ওটিটি কপাল খুলে দিলো তাদের
একটা কথা প্রচলিত আছে-শিল্পীর শিল্পই তার পরিচয় তুলে ধরে, শিল্পী কোন মাধ্যমে কাজ করছেন-সেটা ব্যাপার না। তবে দিন যত যাচ্ছে, ‘ব্যাপার না’ ব্যাপারটাই তত প্রকট ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে মাধ্যম নিয়ে কথা হচ্ছে, তার নাম ‘ওটিটি প্ল্যাটফর্ম’-পুরো নাম ‘ওভার দ্য টপ প্ল্যাটফর্ম’। পাশের দেশ ভারতে ‘স্যাক্রেড গেমস’ দিয়ে বেশ ভালোভাবেই যাত্রা শুরু করেছিল এই প্লাটফর্ম। তবে করোনার কারণে সিনেমা হলের অবস্থা যখন বিপর্যস্ত, তখন ওটিটি প্লাটফর্ম যেন সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছে। বড় পর্দার পরিচালকেরা দিন দিন ওটিটি প্ল্যাটফর্মেই ঝুঁকছেন।
শুরুটা অমিতাভ বচ্চন আর আয়ুষ্মান খুরানার ‘গুলাবো সিতাবো’ দিয়ে হলেও, এরপরে একে একে ‘লক্ষী’, ‘শকুন্তলা’, ‘দিল বেচারা’, ‘লুডো’ এবং আরও অনেক সিনেমা এখন সরাসরি ওটিটি প্ল্যাটফর্মেই মুক্তি পাচ্ছে। হল মালিকরা এসব ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভের গুড় পরিচালক আর প্রযোজকেরা ঠিকই খাচ্ছেন। এসব সিনেমার পরিচালকেরা বেশ পরিচিত মুখ। তবে ওটিটির কারণে অনেক পরিচালক নতুনভাবে পরিচিত হচ্ছেন। আজ তাদের মাঝে কয়েকজনকে নিয়ে আলাপ করব। এদের মাঝে অনেকে অনেক বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করলেও, বড় পর্দায় সেই নামটা করতে পারেননি। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম কপাল খুলে দিয়েছে তাদের-
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন জগতে কাজ করেছেন ১৪ বছর ধরে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার চেয়ে বই পড়াই বেশি পছন্দের কাজ ছিল তার। পড়াশোনা বেশি ছিল বলেই হয়ত লেখালেখির হাতটা ভালো ছিল। যশরাজ স্টুডিওতে সংলাপ লেখকের সহকারী হিসেবে চাকরি পান, একসময় সহকারী থেকে নিজেই সংলাপ আর গান লেখা শুরু করেন। ‘খুদা জানে কে’, ‘ছালিয়া’, ‘শাট আপ অ্যান্ড বাউন্স’-এর মত সুপারহিট গান বেরিয়েছে অনভিতার কলম থেকে। ‘হে বেবি’, ‘বাচনা এয় হাসিনো’, ‘পাটিয়ালা হাউজ’, ‘কুইন’, ‘স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’-এর মত সিনেমাগুলোর সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন কখনও গীতিকার হিসেবে আবার কখনও সংলাপ লেখক হিসেবে। ‘কুইন’ সিনেমার অনবদ্য সংলাপ তারই লেখা। তবে এই মানুষটার পরিচালনা করার ক্ষিদেটা সবসময়ই ছিল, সেটাই মেটালো নেটফ্লিক্স। ‘বুলবুল’ নামক সিনেমা দিয়ে পরিচালনার চেয়ারে বসলেন আর এক অর্থে বাজিমাত করলেন তিনি। পেছন থেকে প্রযোজক হিসেবে যোগ্য সঙ্গ দিলেন আনুশকা শর্মা।
করণ অংশুমান ও গুরমিত সিং
একজনের ঝুলিতে ‘বাঙ্গিস্তান’ নামের একটি চূড়ান্ত ফ্লপ সিনেমা আর আরেকজনের ক্যারিয়ারে ‘ওয়ার্নিং’, ‘শরাফত গেয়ি তেল লেনে’ এর মত একাধিক ফ্লপ। টানা এতসব ফ্লপ সিনেমার নাম পড়ার পর খুব কম পাঠকের বিশ্বাস হবে যে এই দুইজনই ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘মির্জাপুর’-এর পরিচালক! দুইজনের পরিচয়টা কম না, ১৫ বছরের। এর আগে তারা ‘ইনসাইড এজ’এর মত আরেকটি সফল সিরিজও উপহার দিয়েছিলেন। তবে মির্জাপুর সবকিছুর মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। একসময় একের পর এক ফ্লপ সিনেমা দেওয়া এই পরিচালকযুগলের সঙ্গে এখন এক বাক্যে কাজ করতে চাওয়া অভিনেতার অভাব নেই!
কখনও সিনেমা পরিচালনা করেননি, তবে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন ‘চশমে বদ্দুর’, ‘টেবিল নং ২১’ এর মত সিনেমায়। তবে এই মানুষটা সবাইকে চমকে দিলেন অ্যামাজনের সঙ্গে ‘ব্রেথ’ নামক সিরিজের প্রথম সিজন বানিয়ে। অমিত সাধ আর মাধবনকে যেন নতুন করে চেনালেন তিনি। সিরিজের দ্বিতীয় সিজনের পরিচালনার দায়িত্বও তার কাঁধে পড়েছিল। সেই দায়িত্ব আর জুনিয়র বচ্চনকে ওয়েব সিরিজের দুনিয়ায় ঠিকঠাক করে তুলে ধরে পালিয়েছেন তিনি। অথচ একটা সময় এমনও হয়েছে, সিনেমার বানানোর জন্য কিছুতেই প্রযোজক পেতেন না তিনি।
‘গো গোয়া গন’ আর ‘হ্যাপি এন্ডিং’ নামের দুইটি সিনেমার বক্স অফিসে ব্যর্থতা দেখে এই দুইজন অনেকটা ধরেই নিয়েছিলেন যে, সিনেমা নির্মাণ আর তাদের দিয়ে হবে না। মনকে তাও কিছুটা খুশি করার জন্য ‘স্ত্রী’ নামে সিনেমা প্রযোজনা করে সাফল্যের মুখ দেখেছিলেন। কিন্তু তাতে কি আর দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে? নিজেদের সেরা কাজটি তারা লুকিয়ে রেখেছিলেন অ্যামাজনের জন্য। ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’ নামের এই সিরিজকে নিঃসন্দেহে এখন পর্যন্ত অ্যামাজনের অন্যতম জনপ্রিয় আর সুনির্মিত ওয়েব সিরিজ বলা হয়। সিরিজের সিজন ওয়ানের ৬ নম্বর পর্বে যে বিরাট ওয়ান টেক শট ছিল, সেটা ভারতীয় ওয়েব সিরিজের দুনিয়ায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ওয়ান টেক শট, ১৬৩৮০ ফ্রেম দেখবেন আপনি দর্শক হিসেবে পুরো শটে। রাজ অ্যান্ড ডিকে এখন যে আলোচনার তুঙ্গে, তার আরেকটি প্রমাণ হলো, খুব শিগগিরই শাহরুখ খানের সঙ্গে কাজ করতে যাচ্ছেন তারা।
নাম শুনে তাকে না চিনলেও, ‘রোডিজ’ নামক শোয়ের দর্শক হয়ে থাকলে চেনার কথা। ‘রোডিজ’-এ রঘু রামের মিমিক্রি করতেন যে মানুষটা, তিনিই দীপক মিশ্র। অ্যামাজনে ‘পঞ্চায়েত’ নামক মিষ্টি স্বাদের এক ওয়েব সিরিজের নির্মাতা তিনি। তবে পরিচালনায় তার হাতেখড়ি আরও অনেক আগেই। ভারতে ওটিটি প্লাটফর্মের এমন রমরমা অবস্থা হওয়ার আগেই বিভিন্নি আইআইটি থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্ররা মিলে একটি ইউটিউব চ্যানেল খুলেছিলেন, যার নাম ‘টিভিএফ’ বা দ্য ভাইরাল ফিভার। আজকে আমরা যে ধরনের সিরিজ দেখছি, টিভিএফ চ্যানেলে সে ‘পিচার্স’, ‘ট্রিপলিং’, ‘পার্মানেন্ট রুমমেটস’সহ আরও অনেক সিরিজ ততদিনে তৈরি করে ফেলেছেন এই যুবকের দল। পার্মানেন্ট রুমমেটস দীপকের পরিচালনায় তৈরি। টিভিএফের অনেক সিরিজে তাকে অভিনেতা হিসেবেও দেখে থাকবেন। বলিউড সিনেমায় যেখানে উত্তর প্রদেশ মানেই গালিগালাজ, খুনোখুনি আর রক্ত, সেখানে ছোট্ট একটা গ্রামকে নিয়ে একেবারেই অহিংস, বাস্তবসম্মত, মিষ্টি একটা ওয়েব সিরিজ বানিয়ে দীপক বুঝিয়ে দিয়েছেন তার দেখার চোখ কতটা গভীর। ওটিটি প্লাটফর্ম মানেই যাদের কাছে অযথা যৌন দৃশ্য আর খুনোখুনি, ‘পঞ্চায়েত’ তাদের কাছে যেন এক পশলা শান্তির বৃষ্টি।
তো প্রশ্ন হচ্ছে, যারা সিনেমাতে সেভাবে সফল হতে পারলেন না-তারা ওটিটিতে কোন জাদু বলে এতটা সফল হলেন? আসলে ওটিটিতে প্রোডিউসারদের চাপ থাকে না সেভাবে। ফলে পরিচালকেরা সিনেমার তুলনায় আরেকটু বেশি স্বাধীনতা পান সবদিক থেকেই। সারাক্ষণ যেহেতু ‘বক্স অফিসে কী হবে?’ টাইপ দুশ্চিন্তা থাকে না, সেহেতু ‘নিজের মন মতো’ কন্টেন্ট ভাবা যায় আর সেটাতে জোর দেওয়া যায়। আরও হয়ত অনেক কারণ আছে, তবে এসব পরিচালকদের তৈরি কন্টেন্ট আর তাদের সাফল্য দেখলে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়-মাধ্যম একটা ফ্যাক্ট বটে! এসব পরিচালকদের আবার বড় পর্দায় কাজ করতে দিলে তারা যে সাফল্য পাবেন, সেটা ১০০ ভাগ নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারবেন না। তবে বড় পর্দায় সাফল্য না পেয়েও তারা যে ভেঙে পড়েননি আর ওটিটিতে নিজেদের গল্পটা নিজেদের মত করে বলতে পেরেছেন, তাদের সবচেয়ে বড় সফলতা সম্ভবত সেখানেই।
লেখক : শিক্ষক ও সিনেমাপ্রেমী
আরআইজে