প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধের ৫০০ দিন
করোনায় বিপর্যস্ত উচ্চশিক্ষা, উত্তরণ ‘সম্ভব’ বলছেন শিক্ষাবিদরা
মহামারি করোনার ভয়াল থাবায় ৫০০ দিনেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রম। এরপরও অনলাইনে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতা ও অনিশ্চয়তায় দিনদিন যেন আরও শোচনীয় হচ্ছে শিক্ষা খাত। উচ্চশিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার শঙ্কায় আছেন শত শত শিক্ষার্থী। এসব বিষয়ে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের সব পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাকার্যক্রম ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক সশরীরে পরিচালিত হয়েছে। তবে হঠাৎ করোনার প্রাদুর্ভাব সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সেটিও পুরোপুরি সফল হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সিদ্ধান্তের টানাপোড়েনে অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোতে তৈরি হচ্ছে সেশনজট। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাস-পরীক্ষাসহ সবকিছু বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরাও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা
এছাড়া সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সিদ্ধান্তের টানাপোড়েনে অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোতে তৈরি হচ্ছে সেশনজট। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাস-পরীক্ষাসহ সবকিছু বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরাও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
বিজ্ঞাপন
শিক্ষার্থীরা বলছেন, দীর্ঘ সময় পর অনলাইন পাঠদানের মাধ্যমে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরপর্যায়ের শিক্ষাকার্যক্রম কিছুটা স্বাভাবিক হলেও সেশনজটের মতো ভোগান্তি তাদের পিছিয়ে দিতে পারে। কারণ, করোনায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় তারা সেশনজটের মধ্যে ছিলেন। নতুন করে জট তৈরি হলে এর রেশ টানতে হবে বহুদিন।
তবে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে নিয়মিত পাঠদানের পাশাপাশি পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীরা স্বস্তি পেলেও বিপাকে পড়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তারা শর্তসাপেক্ষে অটো পাস পেলেও পিছিয়ে রয়েছেন বিভিন্ন অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীরা পড়েছেন মহাবিপাকে। এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা আগে থেকেই সেশনজটে ছিলেন। এখন নতুন করে জটে পড়েছেন তারা। নানা কারণে সময়ক্ষেপণের ফলে দুই বছরের আগের পরীক্ষা এখনও শেষ হয়নি। করোনার কারণে শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ থাকায় নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, সাত কলেজের স্নাতকোত্তর শেষ পর্বের (২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ) পরীক্ষা ২০১৮ সালে, স্নাতকোত্তর প্রিলিমিনারি (২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ) পরীক্ষা ২০১৭ সালে এবং ডিগ্রি (২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ) দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা নিয়মানুযায়ী ২০১৮ সালে হওয়ার কথা। কিন্তু এখনও তা অনুষ্ঠিত হয়নি। স্নাতকপর্যায়ের শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন দীর্ঘ সেশনজটে।
অধিভুক্ত ঢাকা কলেজের স্নাতকোত্তরপর্যায়ের শিক্ষার্থী ওবায়দুর রহমান বলেন, দীর্ঘ সময়েও শিক্ষাজীবনের ইতি টানতে না পারায় আমরা সার্বিকভাবে হতাশাগ্রস্ত। আগে থেকে চলমান সেশনজট এখন নতুন রূপ পেয়েছে। প্রশাসন যদি শিক্ষার্থীদের কল্যাণে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে না পারে তাহলে এ জটে দীর্ঘদিন নাকাল থাকতে হবে।
এ বিষয়ে সাত কলেজের সমন্বয়ক ও ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার জানান, সেশনজট নিরসনে এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণে আট মাসে সেশন শেষ করার চিন্তা তাদের আছে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানো এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এরপর আবাসিক শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে অবস্থান করানো, ক্লাসে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের বিষয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেশনজটের সমস্যা তো রয়েছেই। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুততম সময়ের মধ্যে যৌক্তিক একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর।’
আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস চললেও পরীক্ষা না হওয়ায় একই বর্ষে থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সা’দ কবির বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে ক্লাস চললেও চূড়ান্ত পরীক্ষা না নেওয়ায় একই বর্ষে থাকতে হচ্ছে। এখন আমার চতুর্থ বর্ষে থাকার কথা কিন্তু তৃতীয় বর্ষেই আছি। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে যদি চূড়ান্ত পরীক্ষা না হয় তাহলে আমরা দীর্ঘ সেশনজটে পড়ব।
করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মেয়ে শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকায় পারিবারিক চাপে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে তাদের। ফলে শিক্ষাজীবনে ফেরা নিয়ে তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে অনিশ্চয়তা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ভুক্তভোগী এমন এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রথম প্রথম ভালোই কাটছিল সময়। হঠাৎ এক দিন পরিবার থেকে বলা হলো, তোমার জন্য পাত্র দেখা হয়েছে। বিয়ে করতে হবে। ছেলে ভালো, তাই বিয়ের জন্য প্রস্তুত হও। একপর্যায়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হই। এখন পড়াশোনা শেষ করতে পারব কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
তবে উচ্চশিক্ষা থেকে কোনো শিক্ষার্থী যাতে ঝরে না পড়ে সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানালেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সচিব ড. ফেরদৌস জামান। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি খুব দ্রুতই একটি সুন্দর পরিবেশে পুনরায় শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হবে। করোনায় সৃষ্ট দীর্ঘ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ইতোমধ্যে আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে বৈঠক করে একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছি। সেখানে মূল বিষয় ঠিক রেখে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও সময়ের মধ্যে শিক্ষাবর্ষ শেষ করার উদ্যোগ আছে। আশা করি কোনো জটিলতা হবে না। খুব সহজেই সেশনজটসহ অন্যান্য সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মুনাজ আহমেদ নূর ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষার্থীদের টিকা নিশ্চিত হলে আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে পারব। এক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানোর বিষয়টি বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি মনে করছি না। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট পূর্ণতাপ্রাপ্ত। করোনার এ দুর্যোগে অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে নিজেদের যুক্ত করেছেন।
‘তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার সম্ভাবনা আছে। আর্থিক অক্ষমতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী আর বিশ্ববিদ্যালয়মুখী হবেন না। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশাসনকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। যেন তারা ঝরে না পড়েন।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক শিক্ষাকার্যক্রম থেকে পিছিয়ে পড়ছেন কি না— এমন প্রশ্নের উত্তরে উপাচার্য বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা যখন আমি বলব তখন সারাদেশের প্রান্তিকপর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী সামনে চলে আসেন। এসব কলেজে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সরাসরি ক্লাস পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। তবে আমি দেখেছি, ক্লাসসংশ্লিষ্ট অসংখ্য ভিডিও কনটেন্ট প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ও ফেসবুক পেজে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঢাকার বড় বড় কলেজগুলো অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সরাসরি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ক্লাস পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেশনজট নিরসনে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে— এ বিষয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আমাদের একটি প্ল্যান দিয়েছে। ওই প্ল্যানের ভিত্তিতে আমরা চেষ্টা করছি যেন সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করে স্ব স্ব বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া যায়। এতে সেশনজট নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে সম্ভব হবে।
আরএইচটি/এআর/এমএআর