করোনার কারণে ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর আগামী সেপ্টেম্বর থেকে খুলতে যাচ্ছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কি না তাও নিয়মিত মনিটরিং করবে প্রশাসন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর যেসব স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে তার একটি নির্দেশিকা এরইমধ্যে ইউনিসেফ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর যৌথভাবে তৈরি করেছে। 

নির্দেশনায় বাধ্যতামূলক মাস্ক পরা, স্কুলের বেঞ্চে নির্দিষ্ট দূরত্বে বসা, হাত ধোয়া, টয়লেট পরিষ্কার রাখা, মেঝে ও ক্লাস রুমে দরজার হাতল-সিঁড়ির হাতল এবং যেসব বস্তু বারবার ব্যবহৃত হয় সেসব ঘন ঘন পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখাসহ ১৭ ধরনের নির্দেশনা মানার কথা বলা হয়েছে।

কিন্তু দেশের ১৯টি জেলার ৭০টি উপজেলা উপকূলীয়। এসব জেলা-উপজেলায় করোনা পরবর্তী স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হবে না বলে সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে। এছাড়া করোনার সঙ্গে জলবায়ুর প্রভাবে দেশের প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ শিশু চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি, বাল্যবিবাহসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে বলে গবেষণায় জানানো হয়েছে।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপকূলীয় এলাকায় স্কুল পরিষ্কার রাখার মতো প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী, সুপেয় পানির ব্যবস্থা আগেই ছিল না। করোনা পরবর্তী স্কুল খোলার পর বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থার কোনো প্রস্তুতি এখনও নেয়নি প্রশাসন। এ অবস্থায় নির্দেশনাগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন করা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

সম্প্রতি ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’র উদ্যোগে এক আলোচনা এসব শঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। ‘রেসপন্ডিং টু ক্লাইমেট ক্রাইসিস উইথ অ্যান্ড ফর চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়ুথ’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা বলেন, করোনায় সবেচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাতের মধ্যে শিক্ষাখাত অন্যতম। বিশেষ করে উপকূলের শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে কত শতাংশ শিশু স্কুলে আবার ফিরে আসবে তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চিয়তা। এরমধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী, সুপেয় পানি নিশ্চিত না হওয়ায় উপকূলীয় জেলা-উপজেলার স্কুলে স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব হবে না।

মনপুরা সরকারি কলেজের ছাত্রী সাদিয়া আক্তার মিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বাভাবিক সময়ে স্কুলে পানি থাকে না। প্রাকৃতিকসহ প্রয়োজনীয় কাজ সারতে আমাদের বাড়ি আসতে হয়। করোনা পরবর্তীতে স্কুলে পর্যাপ্ত পানি রাখার কথা বলা হয়েছে। এগুলোর কোনো প্রস্তুতি এখানে নেই।  

উপকূলীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর সৈয়দ গোলাম মো. ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দিনক্ষণ ঠিক হলে আরেকটি গাইডলাইন তৈরি হবে। সেখানে এ বিষয়টি সংযুক্ত করা হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে ১ কোটি ৯০ লাখ শিশু

জলবায়ুর প্রভাবে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি শিশু। তাদের জীবন সরাসরি ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কোভিড-১৯ মহামারি এ ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে। যা বাংলাদেশের তথা দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের জন্য একটি উদ্বেগজনক সংকট তৈরি করেছে। এসব শিশুদের রক্ষায় এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

‘জলবায়ু সংকট কার্যত শিশু অধিকারের সংকট : শিশুদের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিসিআরআই) প্রবর্তন’ শীর্ষক প্রতিবেদনের সূচকে ইউনিসেফ বলছে, এই অঞ্চলে খরা, বন্যা, বায়ুদূষণ ও নদীভাঙনের কারণে লাখ লাখ শিশু গৃহহীন ও ক্ষুধার্ত এবং স্বাস্থ্যসেবা ও পানিবিহীন অবস্থায় রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কোভিড-১৯ মহামারি যুক্ত হওয়ায় এ অঞ্চলের শিশুদের জন্য একটি উদ্বেগজনক সংকট তৈরি করেছে।

এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ সমুদ্রের কারণে উদ্বাস্তু হওয়ার ঝুঁকিতে যে কয়টি দেশ রয়েছে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। গ্লোবাল ক্লাইমেট ইনডেক্স অনুযায়ী, ১৯৯৮-২০২১ সালের আবহাওয়া কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্বের শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। 

জলবায়ু পরিবর্তনে শিশুদের ওপর যেসব প্রভাব পড়ছে

জলবায়ুর প্রভাবে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশের শিশুরা। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের শিশুরা তাপপ্রবাহ ও বন্যার মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির ক্ষেত্রে অত্যন্ত অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউনিসেফ। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু এ চারটি দেশের বসবাসকারী তরুণ জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষা হুমকির মুখে ফেলছে।

জলবায়ুর প্রভাবে শিশুদের ওপর কী প্রভাব পড়েছে তা নিয়ে সম্প্রতি ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ বলছে, জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশে আনুমানিক ১০ দশমিক ৪ মিলিয়ন শিশু সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাণঘাতী বন্যা, নদী ও উপকূলীয় খরা, শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় এবং শহরে অভিবাসন বেড়েছে।

ইউনিসেফের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘দ্য স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’ শিশু (SOWC) ২০১৯’ প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শিশুদের অপুষ্টি, শিশু শ্রম, বাল্য বিবাহ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। করোনায় শিশু শ্রম, বাল্য বিবাহ উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জলবায়ুর প্রভাবে বন্যা এবং নদী ভাঙনের কারণে অনেক পরিবার শহরের বস্তিতে চলে এসেছে। যেখানে তারা উপচেপড়া ভিড় এবং পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যের সুরক্ষার অভাব, পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য পাচ্ছে না। সংস্থাটি এরকম ১ হাজার শিশুর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে জলবায়ুর কারণে এসব শিশুরা শিক্ষা, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যবিধি এবং নিরাপদ পানির চরম সংকটে ভুগছে। জলবায়ু ও করোনায় তারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে দরিদ্র ও অসহায় শিশুদের সুরক্ষায় এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

জানতে চাইলে পরিবেশ, বন, জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, উপকূলের শিশুরা এমনিতেই স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা মহামারি। তাই উপকূলীয় শিশুদের রক্ষায় সরকারকে নতুন নতুন প্রকল্প নেওয়া হয় সেজন্য সুপারিশ করব। এছাড়া নতুন প্রকল্পে শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়টি যুক্ত করা হয় সেজন্য বলা হয়েছে।

জলবায়ুর প্রভাবের ফলে শিশুরা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তা চিহ্নিত করে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরানো হবে কঠিন চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে দুর্গম, উপকূলীয় শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। তারা অনেকে কাজে যোগ দিয়েছে, অনেক মেয়ে শিশুর বিয়ে হয়ে গেছে। বিশেষ করে জলবায়ুর প্রভাবে শিশুরা মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে।

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ুর প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১৪ লাখ শিশু সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। এসব শিশুরা অপুষ্টি, স্বাস্থ্য সুরক্ষারসহ বিভিন্ন সমস্যার ভুগছে। আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে অপুষ্টির শিকার শিশুর সংখ্যা দাঁড়াবে ২৫ লাখে।

এনএম/জেডএস