পুরো নাম শামসুন্নাহার স্মৃতি। তবে সবাই তাকে চেনেন পরীমণি নামে। ২০১৫ সালে সিনেমায় আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। অবশ্য তারও বছর দুয়েক আগে থেকে মডেলিং ও নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে শোবিজে তার হাঁটাচলা শুরু।

পরীমণি সুদর্শনা। তার রূপের আবেদনে কুপোকাত হয়েছেন দর্শক থেকে শুরু করে সিনেমা অঙ্গনের মানুষেরাও। আর সেজন্য অভিষেকের আগেই প্রায় দুই ডজন সিনেমা চলে আসে তার হাতে! ক্যারিয়ারের শুরুতেই কোনো নায়িকাকে নিয়ে এত হুলস্থূল ঢালিউডে সচরাচর দেখা যায়নি। এ ক্ষেত্রে পরীমণি একটা মাইলস্টোন গড়েছিলেন বলা যায়।

 

কিন্তু সেটাকে কি সাফল্যে রূপ দিতে পেরেছিলেন? উত্তরটা কম-বেশি সবারই জানা। পরীমণি প্রায় ৩০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। কিন্তু নায়িকা কিংবা অভিনেত্রী হিসেবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যটা তার ঝুলিতে আসেনি। পুরো ক্যারিয়ারে তার প্রাপ্তি কেবল ‘স্বপ্নজাল’ থেকে কিছু প্রশংসা।

ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে পরীমণি যতগুলো সিনেমায় কাজ করেছিলেন, প্রায় সবগুলোই ছিল মানহীন। পরিচালক-প্রযোজকদের নির্দেশে অপ্রাসঙ্গিকভাবে খোলামেলা রূপে হাজির হওয়া, গানের দৃশ্যে শরীর প্রদর্শনের ধারাবাহিকতা পরীমণিকে প্রশংসার বদলে বরং নিন্দাই দিয়েছে। তবে সেই অবস্থা থেকে নিজেকে আঁজলা ভরে তুলে এনেছেন পরীমণি। যা তার ক্যারিয়ারের সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েকটা সিনেমা দেখলেই বোঝা যায়। যদিও অভিনয়ে তার যথেষ্ঠ ঘাটতি রয়েছে। তবে সেটা সময় ও চেষ্টার সঙ্গে পূরণ হয়ে যাবে; এমনটা আশা করা ভুল নয়। 

মানুষের কাছে পরীমণির গ্রহণযোগ্যতা কেমন ছিল, সেটা তার ফেসবুক পেজের কমেন্ট বক্সে চোখ রাখলে কিছুটা বোঝা যায়। আর বোঝা যায় তার সিনেমাগুলোর সাফল্য-ব্যর্থতার সমীকরণ দেখলে। সিনেমার সাফল্যের সুবাদে নয়, পরীমণি যেটুকু পরিচিত, সেটা তার ফেসবুকের কল্যাণে। আকর্ষণীয় সব ছবি শেয়ার করে তিনি পরিচিতি এবং সমালোচনা দু’হাতে কামিয়েছেন। কিন্তু তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়।

এবার আসা যাক সাম্প্রতিক প্রসঙ্গে। গত ৪ আগস্ট পরীমণিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রশাসনের অভিযোগ, তিনি বাসায় মাদক রেখেছেন এবং অবৈধ কাজ করেছেন। এ জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। সেই মামলার তদন্তও চলছে। গ্রেফতারের পর প্রায় সকলেই একবাক্যে ভেবেছেন, পরীমণির ক্যারিয়ার শেষ। অর্ধ যুগের ক্যারিয়ারে তিনি যেটুকু অর্জন করেছেন, সবটাই ধূলিসাৎ।

আসলেই কি ব্যাপারটা তাই? এর উত্তর মিলিয়ে নেবেন পাঠকরা। তবে তার আগে বর্তমান প্রেক্ষাপটের চিত্রটা জেনে নেওয়া যাক। পরীমণি গ্রেফতার হওয়ার পর প্রথম দিকে ঢালাওভাবে সবাই সমালোচনায় মেতেছিলেন। এমনকি শোবিজ অঙ্গনের মানুষেরাও ছিলেন তার বিপক্ষে। কিন্তু চিত্র পাল্টে গেছে গত কয়েক দিনে। এখন একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ পরীর সমর্থনে আওয়াজ তুলছেন। সাধারণ মানুষ তো বটেই, সিনেমা অঙ্গনের অনেকেও পরীর পক্ষে কথা বলছেন।

দেশের ১৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক এ বিষয়ে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, তারা পরীমণিকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। এছাড়া বেশ কয়েকজন লেখক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পরীমণির পক্ষে তাদের মতামত উপস্থাপন করেছেন।

একটি গণমাধ্যমে মেরিলিন মনরো ও পরীমণিকে একই সূত্রে গেঁথে একটি মতামত প্রকাশিত হয়েছে। সেটা নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে শেয়ার করে দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান লিখেছেন, “এই লেখাটি সেই দুজন মন্দ মেয়েদের নিয়ে, যাদের জন্য একদিন আমাদেরই এক কবি লিখেছিলেন অসামান্য একটি কবিতা- ‘ইউ মে কল হার আ ব্যাড গার্ল! আ ম্যাড গার্ল। বাট আই নো ইউ লিসন টু মি, শি ইজ আ স্যাড গার্ল! আ রেড গার্ল।”

 

অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন লিখেছেন একটি দীর্ঘ কলাম। তার ভাষ্য, ‘পরীমণির ক্ষেত্রে মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে যা করা হচ্ছে সেটা ন্যাক্কারজনক। এটাই সমাজের আসল চেহারা। এই মিডিয়া ট্রায়ালের কোনো দরকার ছিল না। আমি যদি কোনো অপরাধ করে থাকি, তবে প্রথমে প্রমাণ, এরপর বিচার, শাস্তি। অপরাধ অনুযায়ী শাস্তিরও কম-বেশি ব্যাপার আছে। কিন্তু তা যদি সমাজ বা রাষ্ট্রের একেবারেই লিঙ্গভিত্তিক আচার আচরণ হয়ে যায়, সেটা দুঃখজনক, ভয়ের এবং আতঙ্কের।’

কিংবদন্তি গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক প্রিন্স মাহমুদও সরব হয়েছেন পরীমণি ইস্যুতে। তিনি লিখেছেন, “আমি নিশ্চিত এই মেয়ে কোনো ভাল গাইডলাইন পায় নাই। অবাক লাগছে, যে মানুষগুলো তার সাথে কাজ করেছেন, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন, কেউ কোনো কথা বলছেন না। যেটুকু অন্যায় সে করেছে, তার থেকে অনেক অনেক বেশি শাস্তি সে পেয়ে গেছে। এবার একটু দয়া করেন। আর যদি এখনো মনে হয় তার শাস্তি হয় নাই, তবে তিন্নির মতো কাচপুর ব্রিজের উপর থেকে বস্তায় বেঁধে ছুড়ে ফেলে দেন অথবা তাকে মাটিতে অর্ধেক পুঁতে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলেন। তাও প্রতিদিন এমনভাবে টানা-হ্যাঁচড়া করে এমন অপমান; একজন সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে আর নিতে পারছি না।”

গুণী অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি বলেছেন, ‘পরীমণির বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে প্রশাসন। আইন অনুযায়ী যা হওয়ার তাই হবে। তবে একজন নারী হিসেবে অবশ্যই আমি তার পক্ষে। পরীমণি তো একদিনে তৈরি হয়নি। একটি সোসাইটি তাকে তৈরি করেছে। আমি সেই সোসাইটির বিপক্ষে।’

এভাবে আরও অনেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, পরীমণির মুক্তির দাবি করছেন। অতীতে পরীমণির বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা হয়েছে বটে। কিন্তু এভাবে তার সমর্থনে কেউ কথা বলেননি। অবৈধ মাদকসহ তাকে গ্রেফতারের পর অনেকেই ‘জাত গেল জাত গেল’ সুরে আওয়াজ তুলেছেন। কিন্তু সপ্তাহ খানেক যাওয়ার পর এখন তারা উপলব্ধি করছেন আসল বিষয়টি। পরীমণির জন্ম, বেড়ে ওঠা, তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া বীভৎস সব ঘটনা জানার পর অনেকের মনেই তার প্রতি ইতিবাচক ভাবনা জেগে উঠেছে।

কেআই