ঝরে পড়েছে পৌনে ৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থী, এগিয়ে মেয়েরা

ছবি- ইনফোগ্রাফ / ঢাকা পোস্ট

অষ্টম শ্রেণির গণ্ডি শেষ করে শিক্ষাবোর্ডের অধীনে নবম শ্রেণিতে প্রথম রেজিস্ট্রেশন করেন শিক্ষার্থীরা। উদ্দেশ্য এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা। কিন্তু নবম-দশম শ্রেণির গণ্ডি পার হতেই ঝরে যায় চার লাখ ৭৭ হাজার শিক্ষার্থী। শিক্ষার আনুষ্ঠানিক সনদ না পেয়েই শিক্ষাজীবন শেষ করা এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে এগিয়ে মেয়েরা। বিনা মূল্যে বই দেওয়া, উপবৃত্তি ও স্কুল ফিডিং কার্যক্রমের মতো হাজার কোটি টাকার সরকারি কর্মসূচির পরও ঝরে পড়ার এমন চিত্র ‘উদ্বেগজনক’, বলছেন শিক্ষাবিদরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আগামী ১০ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় যারা অংশগ্রহণ করছে তারা ২০২৩ সালে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল। ওই বছর এ সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ ২৯ হাজার ৮৪৪ জন। অথচ ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার টেবিলে বসছে ১৫ লাখ ১৬ হাজার ৪৫৭ জন। অর্থাৎ গত দুই বছরে ঝরে পড়েছে চার লাখ ৭৩ হাজার ১০৫ জন শিক্ষার্থী। যা মোট শিক্ষার্থীর ২১.৪১ শতাংশ।

এবার ছেলেদের তুলনায় ৫৪ হাজার ৩০১ জন মেয়ে শিক্ষার্থী বেশি ঝরে পড়েছে / ফাইল ছবি

 

তবে, কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। গত বছর ওই বোর্ডে ঝরে পড়েছিল ৬৪ হাজার শিক্ষার্থী। সেই সংখ্যা যোগ করলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় চার লাখ ৭৭ হাজার ১০৫ জন।

শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনা এবং তাদের ধরে রাখার লক্ষ্যে সরকার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে থাকে। বিনা মূল্যে বই দেওয়া, উপবৃত্তি ও স্কুল ফিডিং কার্যক্রমের মতো কর্মসূচি পালনে সমুদয় অর্থ ব্যয় হলেও গত দুই বছরে এত বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়া অত্যন্ত ‘উদ্বেগজনক’— মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।

আগামী ১০ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় যারা অংশগ্রহণ করছে তারা ২০২৩ সালে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল। ওই বছর এ সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ ২৯ হাজার ৮৪৪ জন। অথচ ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার টেবিলে বসছে ১৫ লাখ ১৬ হাজার ৪৫৭ জন। অর্থাৎ গত দুই বছরে ঝরে পড়েছে চার লাখ ৭৩ হাজার ১০৫ জন শিক্ষার্থী। যা মোট শিক্ষার্থীর ২১.৪১ শতাংশ

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রাথমিকের চেয়ে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার ব্যয় বেশি। অনেক অভিভাবক এ ব্যয় বহন করতে পারেন না। এ ছাড়া শিক্ষায় কোচিং বাণিজ্য ও নোট-গাইডের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। স্কুলগুলোতে আরও অনেক ব্যয় আছে। এ কারণে দরিদ্র ও কম আয়ের মানুষের শিক্ষার সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলায় না। এক কথায়, বর্ধিত শিক্ষার ব্যয় মেটাতে না পারাই ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ।’

আগামী ১০ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা / ফাইল ছবি

শিক্ষাবিদরা বলছেন, মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়া রোধে গতানুগতিক পদ্ধতির বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে হবে। নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা একেবারে বিনামূল্যে না হলেও স্বল্পমূল্যে যাতে পড়াশোনা করতে পারে সেই উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি ঝরে গেছে এমন শিশুদের কর্মমুখী একটি কোর্সের মাধ্যমে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা যেতে পারে।

কোন বোর্ডে কতজন ঝরে পড়ল

বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংখ্যাগত হিসাবে ঝরে পড়ার হারে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সবচেয়ে এগিয়ে। ২০২৩ সালে নবম শ্রেণিতে এ বোর্ডে তিন লাখ ৯৭ হাজার ৬১৯ জন রেজিস্ট্রেশন করলেও পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেছে তিন লাখ ২৪ হাজার ৯৭ জন। ঝরে পড়েছে ৭৩ হাজার ৫২২ জন। একইভাবে রাজশাহী বোর্ডে ঝরে পড়েছে ২৯ হাজার ১০০ জন। কুমিল্লা বোর্ডে ৪৯ হাজার ৬৩৬ জন। যশোর বোর্ডে ২৯ হাজার ৯৬৯ জন। চট্টগ্রাম বোর্ডে ২৬ হাজার ৭২০ জন। বরিশাল বোর্ডে ১৫ হাজার ৮১৪ জন। সিলেট বোর্ডে ২১ হাজার ২৭৩ জন। দিনাজপুর বোর্ডে ৩০ হাজার ২৭৭ জন। ময়মনসিংহ বোর্ডে ১৬ হাজার ৫৭৩ জন ঝরে পড়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাখ ২১ হাজার ২৫৭ জন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

ঝরে পড়ার হারে মেয়েরা এগিয়ে

২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১০ লাখ ৪১ হাজার ৮২৩ মেয়ে শিক্ষার্থী। এসএসসির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেছে আট লাখ আট হাজার ১২০ জন। অর্থাৎ ঝরে পড়েছে দুই লাখ ৩৩ হাজার ৭০৩ জন। অন্যদিকে, নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল আট লাখ ৮৮ হাজার ২১ ছেলে শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে এসএসসিতে ফরম পূরণ করেছে সাত লাখ আট হাজার ৬১৯ জন। ঝরে পড়েছে এক লাখ ৭৯ হাজার ৪০২ জন। ছেলেদের তুলনায় ৫৪ হাজার ৩০১ জন মেয়ে শিক্ষার্থী বেশি ঝরে পড়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী / ফাইল ছবি

মেয়েদের এভাবে ঝরে পড়া প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘স্কুলে ভর্তি, পাস ও ভালো ফলের দিক থেকে মেয়েরা যেমন এগিয়ে তেমনি ঝরে পড়ার হারেও তারা এগিয়ে। এটি উদ্বেগজনক। বাল্যবিয়ে, নিরাপত্তাহীনতা, পরিবার থেকে মেয়েদের পেছনে শিক্ষায় বিনিয়োগ না করার প্রবণতা তাদের শিক্ষা নিশ্চিতে বারবার প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হবে।’

এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নবম শ্রেণি থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বসার মাঝখানে এক লাখ ৮০ হাজার মেয়ে শিক্ষার্থী ঝরে গেছে। এর অন্যতম কারণ বাল্যবিয়ে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিশুশ্রম ও পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা। এ কারণেও শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করছে।’

২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১০ লাখ ৪১ হাজার ৮২৩ মেয়ে শিক্ষার্থী। এসএসসির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেছে আট লাখ আট হাজার ১২০ জন। অর্থাৎ ঝরে পড়েছে দুই লাখ ৩৩ হাজার ৭০৩ জন। অন্যদিকে, নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল আট লাখ ৮৮ হাজার ২১ ছেলে শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে এসএসসিতে ফরম পূরণ করেছে সাত লাখ আট হাজার ৬১৯ জন। ঝরে পড়েছে এক লাখ ৭৯ হাজার ৪০২ জন। ছেলেদের তুলনায় ৫৪ হাজার ৩০১ জন মেয়ে শিক্ষার্থী বেশি ঝরে পড়েছে

এবার পরীক্ষার্থী কমেছে ৯৪ হাজার

আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের তথ্যমতে, এবার মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৯ লাখ ২৯ হাজার ৮৪৪ জন। গতবারের চেয়ে এবার পরীক্ষার্থী কমেছে প্রায় ৯৪ হাজার ৩৪৮ জন। গত বছর ছিল ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি বছর নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সর্বমোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখ ৯০ হাজার ১৪২ জন। এর মধ্যে ছাত্র সাত লাখ এক হাজার ৫৩৮ জন, ছাত্রী সাত লাখ ৮৮ হাজার ৬০৪ জন। পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা দুই হাজার ২৯১টি এবং প্রতিষ্ঠান সংখ্যা ১৮ হাজার ৮৪টি।

বর্ধিত শিক্ষার ব্যয় মেটাতে না পারাই ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ- বলছেন সংশ্লিষ্টরা / ঢাকা পোস্ট

বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সর্বমোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দুই লাখ ৯৪ হাজার ৭২৬ জন। এর মধ্যে ছাত্র এক লাখ ৫০ হাজার ৮৯৩ জন এবং ছাত্রী এক লাখ ৪৩ হাজার ৮৩৩ জন। পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা ৭২৫টি এবং প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নয় হাজার ৬৩টি। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সর্বমোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাখ ৪৩ হাজার ৩১৩ জন। এর মধ্যে ছাত্র এক লাখ আট হাজার ৩৮৫ জন এবং ছাত্রী ৩৪ হাজার ৯২৮ জন।

অনিয়মিত পরীক্ষার্থী ২ লাখ ১৭ হাজার 

গেল শিক্ষাবর্ষে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এক থেকে একাধিক বিষয়ে ফেল করেছিল তারা এবার সেসব বিষয়ে পরীক্ষা দেবে। এমন পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এবার দুই লাখ ৬৭ হাজার ৯৫ জন। এ ছাড়া মানোন্নয়নের জন্য নতুন করে পরীক্ষায় বসবে এক হাজার ৮২৩ জন। ১১টি শিক্ষাবোর্ডে নিয়মিত, অনিয়মিত, মানোন্নয়নসহ সবমিলিয়ে এবার পরীক্ষায় বসছে ১৪ লাখ ৯০ হাজার ৯৩১ জন শিক্ষার্থী।

এবার এক বিষয়ের পরীক্ষা দেবে এমন পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাখ ২৫ হাজার ৯০১ জন। দুই বিষয়ে পরীক্ষা দেবে ৩৭ হাজার ০৯ জন। তিন বিষয়ের পরীক্ষা দেবে ১০ হাজার ২১৪ জন এবং চার বিষয়ের পরীক্ষা দেবে দুই হাজার ৫৭৯ জন।

এনএম/