অনুসন্ধানে দুদক
৬৯ পাসপোর্ট অফিস থেকে ওঠে কোটি কোটি টাকার মাসোহারা!
দেশের ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে কর্মকর্তাদের নামে প্রতি মাসে ঘুষ বা মাসোহারা তোলা হয় ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা। যার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ আদায় হয় দালালের মাধ্যমে। এসব অর্থ কর্মকর্তাদের পদ অনুসারে বণ্টন করা হয়। এছাড়া রয়েছে পাসপোর্ট নবায়ন কিংবা ভুল সংশোধন বাবদ অবৈধ লেনদেন। মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় বিকাশ ও রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার এমন প্রতিবেদনসহ অভিযোগের নথিপত্র দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে এসেছে। যার ভিত্তিতে কমিশন থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগের নথিপত্রে ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের কর্মকর্তা মো. সাচ্চু মিয়া, পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক রফিকুল ইসলামসহ ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিবরণ রয়েছে। অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের অধীনে কর্মকর্তাও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
অভিযোগের নথিপত্রে ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের কর্মকর্তা মো. সাচ্চু মিয়া, পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক রফিকুল ইসলামসহ ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিবরণ রয়েছে
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ পর্যায়ে আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি তার ভিত্তিতে অনুসন্ধান শুরু করেছি। পাসপোর্ট অফিসের অনেক অভিযোগ আমাদের কাছে রয়েছে। সত্য কি মিথ্যা, তা অনুসন্ধান করে বের করা হবে।
‘অনুসন্ধান করে যদি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে মামলা হবে। মামলার পর তদন্তপূর্বক চার্জশিট দেওয়া হবে। অভিযোগের সত্যতা পেলে আমরা কাউকে ছাড় দেব না’— বলেন দুদক কমিশনার।
অন্যদিকে, দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন অনুসন্ধান-পর্যায়ে এসে কোনো মক্তব্য করতে রাজি হননি।
অভিযোগে যা আছে
দেশের ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে কর্মকর্তাদের নামে প্রতি মাসে ঘুষ তোলা হয় ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা। এছাড়া পাসপোর্ট নবায়ন কিংবা ভুল সংশোধন বাবদ অবৈধ লেনদেন হয় তিন থেকে পাঁচ কোটি টাকার মতো। বিভিন্ন হারে এ অর্থের ভাগ যথাসময়ে পৌঁছে যায় প্রধান কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পকেটেও।
দুদকের কাছে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতি মাসে গড়ে দুই লাখ ২৬ হাজারের বেশি পাসপোর্টের আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ জমা হয় দালালের মাধ্যমে। তাদের জমা করা আবেদনপ্রতি পাসপোর্ট কর্মকর্তারা ঘুষ নেন নির্ধারিত রেট এক হাজার টাকা করে। সে হিসাবে পাসপোর্ট আবেদন থেকে প্রতি মাসে ঘুষ আদায় হয় ১১ কোটি ৩২ লাখ টাকার বেশি। বিশাল অঙ্কের এ ঘুষের টাকা থেকে ১০ শতাংশ হারে অর্থাৎ এক কোটি সোয়া ১৩ লাখ টাকার মতো পাঠানো হয় ঢাকায় পাসপোর্টের প্রধান কার্যালয়ে।
এছাড়া আদায় হওয়া ঘুষের ৪০ শতাংশ অর্থাৎ চার কোটি ৫৩ লাখ টাকা সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক অফিসের প্রধানরা নেন। ঘুষের ১৮ থেকে ২০ শতাংশ অর্থাৎ দুই কোটি ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা পান সংশ্লিষ্ট সহকারী পরিচালকরা। বাকি ঘুষের টাকা অন্য কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।
প্রধান কার্যালয়ে আসা বিপুল অঙ্কের ঘুষের টাকা গ্রহণ ও বণ্টন করেন পাসপোর্টের অর্থ, প্রশাসন ও হিসাব শাখার চার-পাঁচজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা।
যেসব অফিসে মাসোহারা তোলা হয় তার আনুমানিক হিসাব ও পাসপোর্ট অফিসের নামের বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, ঘুষ হিসেবে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রতি মাসে তোলা হয় দেড় থেকে এক লাখ টাকা, যাত্রাবাড়ী থেকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা, ময়মনসিংহ থেকে ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা, কুমিল্লা থেকে মাসভেদে এক থেকে চার লাখ টাকা, মনসুরাবাদ থেকে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা, চান্দগাঁও, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নারায়ণগঞ্জ থেকে এক লাখ টাকা করে, সিলেট ও মৌলভীবাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা করে, মাদারীপুর ও বরিশাল পাসপোর্ট অফিস থেকে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে, বগুড়া থেকে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, হবিগঞ্জ থেকে ৫০ হাজার টাকা, নরসিংদী থেকে ২৫ হাজার টাকা, ফরিদপুর থেকে ২০ হাজার টাকা, সুনামগঞ্জ থেকে ১৫ হাজার টাকা, সাতক্ষীরা থেকে ১৫ হাজার টাকা, নোয়াখালী থেকে এক লাখ টাকা, যশোর থেকে ৫০ হাজার টাকা, লক্ষ্মীপুর থেকে ১৫ হাজার টাকা, কুষ্টিয়া ও শরীয়তপুর থেকে ১০ হাজার টাকা করে, চাঁদপুর থেকে ১৫ হাজার টাকা, ঝিনাইদহ থেকে ১০ হাজার টাকা, বাগেরহাট থেকে ১০ হাজার টাকা এবং রাজশাহী ও মুন্সীগঞ্জ থেকে ২৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে আদায় হয়।
বাংলাদেশের ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতি মাসে গড়ে দুই লাখ ২৬ হাজারের বেশি পাসপোর্টের আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ জমা হয় দালালের মাধ্যমে। তাদের জমা করা আবেদনপ্রতি পাসপোর্ট কর্মকর্তারা ঘুষ নেন নির্ধারিত রেট এক হাজার টাকা করে। সে হিসাবে পাসপোর্ট আবেদন থেকে প্রতি মাসে ঘুষ আদায় হয় ১১ কোটি ৩২ লাখ টাকার বেশি। বিশাল অঙ্কের এ ঘুষের টাকা থেকে ১০ শতাংশ হারে অর্থাৎ এক কোটি সোয়া ১৩ লাখ টাকার মতো পাঠানো হয় ঢাকায় পাসপোর্টের প্রধান কার্যালয়ে
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের বিষয়ে বিভিন্ন সময়েও অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগ এখন দুদকের হাতে।
এ বিষয় দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভিন্ন সময়ে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানে দালালদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। অনেক দালালকে আটক করে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। ফলে, দালালদের দৃশ্যমান উপস্থিতি কমলেও তাদের দৌরাত্ম্য কমেনি। দুদকে আসা এমন অভিযোগ অবাস্তব মনে হয়নি। আমার অভিযোগ যাচাই-বাছাই করছি। তবে, সমস্যা হচ্ছে ঘুষ লেনদেনের দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহ করা। এ বিষয়ে আমাদের চেষ্টা থাকবে। বাকিটা অনুসন্ধান শেষে বোঝা যাবে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে পাসপোর্ট অধিদপ্তরে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আরএম/এমএআর/