শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে প্রায় ছয় দশকের দীর্ঘ কর্মজীবনের ইতি টেনে না ফেরার দেশে চলে গেলেন কিংবদন্তি অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান। মূল নাম আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান হলেও এটিএম শামসুজ্জামান নামেই তিনি তুমুল জনপ্রিয়তা পান। সিনেমা, নাটক, টেলিফিল্ম সব মাধ্যমেই সমান উজ্জ্বল ছিলেন দেশ বরেণ্য এই অভিনেতা।

১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের ভোলাকোটের বড় বাড়ি। শৈশব-কৈশোর কেটেছে পুরান ঢাকার দেবেন্দ্রনাথ দাস লেনে। ঢাকার পগোজ স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহীর লোকনাথ হাই স্কুলে কেটেছে তার শিক্ষাজীবন। ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চতর শিক্ষালাভ করেন এটিএম শামসুজ্জামান।

১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এরপর খান আতাউর রহমান, কাজী জহির, সুভাষ দত্তের মতো বিখ্যাত পরিচালকদের সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন।

কিছুদিন আগেই এটিএম শাসমুজ্জামানকে দেখতে তার বাসায় যান চিত্রনায়িকা মৌসুমী 

তবে এটিএম শামসুজ্জামানের অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল কৌতুক অভিনেতা হিসেবে। সে সময় তিনি বেশ কয়েকটি সিনেমায় কৌতুকাভিনেতার ভূমিকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেন। কৌতুক অভিনেতা হিসেবে তার অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘জলছবি’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘রামের সুমতি’, ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘চুড়িওয়ালা’ ইত্যাদি। কৌতুক চরিত্রে তিনি সে সময় বেশ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিলেন।

এরপর খল অভিনেতা হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। ১৯৭৬ সালে আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ সিনেমার মধ্য দিয়ে খল চরিত্রে এটিএম শামসুজ্জামানের অভিষেক। এরপর পর তিনি অনেক বছর ধরে খল চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সেখানেও তিনি ছিলেন নিজের সময়ের অন্যতম সেরা। খল চরিত্রে এটিএম যেসব সিনেমায় অভিনয় করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘অনন্ত প্রেম’, ‘দোলনা’, ‘অচেনা’, ‘মোল্লা বাড়ির বউ’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘চোরাবালি’ প্রভৃতি।

এটিএম শামসুজ্জামান অভিনীত সিনেমার তালিকাটাও অনেক লম্বা। এরমধ্যে বেশিরভাগ সিনেমাতেই সফল হয়েছিলেন তিনি। এমন কিছু সিনেমা হলো-‘বড় বউ’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘লাঠিয়াল’, ‘নয়নমনি’, ‘অশিক্ষিত’, ‘সুর্য দীঘল বাড়ি’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘লাল কাজল’, ‘দায়ী কে?’, ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘আমার স্বপ্ন তুমি’, ‘দাদীমা’, ‘ডাক্তার বাড়ি’, ‘চাঁদের মতো বউ’, ‘গেরিলা’, ‘লাল টিপ’ ইত্যাদি।

‘জায়গীর মাস্টার’ সিনেমায় অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান 

চিত্রনাট্যকার এবং কাহিনীকার হিসেবেও সফল ছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান। তার চিত্রনাট্যে প্রথম সিনেমা ‘জলছবি’। পরবর্তীতে তিনি শতাধিক সিনেমার চিত্রনাট্যও লিখেছেন। একমাত্র সিনেমা ‘ইবাদত’ নির্মাণ করেও মানুষের ব্যাপক প্রশংসা কুড়ান এই অভিনেতা।

শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনবার, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে একবার, শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্রে একবার এবং আজীবন সম্মাননা হিসেবে একবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ২০১৫ সালে শিল্পকলায় অসামান্য অবদান রাখায় একুশে পদক লাভ করেন তিনি।

টিভি নাটকেও এটিএম শামসুজ্জামান ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নাটক-টেলিফিল্মে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত শত শত নাটক রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-‘রঙের মানুষ’, ‘ভবের হাট’, ‘শিলবাড়ি’, ‘ঘর কুটুম’, ‘বউ চুরি’, ‘নোয়াশাল’, ‘শতবর্ষে দাদাজান’, ‘সেরা কিপ্টুস’, ‘নাপিত’, ‘গরু চোর’, ‘মুরুব্বি জামাই’, ‘আমার বউ বেশি বুঝে’, ‘পিতা পুত্র’, ‘সিন্দুকনামা’, ‘ওস্তাদজি’, ‘আক্কেল আলীর নির্বাচন’, ‘ইলু ইলু’, ‘শোধবোধ’, ‘এই যে দুনিয়া’, ‘তরিক আলী হাডারি’ ইত্যাদি।

আরআইজে