বেঁচে থাকলে ৮০-তে পা রাখতেন তিনি
বেঁচে থাকলে বয়স ৮০-তে পা রাখতেন কিংবদন্তি গীতিকবি ও চলচ্চিত্রকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে’— কবিতার চরণের মতো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তার কর্মের মাধ্যমে চির ভাস্বর হয়ে আছেন তিনি। গত বছরের শেষ দিকে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই গুণী ব্যক্তিত্ব। সে হিসেবে মৃত্যুর পর আজ তার প্রথম জন্মদিন।
আজকের এই বিশেষ দিবসে গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছেন তার ভক্ত-শুভাকাঙ্খী, সহকর্মী ও শিল্পজগতের মানুষেরা। তবে পারিবারিক মহলে দিনটি ঘিরে তেমন কোনো উদযাপন থাকছে না বলে জানান মেয়ে দিঠি আনোয়ার।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, ‘যেহেতু আব্বু নেই, তার জন্মদিনে কোনো কেক কাটা বা উদযাপন হবে না। তবে অসহায় ও এতিমদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছি। তারা যেন আব্বুর জন্য দোয়া করে, সেজন্য এ আয়োজন।’ এর বাইরে দুটি টিভি অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন দিঠি। সেখানে বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ ও তার লেখা বিখ্যাত কিছু গান পরিবেশন করবেন।
১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার তালেশ্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। লেখালেখির সূচনা ছোটবেলাতেই। তবে পেশাদার গান লেখা শুরু হয় ১৯৬৪ সালে রেডিও পাকিস্তান থেকে। এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) জন্মলগ্ন থেকেই নিয়মিত গান ও নাটক রচনা করেছেন তিনি।
সিনেমায় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের প্রথম লেখা গান ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’। এটি ১৯৬৭ সালের ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছিল এবং গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো। ফলশ্রুতিতে পরবর্তী সময়ে গীতিকবি হিসেবে তার পথচলা সুগম হয়।
১৯৮২ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তার নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘নান্টু ঘটক’। এরপর তিনি ‘শাস্তি’, ‘স্বাধীন’, ‘চোর’, ‘সন্ধি’, ‘স্বাক্ষর’, ‘শর্ত’, ‘সমর’, ‘শ্রদ্ধা’, ‘স্নেহ’, ‘আম্মা’, ‘পরাধীন’, ‘তপস্যা’, ‘উল্কা’, ‘ক্ষুধা’, ‘রাগী’, ‘আর্তনাদ’, ‘জীবনের গল্প’, ‘এই যে দুনিয়া’, ‘পাষাণের প্রেম’ ও ‘হৃদয় ভাঙা ঢেউ’ সিনেমাগুলো নির্মাণ করেন।
ছয় দশকের ক্যারিয়ারে গাজী মাজহারুল আনোয়ার রচনা করেছেন ২০ হাজারের অধিক গান। বিবিসি বাংলা তৈরি করা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশটি বাংলা গানের তালিকায় ঠাঁই পায় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা তিনটি গান।
তার লেখা কিছু কালজয়ী গান হলো- ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা’, ‘ইশারায় শিস দিয়ে’, ‘চোখের নজর এমনি কইরা’, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’, ‘চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে’ প্রভৃতি।
গীতিকবি সংঘের আজীবন সদস্য ছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ২০০২ সালে একুশে পদক এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীন দেশের সর্বপ্রথম পুরস্কার ‘বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড’ও পেয়েছিলেন এই নন্দিত ব্যক্তিত্ব। এছাড়াও ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একাধিকবার বাচসাসসহ বিভিন্ন সম্মাননা অর্জন করেন তিনি।
গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর মারা যান গাজী মাজহারুল আনোয়ার। পর দিন (৫ সেপ্টেম্বর) বনানী কবরস্থানে মা খোদেজা বেগমের কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হন তিনি। বিভিন্ন সময়ে তার গানে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, প্রকৃতি, জীবনবোধ, প্রেম, বিরহ, স্নেহ’সহ আরও নানা প্রসঙ্গ।