ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক নিবিড় বলে মনে করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর ড. মো. হারুন-অর-রশিদ। ক্ষমতাবান ছাড়া কারও পক্ষে বড় ধরনের দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। ‘ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিতে প্ররোচিত করে। আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সর্বগ্রাসী দুর্নীতির জন্ম দেয়।

সোমবার (৮ জুলাই) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে ‘দুর্নীতি ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ-গঠন সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য’ শীর্ষক বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রথম বক্তৃতায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় এসব কথা বলেন ড. হারুন-অর-রশিদ। 

বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ তার প্রবন্ধে বলেন, ‘দুর্নীতি বহুল আলোচিত একটি বিষয়। উন্নত-অনুন্নত, গণতান্ত্রিক-অগণতান্ত্রিক সব সমাজে এটি বিদ্যমান। ক্যানসারের মত এটি সম্পূর্ণ নিরাময় করা না গেলেও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেদে এর মাত্রা বা পরিধি সীমিত রাখা সম্ভব। দুর্নীতির সঙ্গে রয়েছে ক্ষমতার নিবিড় সম্পর্ক। ক্ষমতাবান ছাড়া কারও পক্ষে বড় ধরনের দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। ‘ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিতে প্ররোচিত করে। আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সর্বগ্রাসী দুর্নীতির জন্ম দেয়’ (লর্ড অ্যাস্টন)। দুর্নীতির অর্থ শুধু আর্থিক লেনদেন নয়, এর সংজ্ঞা বা পরিধি ব্যাপক। যেকোনও অনিয়ম, অসৎ আচরণ, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়াও দুর্নীতি। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতি বলতে তাই বুঝিয়েছেন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন-পুনর্বাসনের পর বঙ্গবন্ধু রাজনীতির নামে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও চরম বামপন্থিদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তার স্বপ্ন পূরণের পথে সবচেয়ে বড় যে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন, তা হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতিবাজদের ‘চোর’ আখ্যায়িত করে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গেছে কিন্তু চোরগুলো রেখে গেছে। এদের নিয়ে গেলে বাঁচতাম। তিনি দুঃখ করে এও বলেন, মানুষ পায় স্বর্ণের খনি আর আমরা পেলাম চোরের খনি।

বিশিষ্ট এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, শুধু আবেদন-নিবেদন কিংবা গুলি করে হত্যা করার মত আইন পাস করেও দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণজাগরণ ও দুর্নীতির উৎসমূলে আঘাত হানা। ১৯৭৫ সালের তার দ্বিতীয় বিপ্লব বা সিস্টেম চেইঞ্জ কর্মসূচির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল তাই। শীর্ষ নেতৃত্বের ব্যক্তিগত সততা দুর্নীতি দমনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে যে পারে না বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা তারই প্রমাণ।

বঙ্গবন্ধু চেয়ার তার প্রবন্ধে বলেন, ‘জেনারেল জিয়া, এরশাদ, মঈন ইউ আহমদের সেনা শাসন এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ও পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াতের শাসন আমলে দেশে দুর্নীতির কীভাবে প্রসার ঘটে এবং শাসকগোষ্ঠীর আনুকূল্য লাভ করে তা দেশবাসী সবারই জানা। ১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স এবং ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ করার কথা বলে আসার পরও আজ দেশের সর্বস্তরে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার কীভাবে ঘটেছে সে ব্যাপারে আত্মজিজ্ঞাসা এবং দুর্নীতি রোধে নির্মোহভাবে প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত আবশ্যক। অন্যথায়, আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় অর্জন লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যাওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার হবে। মনে রাখা দরকার, দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতি দমন বা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ সময়ের দাবি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি প্রফেসর ড. মশিউর রহমানের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। সভায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর আবদুস সালাম হাওলাদার। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল-হোসেনের সঞ্চালনায় সভায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট এবং সিন্ডিকেট সদস্য, অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরের বিভাগীয় প্রধান, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন।

এনএম/পিএইচ