নতুন কারিকুলামে পাঠদান নিয়ে শুরু থেকে সারা দেশের অভিভাবকদের অনেক আপত্তি ছিল। তাদের আপত্তি আমলে না নিয়ে কারিকুলাম বাস্তবায়ন শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই কারিকুলামে ৬ষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন’, যা শুরু হয়েছে গত বুধবার থেকে।

ব্যতিক্রমী প্রক্রিয়ায় শুরু হওয়া এই পরীক্ষা বা মূল্যায়নের প্রথম দিনেই উঠেছে বিতর্ক। কারণ, পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগের রাতেই ফাঁস হয়ে যায় এর প্রশ্নপত্র। এ নিয়ে সারা দেশে শুরু হয় তুমুল আলোচনা। একদিকে নতুন কারিকুলাম নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, অন্যদিকে প্রশ্নফাঁস-- দুইয়ে মিলে বেশ উৎকণ্ঠায় আছেন অভিভাবকরা।

যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, বর্তমান কারিকুলামে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া দক্ষতাভিত্তিক। তাই প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও সার্বিক মূল্যায়নে কোনো সমস্যা হবে না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমান কারিকুলাম নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে এখনো এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। তারা মনে করছেন, এ কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা বই বিমুখ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে যদি মূল্যায়নেরও প্রশ্ন ফাঁস হয় তাহলে কারিকুলাম বাস্তবায়নে পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তাই এটি কীভাবে বন্ধ করা যায় তার পদ্ধতি খুঁজে বের করতে এনসিটিবিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রচলিত মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে প্রায়োগিক দক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি চালু হয়েছে। নতুন নিয়মে মূল্যায়ন হচ্ছে কেন্দ্রীয়ভাবে এনসিটিবি তৈরি করা শিক্ষার্থী নির্দেশিকা বা প্রশ্নের ভিত্তিতে। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা এ প্রশ্নপত্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করছেন।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমান কারিকুলামে প্রশ্ন ফাঁস হলেও সামষ্টিক মূল্যায়নে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ, এখন পুরো কারিকুলামটি দক্ষতা ও প্রাকটিক্যাল (বাস্তবভিত্তিক) নির্ভর। তারপরও যেহেতু প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠেছে, কেন হচ্ছে তার কারণ খতিয়ে দেখতে এবং তা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জন্য সংশ্লিষ্টদের বলেছি।

যেভাবে হচ্ছে প্রশ্নফাঁস

মূল্যায়নের প্রশ্নপত্র কেন্দ্রীয়ভাবে এনসিটিবি তৈরি করে এবং প্রত্যেক পরীক্ষার আগের রাতে ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপের মাধ্যমে স্কুল প্রধানের কাছে পাঠানো হয়। প্রধান শিক্ষক তার পাসওয়ার্ড দিয়ে সেই প্রশ্নপত্র ডাউনলোড এবং প্রিন্ট করে শিক্ষার্থীদের মাঝে সরবরাহ করেন।

কিন্তু গত বুধবার থেকে শুরু হওয়া ষান্মাসিক মূল্যায়নের প্রশ্নপত্র আগের রাতে ফাঁস হয়ে যায় এবং তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে পৌঁছে যায়। এ নিয়ে বুধবার ও বৃহস্পতিবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। অভিভাবকরা সেখানে তাদের দুশ্চিন্তার কথা জানান। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া থামেনি।

গতকাল শনিবার ছিল ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি, সপ্তম শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি, অষ্টম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নবম শ্রেণির ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ের পরীক্ষা। এসব বিষয়ের প্রশ্নপত্রও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমাধানসহ পাওয়া যায়।

রাজধানী গর্ভমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক শুক্রবার রাতে এ প্রতিবেদকের কাছে প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে বলেন, রাত ১১টার দিকে দেখি আমার মেয়ে মোবাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে সে মোবাইল লুকিয়ে ফেলে। পরে জানতে পারলাম তার বন্ধুদের কাছে স্কুলের শিক্ষক প্রশ্নপত্র পাঠিয়েছেন। সেই প্রশ্ন দেখে বাসা থেকে আগেই সমাধান করে যাবে।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নতুন কারিকুলামের কারণে তার সন্তান এমনিতেই পড়ার টেবিলে বসে না। এরপর যদি আগের রাতে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায় তাহলে পড়াশুনার বাকি থাকল কী? নতুন কারিকুলামে টেক্সট বই থেকে কমপক্ষে ৫০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা ফিরিয়ে আনার দাবি জানান তিনি।

এডুকেশন অ্যাসিসট্যান্ট নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলে শনিবারের শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ের সব প্রশ্নের সমাধান পাওয়া যায়। সেখানে প্রমাণ হিসেবে নৈপুণ্য অ্যাপের সঙ্গে তার সমাধান করা প্রশ্নের স্কিনশটসহ শেয়ার দেওয়া হয়।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথমত আমরা এটিকে ‘প্রশ্নফাঁস’ বলতে চাই না। কারণ, নতুন কারিকুলামে মূল্যায়ন পুরোটাই হচ্ছে একজন শিক্ষার্থীর দক্ষতা ও যোগ্যতার ওপর। পুরো সময় ধরে সে কী শিখেছে তার কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন হচ্ছে। ওই শিক্ষার্থী আসলে কী শিখেছে তার পারদর্শিতার মাধ্যমে প্রকাশ পাবে। তাই সে আগের রাতে প্রশ্ন পেল নাকি পেল না, তাতে মূল্যায়নে কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে প্রশ্নগুলো কীভাবে আগের রাতে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তা বন্ধের উপায় খোঁজা হচ্ছে।

এ বিষয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক রোকনুজ্জামান শেখ বলেন, বিষয়টি শুনতে খারাপ লাগছে। কোনো শিক্ষক ছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁস করা কঠিন। তাই এ বিষয়ে শিক্ষকদের সৎ ও নিষ্ঠাবান হতে হবে এবং কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।

প্রশ্নফাঁসের পদ্ধতি খুঁজছে এনসিটিবি

গত ৩ জুলাই মূল্যায়নের প্রথম দিন প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠে। পরে এনসিটিবির পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সচেতন করে নৈপুণ্য অ্যাপের মাধ্যমে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে কেউ প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমেও প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি পাঠানো হয়।

এদিকে নৈপুণ্য অ্যাপ-এ যে প্রশ্ন আগের রাতে পাঠানো হয় সেটি পরীক্ষার দিন সকালে পাঠানো যায় কি না তা চিন্তা করা হচ্ছে। তবে পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্ন পাঠালে সেখানে টেকনিক্যাল কিছু সমস্যা তৈরি হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে করা এ প্রশ্নপত্র প্রতিষ্ঠান প্রধানরা প্রিন্ট করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হয়। অনেক জায়গা বিদুৎ থাকে না। এর বিকল্প কী করা যায় তা নিয়ে ভাবতে বলেছে মন্ত্রণালয়।

ট্র্যাকিং হবে শিক্ষকদের আইডি

প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের প্রতি জরুরি বার্তা দিয়েছে এনসিটিবি। প্রতিষ্ঠানপ্রধানের মাধ্যমে মূল্যায়ন কার্যক্রমের নির্দেশনাগুলো কোনো অপ্রাসঙ্গিক কমিউনিটি বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ারের বিষয়টি প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে। নৈপুণ্য অ্যাপের ইউজার আইডির মাধ্যমে এই মূল্যায়ন নির্দেশনা ডাউনলোড ও বিতরণ কার্যক্রম ট্র্যাকিং করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আছে। এ জন্য মূল্যায়ন নির্দেশনাগুলো বিতরণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমান কারিকুলাম নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে এখনো এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। তারা মনে করছেন, এ কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা বই বিমুখ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে যদি মূল্যায়নেরও প্রশ্ন ফাঁস হয় তাহলে কারিকুলাম বাস্তবায়নে পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তাই এটি কীভাবে বন্ধ করা যায় তার পদ্ধতি খুঁজে বের করতে এনসিটিবিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মূল্যায়ন চলাকালীন সময় কয়েকজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি সেল গঠন করা হবে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব মনিটরিং করবেন। কোনো শিক্ষকের আইডি থেকে যদি প্রশ্নফাঁস হয় তবে তাৎক্ষণিকভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে।

এদিকে এনসিটিবির এক জরুরি বার্তায় বলা হয়, কিছু প্রতিষ্ঠানপ্রধান বিভিন্ন মহলের সঙ্গে প্রশ্নপত্র শেয়ার করায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে কিছু অসাধু ব্যক্তি ও সংস্থা এই মূল্যায়ন নির্দেশিকার অসত্য, ভুল, অপ্রাসঙ্গিক ও বিভ্রান্তিকর সমাধান করছে যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। বিভ্রান্তিকর সমাধানগুলো শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের ব্যাপকভাবে বিভ্রান্ত করছে। এতে মূল্যায়ন কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে।

জরুরি বার্তায় আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানপ্রধান বা প্রধান শিক্ষকের নিজস্ব আইডিতে পাঠানো নির্দেশিকাগুলো বাইরের কারও সঙ্গে শেয়ার করা শিক্ষকতার নৈতিকতাবিরোধী কার্যক্রম এবং চরম অশিক্ষকসুলভ আচরণ।

এনএম/এসকেডি