প্রতিটা কাজের শেষে মনে হয় নির্মাতা হয়ে ভুল করেছি: আশফাক নিপুণ
তার নামের শেষ অংশ-নিপুণ। এই নামের সঙ্গে তার কাজের বৈশিষ্ট্যের মিল পাওয়া যায়। নিপুণভাবেই তিনি প্রতিটি কনটেন্ট নির্মাণ করেন। তিনি আশফাক নিপুণ। এ প্রজন্মের অন্যতম মেধাবী এবং সফল নির্মাতা।
সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘মহানগর’ ওয়েব সিরিজেও আশফাক নিপুণ তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছেন। ইতোমধ্যে সিরিজটি বাংলাদেশ ও কলকাতায় আলোড়ন তৈরি করেছে। বলা হচ্ছে, এটি বাংলা ভাষায় নির্মিত সেরা ওয়েব সিরিজ। যেই ‘মহানগর’ নিয়ে এতো আলোচনা, প্রশংসা; সেটার নির্মাণের পেছনের গল্পটা কেমন ছিল? মুক্তির পরের এই সাফল্য কীভাবে দেখছেন নির্মাতা? এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্ট-এর সঙ্গে। সেই আলাপে উঠে এসেছে নিপুণের ক্যারিয়ারের অন্য প্রসঙ্গও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কামরুল ইসলাম।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্ট: ‘মহানগর’ তো শুধু মহানগর না, পুরো দেশ এমনকি কলকাতাও কাঁপিয়ে দিলো! কী বলবেন?
আশফাক নিপুণ: প্রথমেই বলব এটা স্বস্তিদায়ক। কারণ আমরা পুরো টিম অনেক কষ্ট করেছি। তাছাড়া ‘মহানগর’ আমাদের সবার প্রথম ওয়েব সিরিজ। আমার নিজের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না ওয়েব সিরিজ বানানোর। এটা যেহেতু একটা বড় প্রজেক্ট, সেক্ষেত্রে কেমন হবে, প্রতিটা পর্ব দর্শকদের ধরে রাখতে পারবে কিনা; এরকম অনেক কিছুই ভাবতে হয়েছে। তবে আমি অসাধারণ একটি টিম পেয়েছি কাজটি করার জন্য। অভিনয়শিল্পী থেকে শুরু করে কলাকুশলী প্রত্যেকটা মানুষ নিজের জায়গায় সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়েছেন। যার সুবাদে সুন্দরভাবে কাজটি করতে সক্ষম হয়েছি।
ঢাকা পোস্ট: নির্মাণের আগে কিংবা নির্মাণের সময় ভেবেছিলেন, কাজটা এতো সাড়া পাবেন?
আশফাক নিপুণ: সত্যি বলতে আমি একদমই ভাবিনি এতোটা সাড়া পাবো। দর্শক আমার কাজ পছন্দ করেন, আমার ওপর বিশ্বাস রাখেন; এটা অনুভব করি। তবে ‘মহানগর’ বাংলাদেশ এবং কলকাতায় এতো বেশি মানুষের মন জয় করবে, এটা অভাবনীয়। কারণ কাজটার মধ্যে এখনো আমার অপূর্ণতা দেখতে পাই। আমি এখনো বিশ্বাস করি, কাজটি আরও সময় নিয়ে করলে আরও ভালো করতে পারতাম। তবে আমি যা-ই বানিয়েছি, সেটা দর্শকরা এতো ভালোবেসে গ্রহণ করেছে, এটা ভীষণ আনন্দের ব্যাপার।
ঢাকা পোস্ট: অপূর্ণতা রয়ে গেছে কেন? কী সীমাবদ্ধতা ছিলো?
আশফাক নিপুণ: কোনো সীমাবদ্ধতা ছিলো, তা কখনোই বলবো না। কারণ আমাকে সব দিক থেকেই পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিলো। একটা কাজ করার জন্য যত সুযোগ-সুবিধা দরকার হয়, পুরোটাই পেয়েছি আমি। এখানে ‘আরো ভালো করতে পারতাম’ বিষয়টা হলো নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধের মতো। আমি এখন যেটা বানিয়েছি, সেটা আমার শতভাগ পছন্দ হয়নি। আমার মনে হয়, আমি মাত্র ফিফটি পার্সেন্ট বানিয়েছি। আমার আরো ফিফটি পার্সেন্ট দেওয়ার ছিল, আরও ভালো করার ছিল।
ঢাকা পোস্ট: ওসি হারুনের চরিত্রের জন্য মোশাররফ করিম ছাড়া অন্য কাউকে ভেবেছিলেন?
আশফাক নিপুণ: এটা বললে হয়ত অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কিন্তু সত্যি হলো, আমি আসলেই এই চরিত্রের জন্য অন্য কাউকে ভাবিনি। যখন চরিত্রটা সাজাচ্ছিলাম, তখনই আমি মোশাররফ ভাইয়ের কথা মাথায় রেখে এগিয়েছি। আমার মনে হয়েছে, হারুন চরিত্রের জন্য মোশাররফ ভাই-ই পারফেক্ট। শুধু ওসি হারুন নয়, সিরিজের প্রত্যেকটা চরিত্র লেখার সময় আমি যাকে ভেবেছিলাম, তাকেই নিয়েছি।
ঢাকা পোস্ট: সিরিজটির পুরো শুটিং রাতে হয়েছে। রাতে শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো?
আশফাক নিপুণ: সাধারণত দিনের শুটিংয়ে আমরা দিন ও সন্ধ্যা রাত মিলিয়ে প্রায় ১৬ ঘণ্টা সময় পাই। কিন্তু ‘মহানগর’-এর গল্পটা রাতের। তাই আমাদের কেবল রাতেই শুট করতে হয়েছে। যার ফলে আমরা সময় অনেকটা কম পেয়েছি। আবার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটা শেষের একটা চিন্তা ছিলো। সে কারণে সময়ের সমন্বয় করা বেশ কঠিন ছিলো। এ প্রসঙ্গে আরেকটা বিষয় বলা প্রয়োজন। মধ্যরাতের পর কিন্তু সবার শরীরই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কাজের এনার্জি কমে আসে। এটা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ছিলো। তবে প্রত্যেকটা সদস্যের পূর্ণ সহযোগিতার ফলে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি আমরা।
ঢাকা পোস্ট: আপনার নাটক দর্শকরা পছন্দ করে। এরপরও কাজ কম কেন?
আশফাক নিপুণ: মনের ভেতর থেকে তাড়না না আসলে আমি কোনো কাজ করি না। ক্যারিয়ারের একদম শুরু থেকেই আমি এটা খুব গুরুত্বের সঙ্গে মেনে আসছি। বেশি টাকা কামানোর জন্য কেবল করার জন্য কিছু করতে চাই না। আমি যেই গল্পটা বলতে চাই, সেটার উদ্দেশ্য কী? গল্পটা আমি নিজে বিশ্বাস করি কিনা, আমার গল্পটা দর্শকদের কিছুটা হলেও নতুনত্ব দেবে কিনা, নতুন একটা বার্তা তারা পাবে কিনা, এই সমস্ত বিষয় আমাকে ভাবতে হয়। তাছাড়া কোনো নাটক বা কনটেন্টে ‘বানিয়েছেন আশফাক নিপুণ’ কথাটা দেখলে দর্শকদের মনে আলাদা আগ্রহ তৈরি হয়। তারা বিশ্বাস রাখেন, এটা ভালো কিছুই হবে। তাদের সেই বিশ্বাস আর প্রত্যাশার দিক বিবেচনা করেও কাজ করতে হয়। দর্শক, প্রযোজক এবং টিভি চ্যানেল থেকে প্রচুর চাপ আসে, যেন বেশি কাজ করি। কিন্তু আমি সেটাতে সায় দেই না। দশটা কাজ করলাম, দুইটা নিয়ে আলোচনা হলো; আমি এটা চাই না। আমি দুইটা কাজ করবো, সেই দুইটা নিয়েই আলোচনা হবে; এটাই আমার বিশ্বাস।
ঢাকা পোস্ট: নির্মাতা হিসেবে একটা কনটেন্টের কোন দিকটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন? গল্প-চিত্রনাট্য, নির্দেশনা নাকি তারকা?
আশফাক নিপুণ: আমি বিশ্বাস করি, একটা কনটেন্টের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নির্মাতার সততা। এটার কোনো বিকল্প নেই। কোনো কাজ করতে গেলে নির্মাতাকে আগে সৎ হতে হবে। সেই সততা থাকবে তার গল্পের প্রতি আর তার নির্মাণশৈলির প্রতি। দর্শকরা একটা কাজ কিন্তু হৃদয় দিয়ে দেখেন। তারা অনেক কিছু উপলব্ধি করেন। কোনো একটা দায়সারা কাজ দেখলে তারা সেটা বুঝতে পারেন। সেজন্য একজন নির্মাতাকে তার কাজের প্রতি শতভাগ সৎ হতে হবে।
ঢাকা পোস্ট: কখনো কি মনে হয়, নির্মাতা হয়ে ভুল করেছেন?
আশফাক নিপুণ: এই প্রশ্নের জবাব দুইটা। পেশা নিয়ে যখন থেকে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল, তখন থেকেই আমি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম যে, আমি নির্মাতা হব। নির্মাতা না হয়ে যদি কোনো কর্পোরেট পারসন হতাম, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ডাক্তার বা যেকোনো বড় পেশাজীবী হতাম, তাহলে আমি বেশি ভালো করতাম; এটা আমার কখনোই মনে হয়নি। আর দ্বিতীয় জবাব হলো-প্রতিটা কাজের শেষ মুহূর্তেই আমার মনে হয় নির্মাতা হয়ে ভুল করেছি। এটা আসলে আমার কাজ না। এর পেছনে ব্যাখ্যাও আছে। আমি একটা কাজ বানানোর পর একেবারে ডেলিভারি দেয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সেটার কারেকশন করি। এতোটাই খুঁতখুঁতে আমি! তো শেষ মুহূর্তের যেই চাপটা আসে, সেটা সামলাতে গিয়েই আমার মনে হয়, আমার ক্যারিয়ার বোধহয় শেষ! নির্মাতা হয়ে আসলে ভুল করেছি।
ঢাকা পোস্ট: ‘গোল্লা’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেটার আপডেট কী?
আশফাক নিপুণ: ঘোষণা না ঠিক, এক জায়গায় কথায় কথায় বলেছিলাম সিনেমাটির কথা। আসলে সিনেমার বাস্তবতাটা এখন চেঞ্জ হয়ে গেছে। করোনা মহামারির কারণে অনেক কিছুই বদলে গেছে। এখন চাইলেই কোনো লোকেশনে গিয়ে শুটিং করা সম্ভব নয়। যার কারণে ‘গোল্লা’র পরিকল্পনা একেবারে নতুন করে সাজাতে হচ্ছে। এছাড়া সিনেমা হলের সংকট, করোনা মহামারির মধ্যে মানুষ সিনেমা দেখতে যাবে কিনা, এই সমস্ত বিষয় ভাবতে হচ্ছে। তাই পরিস্থিতি বিবেচনা করে সময় নিয়ে পরে সিনেমা নির্মাণে হাত দেবো। আপাতত ওয়েব কনটেন্টে মনোযোগ দিতে চাই।
ঢাকা পোস্ট: ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
আশফাক নিপুণ: আপনাকে এবং ঢাকা পোস্ট-কেও ধন্যবাদ।
কেআই/আরআইজে