নৌকাপ্রত্যাশী হতেও যোগ্যতা নির্ধারণ!
জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের বিভিন্নপর্যায়ের যেকোনো নির্বাচনে বেড়ে চলছে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা। ক্রমবর্ধমানহারে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বাড়ায় ‘বিব্রত’ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। এর পরিপ্রেক্ষিতে এবার নৌকার মনোনয়ন চাওয়ার ক্ষেত্রেও যোগ্যতা নির্ধারণের কথা ভাবছে দলটির নেতারা।
আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংসদ নির্বাচনে অধিকসংখ্যক মনোনয়ন চাওয়ার ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন খোদ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। একটি সংসদীয় আসনে তিনের অধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়া মানেই স্থানীয় নেতৃত্বের সংকট বলে মত দিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতির যেন সৃষ্টি না হয় সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতেও নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
বিজ্ঞাপন
একটি সংসদীয় আসনে তিনের অধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়া মানেই স্থানীয় নেতৃত্বের সংকট বলে মত দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছর অনুষ্ঠিত পাঁচ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনেও এমন চিত্র ফুটে উঠেছিল। নওগাঁ- ৬ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে আবেদন করেছিলেন ৩৪ জন, সিরাজগঞ্জ-১ আসনে তিন, পাবনা- ৪ আসনে ২৮, ঢাকা- ৫ আসনে ২০ এবং ঢাকা- ১৮ আসনে ৫৬ জন। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের বিপরীতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন চার হাজার ২৩ জন। অর্থাৎ প্রতি আসনে গড়ে ১৩ দশমিক ৪১ জন করে নৌকা প্রতীকে লড়তে আবেদন করেছিলেন। সবমিলিয়ে, যতজন প্রার্থী একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন এর চেয়ে বেশি ছিল আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোকে নির্দলীয় করা, এই ফায়দাভিত্তিক রাজনীতির অবসান ঘটানো। দলীয় কারণে শুধু মারামারিই হচ্ছে না, এর মাধ্যমে পুরো প্রতিষ্ঠান চরমভাবে কলুষিত হচ্ছে মনোনয়ন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কারণে
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে সব দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মোট তিন হাজার ৫৬ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ৩৯টি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে মোট এক হাজার ৫৩৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এদিকে, একাদশ সংসদে ৪৩টি সংরক্ষিত নারী আসনে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন এক হাজার ৫০০ জন।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, একটি গণতান্ত্রিক দলের হয়ে নির্বাচনে লড়তে অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ মনোনয়ন কিনবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো দলের মনোনয়ন সংগ্রহের জন্য প্রত্যাশীদের যোগ্যতা নির্ধারণ করা উচিৎ। যে কেউ এসে মনোনয়ন কিনবেন, বিষয়টি দলের জন্য শুভকর নয়। আবেদনপত্র কেনার মতো একটা যোগ্যতার মাপকাঠি এবং বাধ্যবাধকতা থাকা উচিৎ। থাকতে হবে একটি নীতিমালাও।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, পৌরসভার মেয়র পদে সংশ্লিষ্ট জেলা, উপজেলা ও পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী রেজুলেশনে প্রস্তাবিত প্রার্থীরাই শুধুমাত্র মনোনয়ন ফরম নিতে পারবেন বলে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। এরপর ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের ২৫ পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে আবেদন করেছিলেন ১০৫ জন; প্রতি পৌরসভায় গড়ে চার দশমিক দুজন। ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের ৬১ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন ৩০৫ জন; গড়ে প্রতি পৌরসভায় পাঁচজন করে। যা আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় অনেক কম।
অনেকদিন ধরে যারা রাজনীতি করেন, দলে ত্যাগী যারা আছেন, যাদের বেশি টাকা-পয়সা নেই, কিন্তু দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ; যাদের জনপ্রিয়তাও আছে, তাদের যদি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে তাহলে এ বিষয়গুলো ঘটবে না। কেন্দ্রীয়পর্যায়ে যারা মনোনয়ন দেন তাদের নিরপেক্ষ থাকতে হবে— এটা করলে মনে হয় ভালো হবে
অধ্যাপক মো. শামসুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক দলের হয়ে অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ মনোনয়ন কিনবে, এটাই স্বাভাবিক। এটাকে সাধুবাদ জানানো উচিত। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো দলের মনোনয়ন সংগ্রহের জন্য প্রার্থীর যোগ্যতা নির্ধারণ করা উচিত। যে কেউ এসে মনোনয়ন কিনবেন, বিষয়টি দলের জন্য শুভকর নয়। আবেদনপত্র কেনার মতো একটা যোগ্যতার মাপকাঠি এবং বাধ্যবাধকতা থাকা উচিৎ। থাকা প্রয়োজন নীতিমালাও।’
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের বিপরীতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন চার হাজার ২৩ জন। অর্থাৎ প্রতি আসনে গড়ে ১৩ দশমিক ৪১ জন করে নৌকা প্রতীকে লড়তে আবেদন করেছিলেন
তিনি বলেন, ‘যিনি মনোনয়নপত্র কিনবেন তারও বিবেকের কাছে আত্মজিজ্ঞাসা থাকা উচিত যে, আওয়ামী লীগের মতো সুপ্রাচীন একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের সংসদীয় বোর্ডের বিবেচনায় যাওয়ার মতো যোগ্যতা আমি অর্জন করেছি কি-না? হঠাৎ করে এসে কোনো ব্যবসায়ী অথবা চাকরি থেকে অবসর নেওয়া কেউ এসে আবেদন করবেন, তাহলে তো রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজনীতিটা থাকে না।’
একটি গণতান্ত্রিক দলের হয়ে অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ মনোনয়ন কিনবে, এটাই স্বাভাবিক। এটাকে সাধুবাদ জানানো উচিত। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো দলের মনোনয়ন সংগ্রহের জন্য প্রার্থীর যোগ্যতা নির্ধারণ করা উচিত। যে কেউ এসে মনোনয়ন কিনবেন, বিষয়টি দলের জন্য শুভকর নয়
জাহাঙ্গীর কবির নানক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ
মনোনয়নপ্রত্যাশী হতে যোগ্যতা নির্ধারণে আওয়ামী লীগের ভাবনার বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটা ভালো। তার চেয়ে ভালো হবে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোকে নির্দলীয় করা। এই ফায়দাভিত্তিক রাজনীতির অবসান ঘটানো। দলীয় কারণে শুধু মারামারিই হচ্ছে না, এর মাধ্যমে পুরো প্রতিষ্ঠান চরমভাবে কলুষিত হচ্ছে মনোনয়ন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কারণে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. শামসুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অনেকদিন ধরে যারা রাজনীতি করেন, দলে ত্যাগী যারা আছেন, যাদের বেশি টাকা-পয়সা নেই, কিন্তু দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ; যাদের জনপ্রিয়তাও আছে, তাদের যদি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে তাহলে এ বিষয়গুলো ঘটবে না। কেন্দ্রীয়পর্যায়ে যারা মনোনয়ন দেন তাদের নিরপেক্ষ থাকতে হবে— এটা করলে মনে হয় ভালো হবে।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ার জন্য তৃণমূলের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত, সৎ, জনপ্রিয়, আদর্শবান, যারা নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়েছেন, যারা জেল খেটেছেন, শহীদ পরিবার অথবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে লড়াই করতে গিয়ে যারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, বিএনপি-জামায়াতের অত্যাচার-নির্যাতনে বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে, অঙ্গহানি ঘটেছে— এমন অসংখ্য ঘটনা তো আছে আমাদের দলে। তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।’
এইউএ/এফআর/এমএআর