ঢাকার রানওয়েতে হাঁটছে শিয়াল, দৌড়াচ্ছে-খেলছে
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে একঝাঁক শিয়ালকে খেলতে দেখা গেছে। দীর্ঘদিন ধরে রানওয়ের পাশের ঝোপঝাড়ে থাকলেও সোমবার (৩০ মে) ও মঙ্গলবার (৩১ মে) দিনের বেলায় তাদের রানওয়েতে হাঁটতে এবং দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা যায়। রানওয়ে এবং এর আশপাশে শিয়ালসহ অন্যান্য পশুপাখির অবাধ বিচরণ যে কোনো পাইলটের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল হতে পারে। বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে এই শিয়াল।
সরেজমিন দেখা যায়, সোমবার (৩০ মে) দুপুরে বিমানবন্দর এলাকায় মৃদু বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টি ও মেঘাচ্ছন্ন আকাশে এমনিতেই কয়েকটি ফ্লাইটের নির্ধারিত সময় ঢাকা অবতরণ করতে পারেনি। দুপুরে তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে আসা টার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট তখন বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য প্রস্তুত ছিল। রানওয়েতে কয়েকটি শিয়াল ছিল। তবে তারা প্লেনের শব্দে চলে যায়। ফ্লাইটটি অবতরণের কিছুক্ষণ পর আবারও শিয়ালের দলকে রানওয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়।
বিজ্ঞাপন
ফ্লাইটটি নিরাপদে অবতরণের পর এটিসি টাওয়ারের সঙ্গে কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে পাইলট বলেন, ‘নিরাপদে অবতরণের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। আপনাকে অবগত করতে চাই যে রানওয়েতে আমি এখনো ৩টি কুকুরকে (প্রকৃতপক্ষে শিয়াল হবে) ঘোরাফেরা করতে দেখছি।’
এটিসি থেকে তার্কিশের পাইলটকে ধন্যবাদ জানানো হয়।
৩০ মে দুপুর ১টা ২০ মিনিটে এয়ার ইন্ডিয়ার (এআই-১২৩০) একটি ফ্লাইট কলকাতা থেকে এসে ঢাকায় অবতরণ করে। অবতরণের পর ট্যাক্সিওয়ের দিকে যাওয়ার সময় এটিসি টাওয়ার থেকে পাইলটকে জানানো হয়, ‘আপনার রাইট শোল্ডারের দিকে (ডান দিকে) ২টি কুকুর (শিয়াল) দেখতে পাচ্ছি। আপনি একটু খেয়াল রাখবেন।’
এর পরপরই রানওয়েতে একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে সাইরেন বাজিয়ে তাদের দূরে সরিয়ে দেয়। রানওয়ে ফাঁকা করার পর পরবর্তী ফ্লাইটগুলো যাত্রা শুরু করে।
বিমানবন্দরে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ২৪ ঘণ্টা বিমানবন্দরে ডিউটি করি। ক্যান্টনমেন্ট ও বিমানবন্দর এলাকার জঙ্গলে প্রচুর শিয়াল দেখা যায়। এরা দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গলেই থাকে। তবে সম্প্রতি তারা রানওয়েতে উঠে দৌড়াদৌড়ি করে। প্লেনের শব্দ পেলে শেষ মুহূর্তে আবার সরে যায়।
পাখি ও বন্যপ্রাণী নিয়ন্ত্রণে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন ওয়াইল্ড লাইফ/বার্ড হ্যাজার্ট কন্ট্রোল কমিটি তৈরি করেছিল বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব (যিনি যখন দায়িত্বে থাকবেন)। এছাড়া কমিটির সদস্যরা হচ্ছেন- মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের যুগ্ম সচিব, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ডিরেক্টর (অপারেশন), বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের ডিরেক্টর (অপারেশন), পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত আইজিপি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এমডি, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এয়ার অপারেটর কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন বেবিচক চেয়ারম্যান।
২০১৭ সালে গঠিত ওই কমিটির দায়িত্ব ছিল আইকাও’র বিধিবিধান ও এয়ারপোর্ট সার্ভিস ম্যানুয়াল অনুযায়ী, ওয়াইল্ড লাইফ ও বার্ড স্টাইক সমস্যার মোকাবিলা করা, কোনো ধরনের পাখি কোনো মৌসুমে এবং কেন আসে- এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করা, বিমানবন্দর ও এর আশপাশ এলাকার বর্জ্য ম্যানেজমেন্ট নজরদারি করা, নিয়মিত বার্ড স্ট্রাইক নজরদারি করা, সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধান করা, বিমানবন্দরের পুকুরের মাছ চাষ, কৃষিজমি, গরু-ছাগলের খামার, ময়লা-আবর্জনার ডাম্পিং, গলফ কোর্স, ছোট পুকুর ইত্যাদি সরিয়ে ফেলা।
আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অথরিটির (আইকাও) নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০২১ সালে বেবিচক ‘ন্যাশনাল এভিয়েশন সেফটি প্ল্যান ২০২১-২০২৩’ তৈরি করে। এতে বলা হয়েছে, বিমানবন্দরের আশপাশে পাখি এবং বন্যপ্রাণীর খাবার থাকায় এখানে তাদের আনাগোনা রয়েছে। এটা আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চলাচলের জন্য তাদের উপস্থিতি অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। বিমানবন্দরে তাদের তাড়ানোর কোনো প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নেই। যেসব ব্যবস্থা আছে তাও পর্যাপ্ত নয়। পাখি ও বন্যপ্রাণীকে বিমানবন্দর থেকে সরাতে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তবে বর্তমানে সাইরেন বাজানো ছাড়া তাদের তাড়াতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি বেবিচক বা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
এবিষয়ে জানতে চাইলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিয়ালসহ বন্যপ্রাণী নিয়ন্ত্রণে একটি কমিটি রয়েছে। আমরা কমিটিকে অ্যাক্টিভেট করেছি। আমরা সিটি কর্পোরেশনের (ঢাকা উত্তর) সহায়তা নিয়ে আইনের আওতায় তাদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি।
২০২১ সালের নভেম্বরে কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের সময় রানওয়েতে দুটি গরুর সঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজের ধাক্কা লাগে। এতে গরু দুটি মারা গেলেও ৯৪ যাত্রী প্রাণে বেঁচে যান। এছাড়াও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে পাখি ও প্রাণীর জন্য পাইলটরা প্রতিনিয়ত চিন্তিত থাকছেন।
একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানের পাইলট ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমানবন্দরের ঝোপঝাড়ে বন্যপ্রাণী থাকতেই পারে। কিন্তু রানওয়ের ওপর গরু, কুকুর এবং শিয়ালের মতো প্রাণীর বিচরণ অত্যন্ত বিপজ্জনক। এভিয়েশনের ইতিহাসে অধিকাংশ দুর্ঘটনা রানওয়ে বা বিমানবন্দরের কাছাকাছি ঘটেছে। ঢাকা ও কক্সবাজার বিমানবন্দরে নিয়মিতই বন্যপ্রাণী ও পাখি চোখে পড়ে। এতে ফ্লাইট পরিচালনায় প্রায়ই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে কখনোই এমন চিত্র দেখা যায় না। বড় দুর্ঘটনা এড়াতে এটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।
বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের নবগঠিত পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, কিছুদিন আগেই কক্সবাজারে প্লেনের চাকা লেগে রানওয়েতে গরু মারা পড়ল। এখন শিয়াল হাঁটাহাঁটি করে। এসব ঘটনা যাত্রীদের যেমন নিরাপত্তাহীন করে তোলে। একইভাবে বাংলাদেশের বেবিচকের দক্ষতার ওপরে বিশ্বের একটা ইমেজ ক্রাইসিস সৃষ্টি করে। নিজেদের রানওয়ে সুরক্ষিত না রাখতে পারলে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো নিরাপত্তাহীন মনে করবে। এছাড়াও এধরনের ঘটনা বিশ্বের অন্যান্য মিডিয়াগুলো ফলাও করে প্রচার করে। রানওয়েতে আরও ওয়াচ বাড়াতে হবে, গরু-শেয়ালের মতো কোনো প্রাণী যাতে না আসতে পারে সেদিকে অবশ্যই বেবিচকের খেয়াল রাখতে হবে।
এআর/এসএম