অভিনেতা মীর আফসার আলি ও তার বাবা

বাবা-মা’র বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কি ব্যস্ত জীবনে সন্তানের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়ে? যে মানুষগুলো একসময়ে আঙুল ধরে হাঁটতে শিখিয়েছিলেন, সময়ের অভাবে কি তাদের সঙ্গেই কথা বলা হয়ে ওঠে না সন্তানের? বিশ্ব আলঝাইমার্স (স্মৃতিভ্রংশ) দিবসে সেই কথাগুলোই যেন মনে করিয়ে দিলেন ওপার বাংলার অভিনেতা মীর আফসার আলি। বাবার উদ্দেশে লিখলেন এক আবেগঘন পোস্ট।

আলঝাইমার্স হচ্ছে মস্তিষ্কের এক ধরনের রোগ যাতে স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। এটি স্মৃতিভ্রংশ এবং ডিমেনশিয়া নামেও পরিচিত। 

ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, বিগত ৪ বছর ধরে মীরের বাবা ডিমেনশিয়ার সঙ্গে লড়ছেন। স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসছে তার। দিন, ক্ষণ, সাল, সময় কোনো কিছুই মনে থাকে না বিশেষ। তবে, ছেলেকে এখনও চিনতে পারেন। মীরের নাম ধরে ডাকেন। ‘আব্বা’ বললে সাড়া দেন। মীর জানালেন, বাবার চিকিৎসা চলছে। আর এই বিষয়ে তিনি খুব আশাবাদী। ডাক্তারদের ওপরও বিশ্বাস রেখেছেন তিনি।

বিশ্ব আলঝাইমার্স দিবসে মীরের স্মৃতিতে ভেসে উঠল বাবার এক জন্মদিনের কথা। যেদিন তিনি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “জন্মদিনে কী গিফ্ট চান?” ভীষণ উৎসাহিত মীরই বলে ফেলেছিলেন, “আব্বা, এই বছর আপনার জন্য আমার তরফ থেকে ঘড়ি।” তবে মুচকি হেসে তার বাবা বলেন, “ঘড়ি নয় বাপি, আমায় একটু সময় দিস।”

ডিমেনশিয়ার জন্য বাবার স্মৃতিতে আজ সেসব কথা ঝাপসা হয়ে গেলেও মীর মনে রেখেছেন সেই আবেগমাখা কথাগুলো। আর সেই প্রেক্ষিতেই সঞ্চালক-অভিনেতার মন্তব্য, “আপনার বাড়িতেও কি এমন কেউ আছেন যিনি কাজে মন দিতে পারছেন না, সব ভুলে যাচ্ছেন এক এক করে? অবহেলা করবেন না। দেরি করবেন না। তাদের দূরে ঠেলে দেবেন না। যাদের আজকাল মনে থাকে না, তাদের আরও বেশি করে মনে ধরে রাখুন।”

বাবা-ছেলের এমন রসায়নের কথা পড়ে নেটিজেনরা তো বটেই এমনকী তারকামহলের চোখেও জল। মীর আফসার আলির বাবার দ্রুত আরোগ্য কামনা করছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, রূপাঞ্জনা মিত্র থেকে শুরু করে আরও অনেকে। 

ডিমেনশিয়া বা আলঝাইমার্স কী? 

আমাদের মনের ঘরে জমা স্মৃতির দরজা কখনো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন স্মৃতিভ্রংশ বা ডিমেনশিয়া। ডিমেনশিয়া মস্তিষ্কের এক ধরনের রোগ যা মানুষের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে। এ রোগে স্নায়ুকোষ, তথ্যবাহী স্নায়ুতন্তু ও স্নায়ুসংযোগ নষ্ট হয়ে যায়। মস্তিষ্কের যেসব স্থানে স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে সেগুলিই প্রধানত আক্রান্ত হয় এই রোগে। এর ফলে রোগী কিছু মনে রাখতে পারেন না।

স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া মস্তিষ্কের এই রোগ আলঝাইমার্স নামেও পরিচিত। তবে আলঝাইমার্স ও ডিমেনশিয়া রোগের মধ্যে বয়সভেদে পার্থক্য রয়েছে। ডিমেনশিয়ার কারণে যেকোনো বয়সেই স্মৃতি হারিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, আলঝাইমার্স রোগের সাথে বয়স বাড়ার একটি সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত ৬৫ বছর ও এর পর থেকেই এই রোগের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। 

সেপ্টেম্বর মাসকে ডিমেনশিয়া ও আলঝাইমার্স সচেতনতা মাস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ২১ সেপ্টেম্বর আলঝাইমার্স দিবস হিসেবে পালন করা হয়। 

বাংলাদেশে স্মৃতিভ্রংশ রোগ

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগ বাড়ছে। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ যা আগামী ২০৩০ সালে বেড়ে ৯ লাখ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

বাংলাদেশ আলঝাইমার্স সোসাইটির হিসেব অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২২ লাখ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে ষাট বছরের বেশি বয়সের বয়সের মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে ৪০-৫০ বছরে বয়সের মধ্যেও অনেককে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। যারা দারিদ্রসীমার নীচে আছেন তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

স্মৃতিভ্রংশ রোগের চিকিৎসা

ডিমেনশিয়া ও আলঝাইমার্স রোগের তেমন কোনো চিকিৎসা নেই। তবে সচেতন হলে স্মৃতিভ্রংশ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। শরীর ভালো থাকলেই মস্তিষ্ক সুস্থ থাকবে। তাই সুস্থতার জন্য সুষম খাবার খাওয়া ও নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। 

খাদ্যাভ্যাসের কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় মস্তিষ্ক। অতিরিক্ত খাওয়া অথবা প্রয়োজনের তুলনায় কম খাওয়া স্মৃতি নষ্টের কারণ হতে পারে। তাই খাদ্য তালিকা সুষম খাবার রাখতে হবে। 

মস্তিষ্ক কর্মক্ষম রাখার জন্য শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতাও প্রয়োজন। তাই মনের যত্ন নিতে হবে। জীবনের সকল সময় সুসময় হয় না। সেটি মনে ও মেনে নিয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কোনভাবেই হতাশ হওয়া যাবে না। নিজেকে সবার থেকে গুটিয়ে নেওয়া যাবে না। দীর্ঘদিন একাকীত্ব ও হতাশায় ভুগলে স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এছাড়া উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের মধ্যে স্মৃতি হারানোর প্রবণতা বেশি।

ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ করতে প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কারণ, নিয়মিত ঘুম না হলে মস্তিষ্ক প্রয়োজনীয় বিশ্রাম পায় না। দীর্ঘদিন ধরে যারা অনিদ্রায় ভুগছেন, তাদের মধ্যে স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। 

অতীতে পরিবারের কারোর স্মৃতি হারানোর ইতিহাস থাকলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পরিবারে এ ধরনের ইতিহাস থাকলে, মস্তিষ্কে চাপ পড়ে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।

বয়স্কদের ওপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রাকৃতিক দূষণের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকেছেন তাদের মধ্যে স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার হার বেশি। তাই স্মৃতিশক্তি বাঁচাতে আমাদের চারপাশের পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে হবে। 

আমাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যদি কিছুক্ষণ আগের কোন কথা মনে না রাখতে পারা, কোন পরিকল্পনা বা ঘটনা ভুলে যাওয়া, প্রায়শই বাড়ির পথ ভুলে যাওয়ার মত ডিমেনশিয়ার লক্ষণগুলো দেখি তাহলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। 

স্মৃতিভ্রংশ রোগাক্রান্ত ব্যক্তি মানসিক রোগী নন 

অত্যন্ত দুঃখজনক হলো, এখনও ডিমেনশিয়া ও আলঝাইমার্স রোগীদের প্রায়ই পাগল বলে সম্বোধন করা হয় আমাদের সমাজে। এক্ষেত্রে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে আমাদের সচেতনতাই পারে আলঝাইমার্সের মতো রোগ থেকে বাঁচাতে। তা না হলে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতা বারবার ফিরে ফিরে আসবে- ডেকে ওঠো যদি স্মৃতিভেজা ম্লান স্বরে/ উড়াও নীরবে নিভৃত রুমালখানা/ পাখিরা ফিরবে পথ চিনে চিনে ঘরে/ আমারই কেবল থাকবে না পথ জানা।  

এইচকে