ে বৃহৎ এ বাজার ধরতে চায় বাংলাদেশ। এজন্য ওষুধ শিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে কাঁচামাল উৎপাদনে মনোযোগ দিয়েছে সরকার। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) শিল্পপার্কের নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সিইটিপি নির্মাণকাজ ৯৮ শতাংশ শেষ হয়েছে।

বিশ্ববাজারে ওষুধের পেছনে বার্ষিক ব্যয় ৯৫৬০০ কোটি মার্কিন ডলার। বিশাল এ বাজার ধরতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে / ফাইল ছবি

২৭টি শিল্প ইউনিটকে ৪২টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু শিল্প ইউনিট তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। এর মধ্যে বড় চারটি ইউনিট তাদের অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ করেছে। তারা এখন পরীক্ষামূলক ট্রায়ালে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। আগামী বছরের প্রথম দিকে এপিআই (ওষুধ শিল্প) পার্কে পরিপূর্ণ উৎপাদন শুরু করা যাবে।

টিআই/এমএআর