কারিকুলাম বাতিলে প্রশংসা, পরীক্ষা বাতিলে চরম বিতর্ক
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর মধ্যে ১০০তম দিন পূর্ণ করেছে নতুন এ সরকার। এসময়ে নতুন কারিকুলাম বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছে তেমনি এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করে চরম বিতর্ক জন্ম দিয়েছে।
নতুন সরকারে শিক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে। তার নেতৃত্বে গত তিন মাসে শিক্ষায় বেশ কিছু নতুন সিদ্ধান্ত এসেছে। এর মধ্যে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল পতিত সরকারের রেখে যাওয়া নতুন কারিকুলাম বাতিল করা। এ সিদ্ধান্ত সব মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করে অটোপাসের ফরমেটে সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফল দেওয়া হয়।
প্রশংসা কুড়িয়েছে কারিকুলাম বাতিল
মুখস্থ নির্ভরতা কমিয়ে বাস্তবভিত্তিক শিক্ষার জন্য ২০২৩ সাল থেকে চালু হয় নতুন কারিকুলাম। ওই বছর তিন শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করা হয়। চলতি বছর আরও চার শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন চলছে। এ শিক্ষাপদ্ধতি বাস্তবায়নে নানা অসংগতি দেখা যায় এবং অভিভাবকমহলেও তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়। আগের পরীক্ষাপদ্ধতি বাতিল করায় চরম ক্ষুব্ধ হন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। আন্দোলনও করেন তারা। অনেকটা গায়ের জোরে চাপিয়ে দেওয়া সেই কারিকুলাম অভিভাবকদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে গত ১ সেপ্টেম্বর বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
চলতি শিক্ষাবর্ষের নয় মাসের মাথায় এসে ওই কারিকুলাম বাস্তবায়ন বন্ধ করে ডিসেম্বরে আগের নিয়মে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নযোগ্য না হলেও পাঠ্যবই চলতি বছরের জন্য বহাল থাকবে। একইসঙ্গে নতুন শিক্ষাক্রমের বই থেকে আগের পদ্ধতিতে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায়।
আরও পড়ুন
সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন আন্দোলন করা অভিভাবকরা। মারজানা আক্তার নামে এক অভিভাবক বলেন, নতুন কারিকুলাম চালুর পর আমার বাচ্চারা স্কুলের যেতে চায় না। পড়ালেখার চেয়ে মোবাইলসহ বিভিন্ন ডিভাইসের প্রতি বেশি আসক্ত ছিল। এজন্য শুরু থেকেই কারিকুলাম বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করেছি।
নতুন কারিকুলাম বাতিলের জন্য আন্দোলন করে সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন নামে একটি সংগঠন। সেই সংগঠনের আহ্বায়ক এবং শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলনের (শিশির) সম্পাদক রাখাল রাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, পতিত সরকার অনেকটা গায়ের জোরে জাতির ওপর নতুন একটি কারিকুলাম চাপিয়ে দিয়েছিল। সেই কারিকুলামের সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। কিছু দাতা সংস্থা ও গুটিকয়েক শিক্ষাবিদের পরামর্শে চালু হওয়া সেই কারিকুলাম বাতিল হওয়ায় অভিভাবকরা খুশি।
এইচএসসির বাকি পরীক্ষা বাতিলে চরম বিতর্ক
২০২৪ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হয় চলতি বছরের ৩০ জুন। সাতটি পরীক্ষা হওয়ার পর সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে কয়েক দফায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এর মধ্যে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয় ১১ আগস্ট থেকে নতুন সময়সূচিতে বাকি পরীক্ষা নেওয়া হবে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বিভিন্ন এলাকায় থানায় হামলা হয়, এতে থানায় রাখা প্রশ্নপত্রের ট্রাঙ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য ১১ আগস্টের পরিবর্তে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর থেকে স্থগিত পরীক্ষাগুলো নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু আন্দোলনকারী পরীক্ষার্থীদের দাবি ছিল, অবশিষ্ট পরীক্ষাগুলো বাতিল করতে হবে।
এ দাবিতে তারা প্রথমে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, পরে সচিবালয়ের সামনে আন্দোলন করেন। একপর্যায়ে সচিবালয়ের ভেতরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সচিবের দপ্তর ঘেরাও করেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে বাকি পরীক্ষা বাতিলের ঘোষণা দেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত চরম বিতর্কের জন্ম দেয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাও এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন।
কেন পরীক্ষা বাতিল করা হয়— জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে আমাদের বাধ্য হয়ে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের পরিস্থিতি না হয় সেজন্য এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ভিসি নিয়োগে স্বস্তি
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তার সময় নিয়োগ পাওয়া দেশের ৩০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেন। এ ছাড়া প্রো-ভিসি, রেজিস্ট্রাররাও পদত্যাগ করেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উপাচার্যহীন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকটা বিতর্কমুক্ত নিয়োগ দিতে পেরেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যমতে, ২৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছে সরকার। বাকিগুলোতে দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একজন অতিরিক্ত সচিব।
তিনি জানান, এবার ভিসি নিয়োগে দলীয় বিবেচনার চেয়ে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সরকারের গঠিত একটি কমিটি এ নিয়ে কাজ করেছে।
আরও পড়ুন
আরও যেসব অগ্রগতি
রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের অনুমোদনক্রমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ জন উপাচার্য, চারজন উপ-উপাচার্য ও ছয়জন ট্রেজারার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং দুজন পূর্ণকালীন সদস্য নিয়োগ করা হয়েছে। সমাবর্তনের জন্য দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নথি প্রধান উপদেষ্টা বরাবর পাঠানো হয়েছে এবং অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের নথি প্রক্রিয়াকরণের কাজ চলমান রয়েছে।
চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি শিক্ষা উপদেষ্টাকে মনোনয়ন দিয়েছেন।
সেপ্টেম্বরে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে ৯২৭ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের অধ্যাপক পদমর্যাদার এক হাজার ২৮টি পদকে তৃতীয় গ্রেডের বেতনস্কেলে উন্নীতকরণের প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিগত অনির্বাচিত সরকার অন্য সেক্টরের মতো শিক্ষায়ও কিছু স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল নতুন কারিকুলাম। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অভিভাবকের মতামত ছাড়াই একপেশে একটি শিক্ষা কারিকুলাম বাতিল করা জরুরি ছিল।
সম্প্রতি এইচএসসি পরীক্ষায় সাতটি বিষয়ে অটোপাসের সমালোচনা করে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে পরীক্ষা ছাড়া পাস করানো ঠিক হয়নি। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও অধিক সতর্ক হওয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেন এই শিক্ষাবিদ।
বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও প্রফেসর ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে এইচএসসির মতো একটি পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করে দেওয়া কোনো ভালো সিদ্ধান্ত হয়নি। সরকারের উচিত ছিল ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে একটি সমঝোতা করে পরীক্ষার আয়োজন করা।
কারিকুলাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই কারিকুলামের শুরু থেকেই বিরোধিতা করেছি। অবশেষে কারিকুলাম বাতিল হয়েছে, এটি ভালো খবর।
এনএম/এমজে