মাহবুব রহমান, ‘মহাজন’ হিসেবেই বেশ পরিচিত। শরীয়তপুর নড়িয়ার পালেরচর এলাকায় বাড়ি হলেও ব্যবসা সূত্রে দীর্ঘ সময় তার বসবাস রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে।

গত বছরের ৩০ আগস্ট কামরাঙ্গীরচরের কয়লাঘাট চৌরাস্তা মোড়ের করিমাবাদ এলাকার মৃত আলাউদ্দিন জমিদার বাড়ির চতুর্থ তলার ভাড়া করা ফ্ল্যাটে অভিযান চালায় ডিবি লালবাগ বিভাগের অস্ত্র উদ্ধার ও মাদক নিয়ন্ত্রণ দল। গ্রেপ্তার করা হয় মাহবুব রহমানকে। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় লক্ষাধিক টাকার নকল প্রসাধনসামগ্রী। এর মধ্যে রয়েছে- বিপুল পরিমাণ জনসন মিল্ক রাইস বাথ বোতল, কুমারিকা হেয়ার ফল কন্ট্রোল অয়েল, প্যারাসুট বেলি ফুল কোকোনাট হেয়ার অয়েল, এলোভেরা সুথিং জেল, জনসন বেবি অয়েল, জনসন বেবি শ্যাম্পু, ডাবর আমলা হেয়ার অয়েল ও কাস্টর অয়েল।

ডিবি পুলিশের ওই অভিযানের পর সংশ্লিষ্ট এলাকায় খোঁজ নেয় ঢাকা পোস্ট। জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে কামরাঙ্গীরচর এলাকাতেই বসবাস মাহবুব রহমানের। তবে ঘন ঘন বাসা পরিবর্তন করতেন তিনি।

আমান হোসেন, রাজধানীর লালবাগ এলাকায় ভেজাল প্রসাধনী তৈরি ও বাজারজাতকরণে সিদ্ধহস্ত। তবে, গ্রেপ্তার না হওয়ায় তাকে আইনের আওতায় আনা যায়নি। জানা যায়, ঘন ঘন ঠিকানা পরিবর্তন করে ঠিকই ভেজাল প্রসাধনী তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন আমান

নকল ওই কারখানা ভবনের ভাড়াটিয়া সালাউদ্দিন জানান, ভেজাল প্রসাধনী তৈরিতে কেমিক্যাল লাগে। মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড গন্ধ পেতাম। কিন্তু এড়িয়ে যেতাম কারণ, কামরাঙ্গীরচরে অনেক কারখানা রয়েছে। আগে বুঝিনি ভেজাল প্রসাধনী তৈরি করা হচ্ছিল এখানে। অথচ আমরা মাহবুব রহমানকে চিনতাম ‘মহাজন’ হিসেবে।

ময়লার ভাগাড় থেকে  প্রসাধনীর ভালো মোড়ক বাছাই করা হয়। এরপর সেগুলো চলে যায় রাজধানীর ইসলামবাগে— জানান পরিচ্ছন্নকর্মী উজ্জ্বল  / ছবি- ঢাকা পোস্ট

পলাতক আমান লালবাগের ভেজাল প্রসাধনী তৈরির মূল হোতা

আমান হোসেন, রাজধানীর লালবাগ এলাকায় ভেজাল প্রসাধনী তৈরি ও বাজারজাতকরণে সিদ্ধহস্ত। তবে, গ্রেপ্তার না হওয়ায় তাকে আইনের আওতায় আনা যায়নি। জানা যায়, ঘন ঘন ঠিকানা পরিবর্তন করে ঠিকই ভেজাল প্রসাধনী তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন আমান।

গত বছরের ৩০ নভেম্বর চকবাজারের দেবীদাস ঘাট লেনের ৩৯/১নং বাসায় আমানের ভেজাল প্রসাধনী তৈরির কারখানায় হানা দেয় ডিবি পুলিশ। আটক করা হয় কর্মচারী আলতাফ হোসেন, সোহেল হাওলাদার ও সালমানকে। পালিয়ে যেতে সক্ষম হন আমান হোসেন।

ওই কারখানা থেকে জব্দ করা হয় নকল জনসন বেবি লোশন। প্রত্যেকটি লোশনের গায়ে লাগানো কাগজের লেভেলে লেখা ‘MANUFACTURED BY Johnson's & Johnson's LIMITED’। এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা মূল্যের আট কার্টনভর্তি ১০০ এমএলের লুচি অলিভা অলিভ অয়েল; যার প্রতিটি কাচের বোতলের গায়ে কাগজের লেভেলে  লেখা ‘Products of Spain’। এক লাখ ১৫ হাজার ২০০ টাকা মূল্যের চার কার্টনভর্তি ১০০ এমএলের ইমামি ৭ ওয়েলস ইন নন স্টিক হেয়ার অয়েল; যার গায়ে লাগানো কাগজের লেভেলে লেখা ‘Mfd by: Emami Limited, Assam’। আরও অনেক ভেজাল প্রসাধনী উদ্ধার করা হয় ওই কারখানা থেকে।

 ময়লার ভাগাড় (ডাম্পিং স্টেশন) থেকে প্রসাধনীর খালি বোতল/জার/মোড়ক সংগ্রহ করছেন পরিচ্ছন্নকর্মীরা / ছবি- ঢাকা পোস্ট

এ বিষয়ে ডিএমপি’র গোয়েন্দা বিভাগের (লালবাগ) অস্ত্র উদ্ধার ও মাদক নিয়ন্ত্রণ দলের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. ফজলুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী আইন ও ভোক্তা অধিকারের প্রতি তোয়াক্কা না করে ভেজাল বা নকল কসমেটিকস আসল বলে চালিয়ে বাজারজাত করে আসছেন। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে আমরা ২০২১ সাল থেকে চলতি বছরের ৩০ মার্চের মধ্যে অন্তত ১০টি অভিযান পরিচালনা করি। সব অভিযানে আমরা একই আসামির সংশ্লিষ্টতা বারবার যেমন পেয়েছি, আবার পরস্পর যোগসাজশে ভেজাল কসমেটিকস ব্যবসার তথ্যও মিলেছে। ভেজাল নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অভিযান চলবে।

ক্রেতাদের দায় কতটুকু

এত অভিযানের পরও কেন নির্মূল হচ্ছে না ভেজাল প্রসাধনসামগ্রীর উৎপাদন— জানতে চাওয়া হয় র‌্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাজহারুল ইসলামের কাছে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ইদানীং বিদেশি প্রসাধনী যেভাবে নকল করা হচ্ছে, অভিযানে গিয়ে আমরা বেশ অবাক হচ্ছি। পল্টনের প্রিন্টিং প্রেসে অভিযান চালিয়ে দেখেছি, সেখানে বিদেশি প্রসাধনীর মতো হুবহু স্টিকার তৈরি হচ্ছে। চকবাজার হচ্ছে ভেজালের হাব। সেখানে হরহামেশা অভিযান পরিচালনা করাও কঠিন। গণমাধ্যম, ভোক্তা, ব্যবসায়ীদের উচিত এ বিষয়ে সচেতন হওয়া।

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) উপ-পরিচালক (সিএম) মো. রিয়াজুল হক এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করি, অভিযান পরিচালনা করি। গত নয় মাসে আমরা ৬৪টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা জরিমানা এবং ৭০ লাখ টাকা মূল্যের ভেজাল প্রসাধনী পণ্য জব্দ ও ধ্বংস করি। সিলগালা করি তিনটি কারখানা।

নকল প্রসাধনী তৈরির কারখানা থেকে জব্দ করা প্রসাধনসামগ্রী ও উপকরণ / ছবি- ঢাকা পোস্ট

এরপরও বাজারে ভেজাল প্রসাধনী বিক্রি হচ্ছে কীভাবে— প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘অভিযানের পরও বাজারে ভেজাল প্রসাধনী বিক্রি হচ্ছে। কারণ, ক্রেতা বা ভোক্তারা এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন নন। বিএসটিআই জোন বা এলাকাভিত্তিক প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেছে। যেখানেই ভেজাল সেখানেই অভিযান। সমস্যা হচ্ছে, অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ। ফলে ঘন ঘন ঠিকানা পরিবর্তন করে ভেজাল কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।’

তার মতে, অবশ্যই ক্রেতা বা ভোক্তাদের সচেতন হতে হবে। তা না হলে ভেজাল প্রসাধনসামগ্রী বিক্রি কোনোভাবেই বন্ধ করা সম্ভব নয়।

ভেজাল প্রসাধনসামগ্রী বিক্রি বন্ধে ‘ক্রেতাদেরও দায় আছে’— মনে করেন বিএসটিআই’র মান নির্ধারণ কমিটির কসমেটিকস অ্যান্ড রিলেটেড প্রোডাক্টস শাখার সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নূরনবী। তার মতে, আমরা জানি ভেজাল কারবারিরা ব্যবহার করা কসমেটিকস মোড়ক বা প্লাস্টিকজাত পণ্যের জারগুলো রিসাইকেল করে বাজারে ছাড়ছে। উন্নত দেশগুলোতে এর নজির নেই বললেই চলে। কারণ, সেখানে কসমেটিকস ব্যবহার শেষে এর জার কেটে বা নিচ থেকে ফুটো করে ডাস্টবিনে ফেলা হয়। এতে দ্বিতীয়বার ব্যবহার বা রিসাইকেলের সুযোগ থাকে না। এমন প্রচলন আমাদের দেশে নেই বললেই চলে।

‘লাগেজ পার্টি ও এলসির মাধ্যমে সরাসরি চীনের তৈরি ভেজাল অর্থাৎ হুবহু নকল কসমেটিকস বাংলাদেশে আসছে। এর আগেও এমন অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে’— উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা তো বলেছি, এটা দেখভাল করা হোক। বিএসটিআই কাস্টমসের সঙ্গে সমন্বয় করে যদি অভিযান ও নজরদারি পরিচালনা করে তবেই এ ভেজাল কারবার রোধ সম্ভব।’

কোনো অনুমোদন নেই— এমন কসমেটিকস বাজারে এখন খুবই প্রচলিত ও সস্তা। সেখানে হরহামেশাই দেখা যায় বিএসটিআই’র অনুমোদিত নকল লোগো। বিএসটিআই’র তো এসব দেখা উচিত। এমন অবস্থাও দেখছি যে, আসলের চেয়ে নকল পণ্যেই বিএসটিআই’র লোগো বেশি— মন্তব্য বিশিষ্ট এ অধ্যাপকের।

কীভাবে দেখছে ইউনিলিভার

ঢাকা পোস্টের নিজস্ব অনুসন্ধান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানের তথ্য অনুযায়ী, ভেজাল কারবারিদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে জনসন, ইউনিলিভার, গারনিয়ার, জিলেট ফোম, সানসিল্ক, অল ক্লিয়ার, পন্ডসের মতো ব্র্যান্ডের প্রসাধনী।

ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালক (লিগ্যাল) ও সচিব রাশেদুল কাইউম / ছবি- ঢাকা পোস্ট

এ বিষয়ে ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালক (লিগ্যাল) ও সচিব রাশেদুল কাইউম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউনিলিভার বাংলাদেশের ভোক্তাদের জন্য সর্বোত্তম পণ্য নিশ্চিত করতে অনবরত কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের বেশির ভাগ পণ্যই নিজ নিজ ক্যাটাগরিতে সবচেয়ে জনপ্রিয়। ফলে কিছু সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি আমাদের পণ্য নকল করে বাজারে ছাড়ছে। সাধারণ ভোক্তারা আসল প্রসাধনী কিনতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন, নকল বা ভেজাল পণ্য কিনছেন। যদিও আসল পণ্যের সংখ্যা নকল পণ্যের চেয়ে অনেক বেশি। আসল পণ্যের উত্তরোত্তর চাহিদার কারণে নকল পণ্য আসছে বাজারে। এসব পণ্য ভোক্তাদের শুধু প্রতারিতই করছে না, তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

“বাংলাদেশের ভোক্তারা বিদেশি পণ্যের প্রতি বেশি আকর্ষণ বোধ করেন। অথচ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিদেশ থেকে আনা পণ্যে বিএসটিআই’র লোগো থাকে না। থাকে না আমদানির তারিখ, এমনকি খুচরা মূল্য পর্যন্ত উল্লেখ থাকে না। আপাতদৃষ্টিতে এগুলো বিদেশি মনে হলেও আসলে তা নকল বা ভেজাল পণ্য। তাই এ ধরনের পণ্য কেনা থেকে ভোক্তাদের সাবধান হতে হবে।”

এছাড়া নিয়মিত অভিযানের কারণে নকল পণ্যের সংখ্যা ও চাহিদা কমছে বলে মনে করেন রাশেদুল কাইউম।

 জেইউ/এমএআর/