ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে। বিগত সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া ভিসিরা পদত্যাগ করলেও ব্যতিক্রম ছিলেন ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম। তিনি আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপকমিটির সদস্য হয়েও ভিসি পদ ধরে রাখতে নানা কৌশল গ্রহণ করেন। শেষ রক্ষা হয়নি তার, পদত্যাগে বাধ্য হন।

গত শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র।

গত ৫ আগস্টের পর সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা পদত্যাগ করলেও ব্যতিক্রম ছিলেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম। এক মাস পেরিয়ে গেলেও তিনি পদত্যাগ করেননি। বিষয়টি জানাজানির পর উষ্মা প্রকাশ করেন অনেকেই। যেখানে আওয়ামী লীগের পদ-পদবি তো দূরের কথা সেই দলের সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক থাকা ভিসিরা পদত্যাগ করেছেন, কোথাও কোথাও তাদের পদত্যাগে বাধ্য করানো হয়েছে, সেখানে একমাত্র তিনিই ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে ছিলেন।

জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভিসি পদ টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ পাওয়া অস্থায়ী কর্মকর্তাদের ডেকে অনেকের চাকরি স্থায়ী করে দেন তিনি। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের মুখ বন্ধ করেন টিউশন ফি কমানোর আশ্বাসে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পক্ষ তার অপসারণের দাবিতে সোচ্চার ছিল। অবশেষে তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পদত্যাগ করেন ভিসি মাহফুজুল ইসলাম।

দেরিতে পদত্যাগ করার কারণ জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি পদত্যাগপত্র লিখে রেখেছিলাম। দুবার পদত্যাগ করার উদ্যোগও নিয়েছিলাম। কর্মকর্তা ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আমাকে পদত্যাগ করতে বারণ করায় সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছিলাম। এক্ষেত্রে তারা যুক্তি দিয়েছিল— আমি দেড় বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি তাতে তারা সন্তুষ্ট। এজন্য বাকি সময়টুকু ভিসি হিসেবে থাকার অনুরোধ জানিয়েছিল। যা-ই হোক অবশেষে আমি পদত্যাগ করেছি।’

তবে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষক-কর্মকর্তা জানান, গত ৫ আগস্টের পর তিনি ক্যাম্পাসে আসা বন্ধ করে দেন। এক্ষেত্রে তিনি ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেন। তার সময় এবং তারও আগের ভিসি মূনাজ আহমেদ নূরের সময় নিয়োগ পাওয়া অস্থায়ী কর্মকর্তাদের স্থায়ী করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর দুই দফায় স্থায়ী করা হয় কয়েকজন কর্মকর্তাকে। গত সপ্তাহ থেকে তিনি ক্যাম্পাসে আসা শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

নেপথ্যে ১০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প

অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগ বাণিজ্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে ১০ কোটি টাকার ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) লোভে ভিসি পদ ছাড়তে চাননি ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভোট চুরি ও ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাস্টারমাইন্ড এবং ইভিএমের জনক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম। তার এসব কাজের পুরস্কারস্বরূপ ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ দেয় সরকার। মূলত ১০ কোটি টাকার ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) লোভে তিনি পদ ছাড়তে চাননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়া নিষিদ্ধ হলেও তিনি বীরদর্পে সেই নিয়ম ভঙ্গ করে ভিসি ছিলেন বলেও উল্লেখ করেন এ কর্মকর্তা।

বিতর্কিত ইভিএম প্রকল্পের উদ্যোক্তা মাহফুজ

জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে হঠাৎ করে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে আসে আওয়ামী লীগ সরকার। বিতর্কিত এ প্রকল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক ও সদ্য পদত্যাগ করা ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম।

তাকে ইভিএম প্রকল্পের অন্যতম উদ্যোক্তা বলা হয়। এ প্রকল্পে লুটপাটের মাস্টারমাইন্ডও বলা হয় তাকে। তার নেতৃত্বে ইভিএম প্রকল্প ইসির ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করা হয়। এ ছাড়া তিনি ঢাকা বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানির (ডেসকো) স্বতন্ত্র পরিচালক, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং এমআরপিসহ অনেক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত।

জয়-আরাফাত ও নাফিসের সুপারিশে হন ভিসি

বিগত সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার সুবাদে সরকারের উচ্চ মহলের সঙ্গে পরিচয় হয় ড. মাহফুজের। একপর্যায়ে আর্থিক খাতের বিতর্কিত ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়।

পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) আইটি খাতের কিছু কাজ করার সুবাদে সরাফাতের কাছাকাছি চলে আসেন তিনি। এরপর তারই মালিকানাধীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ভিসি পদে নিয়োগ পান। সেখান থেকে সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ও কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির উপদেষ্টা মোহাম্মদ আলী আরাফাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।

এসব সূত্র ধরে পরিচয় হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে। এরপরই ডিজিটাল ইউনিভাসির্টির ভিসির পদ বাগিয়ে নেন তিনি।

এনএম/এমজে