নজিরবিহীন ছাত্র বিক্ষোভের মুখে ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে (নবম-১৩তম গ্রেড) বিদ্যমান ৫৬ শতাংশ কোটা তুলে দেয় সরকার। ৩৮তম বিসিএসের চূড়ান্ত নিয়োগের মাধ্যমে কোটার যুগ শেষ হয়।

এরপর ৮টি বিসিএসের সার্কুলার হয়েছে। এর মধ্যে ৫টিতে চূড়ান্ত নিয়োগ হয়েছে। বাকি ৪৪, ৪৫ এবং ৪৬তম বিসিএসের মৌখিক ও লিখিত পরীক্ষা চলছে। এর মধ্যে হঠাৎ এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সেই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। আপিল বিভাগেও সেই রায় ‘আপাতত’ বহাল রাখায় ফের আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের দাবি, কোটার কারণে মেধাবীরা বঞ্চিত হন। তুলনামূলক কম মেধাবীরা চাকরি পেয়ে যান। শুধু তাই নয়, কোটার জন্য নির্ধারিত পদগুলোর বেশিরভাগ পূরণ হয় না। ১৯৮৫ সালে জেলা কোটা চালুর সময় দেশে ১৯টি জেলা থাকায় ওই সময় জেলা কোটার পদগুলো পূরণ করা যেত। এখন অন্যান্য কোটার সঙ্গে জেলা কোটাও পূরণ হয় না। বিশ্বের অন্যান্য দেশে লক্ষ্য পূরণ হওয়ার পর নারীসহ বিভিন্ন কোটা বাতিল করলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। পৃথিবীর কোনো দেশে এত কোটাও নেই।

সরকারের নীতি নির্ধারকরা বলছেন, কোটা সংস্কার বা বাদ দেওয়ার বিষয়টি এখন পুরোপুরি আদালতের এখতিয়ারে চলে গেছে। সরকার ২০১৮ সালে বিষয়টি ফয়সালা করেছে। এখন আদালত যদি বাতিল করেন সেখানে তাদের কী করার আছে। যদিও সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলছেন— কোটা সংস্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। আর সরকারের পাচঁজন মন্ত্রী সোমবার কোটা ইস্যুতে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলেও কী আলোচনা হয়েছে তা জানাননি। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ধারণা, শেষ পর্যন্ত কোটা নিয়ে একটি সমাধান হতে পারে।

পিএসসিতে আছে ২৫৭ ধরনের কোটা!

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব প্রয়াত আকবর আলি খান ২০১৮ সালে এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের পাবলিক সার্ভিস কমিশনে ২৫৭টি কোটা রয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন উদ্ভট সিস্টেম নেই। এর কারণে মেধাবীরা চাকরি পাচ্ছে না।

পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নানা চাকরিতে নানা ধরনের কোটা প্রথা রয়েছে। তবে কত কোটা সেটা বলতে পারব না। আকবর আলী খান স্যার যেটা বলেছিলেন সেরকম হয়ত থাকতে পারে। তবে মোটা দাগে মুক্তিযোদ্ধা, নারী, জেলা কোটা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী কোটা। এর বাইরে যেগুলো আছে সেগুলো নামেমাত্র।

কোটা সংস্কার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সরকারের পলিসিগত বিষয়। এ বিষয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই।

পদ ফাঁকা তবুও বহাল কোটা

জনপ্রশাসনমন্ত্রী প্রায়ই সরকারি চাকরিতে শূন্য থাকা পদের সংখ্যা জাতীয় সংসদকে জানান। দেখা গেছে শূন্য পদগুলোর বেশিরভাগই কোটার পদ। প্রার্থী না পাওয়ায় এসব পদ পূরণ হয় না।

কোটা বাতিলের আগের বিভিন্ন বিসিএসের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মেধাবীরা উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি পাননি, অন্যদিকে শত শত পদ শূন্য রয়ে গেছে। পিএসসির প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী— কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ২৮ থেকে ৩৮তম বিসিএসের (কোটা বাতিলের আগের শেষ বিসিএস) বিভিন্ন ক্যাডারে অন্তত ছয় হাজার পদ খালি ছিল। এমনকি, শুধু কোটার প্রার্থীদের নিয়োগের জন্য ৩২তম বিশেষ বিসিএস নেওয়া হলেও ওই বিসিএসেও মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৮১৭টি, মহিলা ১০টি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ২৯৮টিসহ মোট এক হাজার ১২৫টি পদ শূন্য রাখতে হয়। শুধু বিসিএস নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ অন্যান্য নিয়োগেও একই অবস্থা হয়।

চাকরিতে নজিরবিহীন কোটা বাংলাদেশে

বিশ্বের কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো এত কোটা নেই। কোটা পদ্ধতিতে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় চাকরিতে সাধারণত অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা রাখা হলেও বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা, উপজাতি, নারীসহ বিভিন্ন ভাগে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে। যা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। পৃথিবীর অনেক দেশে জেন্ডার সমতা নিশ্চিতে নারী কোটা থাকলেও বাংলাদেশে এর সংখ্যা অনেক বেশি। এসব কোটার প্রার্থী না থাকায় বেশিরভাগ পদ ফাঁকা থাকছে।

কোন দেশে কত কোটা

অনগ্রসর গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়কে এগিয়ে নিতে ও মূলধারায় রাখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি চাকরি ও পড়াশোনার জন্য কোটা রাখা হয়। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, রাজ্য বা অঞ্চলকে এগিয়ে আনার জন্য এ কোটা রাখা হয়। চাকরিতে ওই অঞ্চলের প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। সেই সব দেশে আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও সময়ের ব্যবধানে সংস্কার হয় কোটা প্রথা। তবে সব দেশেই প্রাধান্য দেওয়া হয় মেধাবীদের।

ভারত

জনসংখ্যায় পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ভারত। এ দেশে মোট চার ধরনের কোটা রয়েছে। যেমন- আদিবাসী বা তফসিলি কোটা, অন্যান্য অনগ্রসরদের জন্য কোটা, জাতভিত্তিক কোটা এবং বিভিন্ন রাজ্যের সংখ্যালঘুদের কোটা।

ভারতে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা প্রদেশভেদে ভিন্ন। সার্বিকভাবে সমাজের দলিত ও বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার ভিত্তিতে সাংবিধানিকভাবে কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। শুধু চাকরি ক্ষেত্রেই নয়, সরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও পিছিয়ে পড়া এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সুশিক্ষা ও চাকরি নিশ্চিত করতে ভারতে জনসংখ্যার অনুপাতে কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের বৈষম্য রোধ করতে ১৯৮৯ সালে ভারতের আইনসভা কর্তৃক অনুমোদিত ‘দলিত, সংখ্যালঘু এবং উপজাতি বৈষম্য দূরীকরণ আইন’ নামে একটি সাংবিধানিক আইন রয়েছে।

ভারতের মোট ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ কোটা আছে। তবে তাদের একটি সুষ্ঠু কোটা বণ্টন ব্যবস্থা আছে। একটি পরিবারে শুধু একজনই এই কোটা ব্যবহার করতে পারবে এবং উচ্চশিক্ষায় কোটার ব্যবহার করা হলে চাকরিতে সেই ব্যক্তি আর কোটা ব্যবহার করতে পারবে না।

নেপাল

নেপালের সরকারি চাকরিতে কোটা দুই ভাগে করা আছে। একটি সাধারণ কোটা (৫৫ শতাংশ) এবং অন্যটি সংরক্ষিত কোটা (৪৫ শতাংশ)। সংরক্ষিত কোটার মধ্যে নারী, উপজাতি, মধেশি, দলিত সম্প্রদায়, প্রতিবন্ধী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাখা হয়েছে। এই ব্যবস্থা নেপালের আইনসভা কর্তৃক স্বীকৃত। ১৯৯৩ সালে নেপালের আইনসভা প্রণীত ‘সরকারি চাকরি আইন’ নামের বিশেষ একটি আইনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা সুরক্ষিত।

পাকিস্তান

পাকিস্তানে কোটা পদ্ধতি চালু আছে বিভিন্ন এলাকার জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে। দেশটিতে কোটা পদ্ধতির মূল কারণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সব অঞ্চলের মানুষ যেন সমানভাবে অংশ নিতে পারেন।

মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়া মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০.১ শতাংশ মালয়, ২২.৬ শতাংশ চীনা, ৬.৭ শতাংশ ভারতীয়, ১১.৮ শতাংশ স্বদেশজাত এবং ৮.৮ শতাংশ অন্যান্য। দেশটিতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জাতিগত কোটার মোট ৫৫ শতাংশ সুবিধা পেয়ে থাকে মালয় জনগোষ্ঠী। উচ্চশিক্ষা, চাকরি, স্বল্প মূল্যে বাসস্থানসহ সব ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ সুবিধা ভোগ করে মালয় জনগোষ্ঠী আর বাকি ৪০ শতাংশ সুবিধা ভোগ করে অন্যান্য জনগোষ্ঠী। তবে চাকরির ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগত সুবিধা মিললেও মেধার পরিচয় দিয়েই প্রবেশ করতে হয়।

কানাডা

উন্নত দেশ কানাডায় বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়, সংখ্যালঘু, নারী এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারি চাকরিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা ব্যবস্থা থাকলেও অনুপাতের সংখ্যাটি নির্দিষ্ট নয়।

যুক্তরাষ্ট্র

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুধু শতকরা ৮ ভাগ চাকরি প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। তবে চাকরি, শিক্ষা বা অন্য কোনো প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের বর্ণ বৈষম্য একটি শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন

নারীর ক্ষমতায়নে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ২০১২ সালে এক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে নন-এক্সিকিউটিভ চাকরিতে যেন ৪০ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া শারীরিকভাবে যারা অক্ষম, তাদের জন্য কোটা সংরক্ষণ হার শতকরা ৪ ভাগ।

জাপান

জাপানে বুরাকুমিন সম্প্রদায়কে সরকারি চাকরিতে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ব্যক্তি মালিকানাধীন বা বেসরকারি কোনো পণ্য ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীসংখ্যা পাঁচ শতাধিক হলে বুরাকুমিন এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য ৫ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

চীন

চীনের মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ হচ্ছে বিভিন্ন জাতি ও আদিবাসী সম্প্রদায়। এই জনগোষ্ঠীর জন্য চীন সরকার স্বীকৃতভাবে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতার বিধান রেখেছে। চীনে নারীদের জন্য একসময় ২০ শতাংশ কোটা ছিল। তবে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে ওই কোটা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য দেশটিতে এখনো ১.৫ শতাংশ চাকরি সংরক্ষণ করা হয়।

যা বলছেন কোটাবিরোধীরা

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। সেই সময় মেধাতালিকার জন্য ২০ শতাংশ বরাদ্দ রেখে ৪০ শতাংশ জেলাভিত্তিক, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য এবং ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার এই কোটা ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সর্বশেষ ৫৬ শতাংশ করা হয়।

শিক্ষার্থীদের দাবি, ২০২৪ সালে এসে এসব কোটার সংস্কার জরুরি। কারণ, এসব কোটায় প্রার্থীই পাওয়া যায় না। কোটা কমিশন গঠন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে (সব গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিতে হবে এবং কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী কেবল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।

শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে আরও রয়েছে— সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য ড. মোহাম্মদ সাদিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোটা সংস্কার হওয়া প্রয়োজন এবং এটিকে একটা যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা উচিত। আবার সংস্কারের নামে যেন পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

এনএম/এমজে