#ফেল থেকে জিপিএ-৫ পেল ৭ জন, পাস করল ১১১০ জন
#বিভিন্ন গ্রেডে ফল পরিবর্তন হয়েছে প্রায় ৮৮৭৫ জন শিক্ষার্থীর

সদ্য প্রকাশিত এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে সন্তুষ্ট না হয়ে খাতা চ্যালেঞ্জ করা প্রায় ৮ হাজার ৮৭৫ জন পরীক্ষার্থীর ফলাফলে পরিবর্তন এসেছে। তাদের মধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১২২৪ জন। আগের ফলাফলে অনুত্তীর্ণ থাকা পরীক্ষার্থীদের মাঝে খাতা চ্যালেঞ্জের পর সর্বোচ্চ গ্রেড জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৭ জন। শুধু তাই নয়, আগের প্রকাশিত ফলাফলে ফেল থাকা পরীক্ষার্থীদের মাঝে খাতা চ্যালেঞ্জ করে পাস করেছেন ১১১০ জন শিক্ষার্থী। চলতি বছরের এসএসসির পুনঃনিরীক্ষণের ফলে এমন অস্বাভাবিক ফল পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। খাতা মূল্যায়নের এই চিত্রকে বিপজ্জনক বলছেন শিক্ষাবোর্ড সংশ্লিষ্টরা।

মঙ্গলবার (১১ জুন) এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার খাতা পুনঃনিরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে ৯টি সাধারণ এবং মাদ্রাসা বোর্ডের প্রকাশিত পুনঃনিরীক্ষণের ফল বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ফল এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্রকাশ করেনি।

গত ১২ মে চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। এতে গড় পাসের হার ছিল ৮৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। প্রকাশিত ফলাফলে কোনও শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত ফল না পেলে সে খাতা চ্যালেঞ্জ করার জন্য গত ১৩ মে থেকে ১৯ মে পর্যন্ত অনলাইনে আবেদন করার সুযোগ দেয় শিক্ষা বোর্ডগুলো।

অন্যান্য বছর পুনঃনিরীক্ষণের ফল পরিবর্তনের চেয়ে এবার ফল পরিবর্তনের সংখ্যাটি অস্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা। বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর ফলাফল পরিবর্তনের পেছনে পরীক্ষকদের সরাসরি গাফিলতি রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুনঃনিরীক্ষণে নতুন করে কোনো উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয় না। শুধু উত্তরপত্রে শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বরের যোগ-বিয়োগগুলো দেখা হয়। এতেই এতো সংখ্যক শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। যদি আবার মূল্যায়নের সুযোগ দেওয়া হয় তবে পরিস্থিতি কি হবে প্রশ্ন রেখে তারা বলছেন, শুধু পরীক্ষকদের গাফিলতিতে এমনটা হচ্ছে। এজন্য ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করার রীতিকে দায়ী করছেন তারা।

এর আগে ২০১৯ সালে টানা তিন বছর ধারাবাহিক গাফিলতির কারণে ১ হাজার ২৬ পরীক্ষককে শাস্তির আওতায় আনে শিক্ষাবোর্ড। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বোর্ডের আইন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অভিযুক্ত বেশিরভাগ পরীক্ষককে কালো তালিকাভুক্ত, কাউকে সারা জীবনের জন্য কোনো বোর্ডের পরীক্ষক হতে না পারার মতো শাস্তি দেওয়া হয়। তবে যেসব পরীক্ষক খাতা মূল্যায়নে কেলেঙ্কারি বা ক্রাইমে যুক্ত হন, তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ এবং চাকরিচ্যুতির নজির রয়েছে। এরপর বিভিন্ন সময় তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা হলেও সংখ্যাটা খুবই কম।  

এ ব্যাপারে আন্তঃবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর আবুল বাশার ঢাকা পোস্টকে বলেন, খাতা চ্যালেঞ্জ করে ফল পরিবর্তনের সংখ্যাটা অন্যান্য বছরের চেয়ে অস্বাভাবিক। এর কারণ খতিয়ে দেখা হবে। ফল পরিবর্তন হবে এটি স্বাভাবিক ঘটনা, তবে এই সংখ্যাটি যদি নির্দিষ্ট পার্সেন্টের বাইরে চলে যায় তবে আমাদের চিন্তার বিষয়। নিশ্চয় কোনও জায়গায় সমস্যা হচ্ছে, তা চিহ্নিত করতে হবে।  

তিনি জানান, সব বোর্ডের তথ্য সংগ্রহ করে চিহ্নিত পরীক্ষকদের বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী অভিযুক্ত বেশিরভাগ পরীক্ষককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। অপরাধের মাত্রা বেশি হলে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করার জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়।

কোন বোর্ডে কত জনের ফল পরিবর্তন

ঢাকা বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষার কাঙ্ক্ষিত ফল না পেয়ে ১ লাখ ৭৯ হাজার ১৪৮টি উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করে শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে মোট ২ হাজার ৭২৩ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। এতে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৩৪ জন আর ফেল থেকে পাস করেছেন ১২৭ জন পরীক্ষার্থী।

চট্টগ্রাম বোর্ডে ফলাফল পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আবেদন করে মোট ২৮ হাজার ৩৫১ জন পরীক্ষার্থী ৭৬ হাজার ৪২টি উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আবেদন করেছিল। তাদের মধ্যে ২ হাজার ৬০ জনের বিভিন্ন গ্রেডে ফল পরিবর্তন হয়েছে। এরমধ্যে ফেল থেকে পাস করেছে ১০২জন এবং একজন নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন।

বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে এ বছর খাতা পুনঃনিরীক্ষণের জন্য ৭ হাজার ৫৯৩ শিক্ষার্থী ২২ হাজার ৬৬৩টি খাতা চ্যালেঞ্জ করেছিলো। সেখান থেকে মোট ১৬২ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৫ শিক্ষার্থী আর ফেল থেকে পাস করেছে ৩ শিক্ষার্থী।

দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডে মোট ফল পরিবর্তন হয়েছে ৮৭৭ জন শিক্ষার্থীর। তাদের মধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৮৮ জন, ফেল থেকে নতুন করে পাস করেছেন ১৩৬ জন।

রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, এই শিক্ষা বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষার খাতা পুনঃনিরীক্ষণের জন্য ২২ হাজার ৮৭০ জন শিক্ষার্থী ৫৩ হাজার ১৭৪টি খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করে। এতে ফল পরিবর্তন হয়েছে ৫৮২ জনের। এরমধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৪৩ জন। ফেল থেকে নতুন করে পাস করেছে ৩৪ জন।

যশোর বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষার খাতা পুনঃনিরীক্ষণে মোট ২৮১ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। তাদের মধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১১৫ জন। আর ফেল থেকে নতুন করে পাস করেছে ৫৯ জন। বাকিরা বিভিন্ন গ্রেডের ফল পরিবর্তন হয়েছে।

কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে এসএসসি পরীক্ষার বিভিন্ন বিষয়ে ৩০ হাজার ৮৯৮ জন শিক্ষার্থী ৭৫ হাজার ৮৫ উত্তরপত্র চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করে। তাদের মধ্যে ৭৮১ জনের ফল পরিবর্তন হয়। এর মধ্যে ৭৭ জন নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ২০৪ জন ফেল থেকে পাস করেছেন।

ময়মনসিংহ শিক্ষাবোর্ডে মোট ৭৭৮ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১০১ শিক্ষার্থী। ফেল থেকে পাস করেছে ২৬৩ শিক্ষার্থী।

সিলেট শিক্ষাবোর্ডে মোট ২৪৯ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। তাদের মধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪১ জন। ফেল থেকে পাস করেছে ৩৮ জন।  

মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দাখিল পরীক্ষার খাতা চ্যালেঞ্জ করে ২৬ হাজার ২৯৪ জন পরীক্ষার্থী ৪৮ হাজার ৫৮১টি খাতা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তাদের মধ্যে মোট ৩৮২ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। ফেল থেকে পাস করেছে ১৪৪ জন শিক্ষার্থী, আর নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪৯ জন পরীক্ষার্থী।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি বছরের ফল পরিবর্তনের সংখ্যা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। নতুন করে ১২২৪ জন শিক্ষার্থীর জিপিএ-৫ পাওয়া এবং ১১শ এর বেশি শিক্ষার্থী ফেল থেকে পাস করার ঘটনা আগে ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। এবার এমন কেন হয়েছে তা তদন্ত করে দায়ীদের চিহ্নিত করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, পরীক্ষকদের উদাসীনতায় পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফলে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এতে অনেকেই তার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল থেকে বঞ্চিত হন। ফল প্রকাশের পর এসব শিক্ষার্থী চ্যালেঞ্জ করলে প্রায় সাড়ে ৮ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। উত্তরপত্র নতুন করে মূল্যায়ন করলে এ সংখ্যা আরও কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। তবে প্রতি বছরই এ ঘটনা ঘটলেও দায়ী শিক্ষকরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। অল্প সময়ে ফল প্রকাশ করতে গিয়ে পরীক্ষকদের দ্রুত সময়ে খাতা মূল্যায়ন করার একটা চাপ থাকে। এ চাপ সামলাতে গিয়ে পরীক্ষকরা এ ভুল করছেন বলে মনে করেন তারা।

পুনর্মূল্যায়নে যেসব বিষয় দেখা হয়

বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন হওয়া উত্তরপত্রের চারটি দিক দেখা হয়। এগুলো হলো— উত্তরপত্রের সব প্রশ্নের সঠিকভাবে নম্বর দেওয়া হয়েছে কিনা, প্রাপ্ত নম্বর গণনা ঠিক রয়েছে কিনা, প্রাপ্ত নম্বর ওএমআর শিটে উঠানো হয়েছে কিনা ও প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী ওএমআর শিটের বৃত্ত ভরাট করা হয়েছে কিনা। এসব পরীক্ষা করেই পুনর্নিরীক্ষার ফল দেওয়া হয়। তবে পরীক্ষক কোনো প্রশ্নের উত্তরের জন্য যে নম্বর দিয়ে থাকেন সেটি পরিবর্তনের সুযোগ নেই।

যেমন— পরীক্ষক একটি প্রশ্নের উত্তরের জন্য ৬ নম্বর দিয়েছেন; সেটি ভুলবশত ৩ নম্বর হিসেবে গণনা করা হলো; এ ধরনের ভুল সংশোধন করা হয়। এ ক্ষেত্রে কোনোভাবে যাতে পরীক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা বিবেচনায় রাখা হয়। কিন্তু এই ৬ নম্বরের স্থলে ৮ করার সুযোগ নেই।

এনএম/পিএইচ