নদীর প্রাণ শুশুক বাঁচাতে যত উদ্যোগ
বিলুপ্তির ঝুঁকিতে সামুদ্রিক প্রাণী ডলফিন, আদর করে যাকে ডাকা হয় শুশুক। অত্যন্ত নিরীহ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির অবাধ বিচরণ বাংলার নদীগুলোতে দেখা গেলেও কালের বিবর্তে আজ বিলুপ্তির পথে। তবে সুন্দরবন ঘিরে প্রবহমান নদীতে অধিক সংখ্যক শুশুকের বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। সুন্দরবনের পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় প্রাণীটির অবাধ বিচরণের উপযোগী একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
সুন্দরবনের বিরল প্রজাতির ডলফিনের আবাসস্থল আরও নিরাপদ করতে টহল ও বন বিভাগের সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এমন প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছে। গত বছরের নভেম্বরে বন বিভাগের ‘গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনার জন্য রক্ষিত এলাকা সম্প্রসারণ’ প্রকল্পটি পরিদর্শন করে সুপারিশ জানিয়েছে তারা।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে মোট ১১ প্রজাতির ডলফিন আছে। মিঠা পানিতে এক প্রজাতির ডলফিন বাস করে, যাকে শুশুক বলা হয়। নোনা ও মিঠা পানির মিলনস্থলে পাওয়া যায় ইরাবতী ডলফিন। যেখানে নোনা পানি বেশি, সেখানে আরও নয় প্রজাতির ডলফিন বাস করে
বন বিভাগ বলছে, দেশের বিভিন্ন নদীতে হঠাৎ হঠাৎ ভেসে উঠতে দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির ডলফিন। স্থানীয়ভাবে এগুলো শুশুক নামে পরিচিত। বিভিন্ন সময় জেলেদের মাছ ধরার জালে আটকা পড়ে অনেক ডলফিনের মৃত্যু হয়। এ কারণেই হুমকির মুখে বিরল প্রজাতির প্রাণীটির জীবন। ডলফিনের তিনটি অভয়ারণ্যে মাছের প্রজনন যাতে বিঘ্নিত না হয়, তা বিবেচনায় নিয়ে আধুনিক কার্যকরী টহল জোরদার করা হয়েছে।
সুন্দরবনে নয়টির মধ্যে দুটো স্পটকে আমরা অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছি। স্পট দুটি হচ্ছে- শিবসা ও ভদ্রা। সুন্দরবনের বাইরে পানখালিকেও অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় এক হাজার জেলেপরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাদের বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ বেছে নিতে পারে
মো. মদিনুল আহসান, প্রকল্প পরিচালক
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক মো. মদিনুল আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রকল্পের আওতায় শুধু সুন্দরবন অঞ্চলের ডলফিনের ওপর পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। জরিপ করতে গিয়ে দেখা গেছে, পুরো সুন্দরবনজুড়েই ডলফিন বাস করে। সুন্দরবন অঞ্চল ওপেন ওয়াটার বডির আওতায় থাকায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে ডলফিনের কোনো সমস্যা হয় না। দেশের সুন্দরবন জরিপ করে ডলফিনের নয়টি হটস্পট পেয়েছি। যেসব অঞ্চলে ডলফিনের আধিক্য রয়েছে, সেসব অঞ্চলকে ‘হটস্পট’ বলা হয়। ‘সুন্দরবনে শ্যালা-সুপতি নদী, শিবসা, পুটনি, পশুর ও বলেশ্বর মোহনা হচ্ছে ফুল হটস্পট। আর সেমি হটস্পটের মধ্যে রয়েছে- ভরজাত, মাহমুদা মালঞ্চ, পাঙ্গাসীয়া ও পুটনি।
‘হটস্পটগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুন্দরবনে নয়টির মধ্যে দুটো স্পটকে আমরা অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছি। স্পট দুটি হচ্ছে- শিবসা ও ভদ্রা। সুন্দরবনের বাইরে পানখালিকেও অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, ডলফিনের আবাসস্থল নিরাপদ করার জন্য বা ডলফিনের প্রোডাকশন নিশ্চিতের জন্য সুন্দরবনের চারটা রেঞ্জে স্মার্ট কার্ড প্রিন্ট প্রচলিত আছে। রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে এটি চলছে। ডলফিন সংরক্ষণে সুন্দরবন এলাকায় সাতটি ডলফিন কনজারভেশন টিম গঠন করেছি। এসব টিমে মোট ৭০ সদস্য রয়েছেন। সবাই কমিউনিটি পিপল। প্রকল্প এলাকায় এক হাজার জেলেপরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাদের বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ বেছে নিতে পারে।
ডলফিনকে বাঁচাতে হবে। কারণ, এরা না বাঁচালে এগুলোর সঙ্গে যেসব প্রাণী জড়িত, সেগুলোও থাকবে না। আমাদের দেশে আরও গবেষণা করতে হবে। সঠিক গবেষণা করা হলে এসব প্রাণী টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে
ড. আতিক রহমান, পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ
সুন্দরবন ছাড়া দেশের আর কোথায় ডলফিন পাওয়া যায়— জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রায় সব নদীতে একসময় ডলফিন পাওয়া যেত। এখন ভৈরব, হালদা, কর্ণফুলী, পদ্মা (সিরাজগঞ্জ সাইট), যমুনা নদী (চিলমারির দিকে), ব্রহ্মপুত্রে (চিলমারির দিকে) ডলফিন রয়েছে। এছাড়া সাগরেও ডলফিনের দেখা পাওয়া যায়। তবে সাগরের ডলফিন অন্য প্রজাতির। বন অধিদপ্তর মিঠাপানির ডলফিন নিয়ে জরিপ করেছে।
বাংলাদেশে মোট ১১ প্রজাতির ডলফিন আছে। আমরা দুটো প্রজাতি নিয়ে কাজ করেছি। মিঠা পানিতে এক প্রজাতির ডলফিন বাস করে, যাকে শুশুক বলা হয়। নোনা ও মিঠা পানির মিলনস্থলে পাওয়া যায় ইরাবতী ডলফিন। যেখানে নোনা পানি বেশি, সেখানে আরও নয় প্রজাতির ডলফিন বাস করে। ২৪ অক্টোবরকে বন বিভাগ ‘ডলফিন দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা জনসচেতনতা বৃদ্ধি করেছি।
পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটা সময় সমুদ্র থেকে ডলফিন নদীতে চলে আসে। আগে তুরাগ নদীতেও ডলফিন চলে আসত। কিন্তু সেই ডলফিন আর ফিরতে পারত না। কারণ তুরাগে ওই রকম জায়গা বা গভীরতা ছিল না। এ কারণে নদীর গভীরতা বাড়ানো হয়েছিল। যাতে ডলফিনরা ওখানে এসে থাকতে পারে, আবার চলেও যেতে পারে।
ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালানো, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও জুডিশিয়াল ক্ষমতা প্রয়োগ। আদালতের নির্দেশনা ডলফিন নিধন সহজে ঠেকানো সম্ভব
ড. আতিক রহমান, পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ
তিনি বলেন, ডলফিন আমাদের জীবন ও পরিবেশের অঙ্গ। সাধারণভাবে এদের শুশুক বলে। ডলফিনকে বাঁচাতে হবে। কারণ, এরা না বাঁচালে এগুলোর সঙ্গে যেসব প্রাণী জড়িত, সেগুলোও থাকবে না। আমাদের দেশে আরও গবেষণা করতে হবে। সঠিক গবেষণা করা হলে এসব প্রাণী টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
ডলফিন রক্ষায় বন বা মৎস্য বিভাগ থেকে আর কী কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জেলেদের সচেতন করতে হবে। মূলত যারা মৎস্য আহরণের সঙ্গে জড়িত তাদের বুঝাতে হবে যে, ডলফিন খাওয়া বা মারার মতো কোনো প্রাণী নয়, এটি পৃথিবীর জন্য মূল্যবান। এছাড়া সংশ্লিষ্ট বিভাগের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রচারণা চালাতে হবে। কয়েকটি বিষয়ের ওপর জোর দিলে ডলফিন রক্ষা করা সম্ভব। যেমন- ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালানো, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও জুডিশিয়াল ক্ষমতা প্রয়োগ। আদালতের নির্দেশনা ডলফিন নিধন সহজে ঠেকানো সম্ভব।
শুশুককে বলা হয় নদীর প্রাণ। নদীতে শুশুক থাকা মানে সেখানে পর্যাপ্ত মাছ আছে। সেখানকার পানির গুণাগুণ আর জলীয় অবস্থা ভালো। শুশুকের প্রধান খাবার মাছ। তাই অনেকে ভাবেন, শুশুক থাকলে নদীতে মাছের সংখ্যা কমে যায়। কিন্তু শুশুক থাকলে নদীতে হয় তার উল্টোটা। শুশুক এমন সব প্রজাতির মাছ খায়, যেগুলো অন্যান্য মাছের বংশবৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর। একটি নদীতে বেশি শুশুক থাকা মানে ওই নদীতে মাছের সংখ্যা বেশি।
গোটা পৃথিবীতে শুশুকের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এর মধ্যে এক সুন্দরবনেই আছে প্রায় ২২৫টি শুশুক। পদ্মা–যমুনায় আছে প্রায় ২০০টি। কর্ণফুলী, সাঙ্গু, রূপসা, সুরমা, হালদাসহ অন্যান্য নদীতে ৫০০–এর মতো ডলফিন আছে। আমাদের দেশের নদীগুলোতে সব মিলিয়ে শুশুকের সংখ্যা হাজারখানেক, যা গোটা পৃথিবীর প্রায় এক–তৃতীয়াংশ
ধারাবাহিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর দেশে ৩০টির বেশি শুশুক মারা পড়ছে। প্রাণীটি মারা পড়ার জন্য ৮৭ শতাংশ দায়ী হলো কারেন্ট জাল।
গোটা পৃথিবীতে শুশুকের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এর মধ্যে এক সুন্দরবনেই আছে প্রায় ২২৫টি শুশুক। পদ্মা–যমুনায় আছে প্রায় ২০০টি। কর্ণফুলী, সাঙ্গু, রূপসা, সুরমা, হালদাসহ অন্যান্য নদীতে ৫০০–এর মতো ডলফিন আছে। আমাদের দেশের নদীগুলোতে সব মিলিয়ে শুশুকের সংখ্যা হাজারখানেক, যা গোটা পৃথিবীর প্রায় এক–তৃতীয়াংশ।
প্রকল্পটির বিষয়ে আইএমইডি’র সুপারিশসমূহ
১. বাস্তবায়িত কারিগরি সহায়তার প্রকল্পটির সঙ্গে অন্য কোনো প্রকল্পের সংযোগ স্থাপিত না হওয়ায় অর্জিত ফলাফলের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে না। বাস্তবায়িত প্রকল্পের ফলাফল এবং ফলাফলের সমন্বয়ে অর্জিত স্বল্পমেয়াদি সুফল এবং শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যভুক্ত সুবিধাভোগী ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিরূপণ করা সম্ভব। ভবিষ্যতে লক্ষ্যভুক্ত সুবিধাভোগী ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের বিষয়টি লক্ষ্য রেখে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হলো।
২. সার্ভিস কন্ট্রাক্ট-ইনডিভিজুয়াল ও সার্ভিস কন্ট্রাক্ট-প্রজেক্ট ম্যানেজার কাম টেকনিক্যাল অফিসার অঙ্গে সংশোধিত ডিপিপিতে অনুমোদিত সংস্থানের অতিরিক্ত অর্থব্যয় করা হয়েছে। এ ধরনের অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতিরেকে সংস্থানের অতিরিক্ত অর্থব্যয়ের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে যথাযথ ব্যাখ্যা আইএমইডিকে দিতে হবে।
৩. প্রকল্পের আওতায় প্রণীত ডলফিন কনজারভেশন অ্যাকশন প্ল্যান অব বাংলাদেশ, ডলফিন এটলাস অব বাংলাদেশ, ফান্ড ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন ফর ডলফিন কনজারভেশন টিম (ডিসিটি) অব সুন্দরবন, কমিউনিটি বেজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান অব ডলফিন স্যাঙ্কচুয়ারিজ অব সুন্দরবন ইত্যাদি প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক এখন পর্যন্ত অনুমোদন হয়নি। এসব প্রতিবেদনসমূহের প্রশাসনিক অনুমোদনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং প্রকল্পের সংগৃহীত যাবতীয় তথ্যাবলি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের পাশাপাশি কার্যকর ব্যবহারের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নিশ্চিত করতে হবে।
৪. ডলফিনের আবাসস্থল যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং ডলফিনের অভয়ারণ্য এলাকায় মাছের প্রজনন বিঘ্নিত না হয় তা বিবেচনায় নিয়ে আধুনিক ও কার্যকর টহল পরিচালনার জন্য বন বিভাগের স্টাফদের সামর্থ্য ও সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া ডলফিনের জন্য নির্ধারিত এলাকা পাহারার জন্য জিপিএস, রিসিভার, বাইনোকুলার, ইউনিফরম, লাইফ জ্যাকেট, ওয়ার্ম জ্যাকেট, ক্যামেরা, টর্চ লাইট, ব্যাটারি, মোবাইল ইত্যাদির মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা চলমান রাখতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এসআর/আরএইচ/এমএআর/